কিং খানের বেড়ে উঠা-১

অভিনেতা হতে চেয়েছিলেন শাহরুখ খানের বাবাও

আমিনুল ইসলাম, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০১৭, ০৯:৫৪ | প্রকাশিত : ০৮ নভেম্বর ২০১৭, ০৮:১২
শাহরুখের বাবা মীর তাজ মোহাম্মদ খান

নির্মাতা মহেশ ভাট একদা মন্তব্য করেছিলেন যে- পাকিস্তানিরা ভারতের সাথে যুদ্ধে যেতে পছন্দ করবে না, কারণ শাহরুখ ভারতে বাস করেন। শাহরুখ খানকে পাকিস্তানিরা কতটুকু ভালোবাসে-এ কথা বোঝাতেই মহেশ ভাট এ মন্তব্য করেন।

শাহরুখ খানের পৈত্রিক ভূমি বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখাওয়া প্রদেশে। এই প্রদেশের সাবেক নাম ছিলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ। প্রদেশের রাজধানী শহর হচ্ছে পেশোয়ার। পেশোয়ার যদিও পাকিস্তানের একটি প্রদেশের রাজধানী, পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানের সাথেই এর বেশি সাদৃশ্য। এটি হচ্ছে পাঠানদের নগরী, যারা নিজেদেরকে দুর্ধর্ষ চেঙ্গিস খানের বংশধর বলেই মনে করে।

পেশোয়ারের কিস্সা খাওয়ানি বাজার এলাকার লোকজন অত্যন্ত গর্ববোধ করে, কারণ সেখানেই জন্ম নিয়েছে বলিউডের এরকম কিছু মহারথী যাদের অবদানের কথা হিন্দি সিনেমা কখনই ভুলতে পারবে না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পেশোয়ারের ব্রিটিশ কমিশনার স্যার অ্যাডওয়ার্ড হার্বার্ট কিস্সা খাওয়ানি বাজার এলাকাকে তুলনা করেছিলেন -Piccadilly of central asia নামে।

এখানের ডাক্কি নাল বন্দি মহল্যা এরিয়ায় কাপুর খান্দানের স্রষ্টা পৃথ্বিরাজ কাপুর বসবাস করতেন। পাঁচ মিনিট দূরে ডুমা গলি হচ্ছে দিলীপ কুমারের পৈতৃক ভিটা। দুই বিখ্যাত বলিউড কিংবদন্তীর বাড়ি থেকে প্রায় হাঁটা দুরত্বে ১১৪৭ নাম্বার বাড়িতে শাহরুখ খানের পিতা মীর তাজ মোহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৮ সালে।

পিতা মীর জান মোহাম্মদের ছয় সন্তানের মধ্যে শাহরুখের পিতা ছিলেন সবার ছোট। শাহরুখ খানের দাদা মীর জান মোহাম্মদ ছিলেন ছয় ফুটের অধিক উচ্চতার এক বলশালী পাঠান। পারিবারিকভাবে বাঁশের ব্যবসা ছিল তাঁর। আর দশটা উপমহাদেশীয় আবহের মধ্যেই ছিল পরিবার।

অভাবে, অনটনে আর কষ্টেসৃষ্টে। পরাধীন দেশ হওয়ায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত ছিলো শাহরুখ খানের পরিবারের। শাহরুখ-পিতা মীর তাজ মোহাম্মদ তৎকালীন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী নেতা খান আবদুল গাফফার খানের শিষ্য ছিলেন। গাফফার খান ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর একজন অনুরাগী।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের জন্য গাফফার খান ছিলেন সুবিদিত। তাঁর উপাধি ছিলো সীমান্ত গান্ধী। ১৯৩৭ সালে যখন ভারত শাসন আইন-১৯৩৫ এর ভিত্তিতে নির্বাচন হয়, কংগ্রেসের সাথে মিলে গাফফার খান জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেন। পরে অবশ্য কংগ্রেসের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠন করেন। সেই সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ছিল একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত প্রদেশ যেখানে কংগ্রেস সরকার গঠন করে।

শাহরুখের মা ফাতেমা লতিফ

১৯৪২ সালে যখন মহাত্মা গান্ধী ভারত ছাড় আন্দোলন শুরু করেন, আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে পেশোয়ারেও। গান্ধী-নেহেরুকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আন্দোলন সহিংস হয়ে পড়ে পেশোয়ারসহ সমগ্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও। হাজার হাজার লোক গ্রেপ্তার হয়। নিহত হয় অনেক লোক। শাহরুখ-পিতা মীর তাজ মোহাম্মদ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। উর্দু ভাষায় জ্বালাময়ী ভাষণ দেন ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। পেশোয়ারের কিং অ্যাডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র ছিলেন তিনি। টানা দুই বছর জেল খাটেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিল্লি চলে আসেন। ১৯৪৬ সালে দিল্লি ইউনিভার্সিটিতে আইন বিভাগে ভর্তি হন তিনি। পেশোয়ারের কিস্সা খাওয়ানি বাজারে পড়ে থাকে পুরো পরিবার।

অবশেষে আসলো কাঙিক্ষত স্বাধীনতা। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭। ব্রিটিশরা ক্ষমতা হস্তান্তর করে দুই দেশের কাছে। জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান। কিন্তু হায়! ভাইয়ের হাতে ভাইয়ের রক্তমিশ্রিত হয় এই স্বাধীনতা। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয় ভারত-পাকিস্তান। ঠিক তেমনি ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয় বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ। পাকিস্তান থেকে হিন্দুু ও শিখরা প্রাণভয়ে ভারত চলে আসে। ভারতের-বিশেষত পাঞ্জাবের-মুসলমানরা পাকিস্তান অভিমুখে ছুটতে থাকে। শুরু হয় রক্তের হোলিখেলা। মুসলমানরা ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবর’ বলে হিন্দুদেরকে জবাই করে ট্রেন দিয়ে ভারত পাঠিয়ে দেয়। হিন্দুু আর শিখরা মিলে মুসলমানদেরকে পাইকারিহারে হত্যা করে সেই ট্রেনেই পাকিস্তান পাঠিয়ে দেয়।

সেই পরিস্থিতিতে শাহরুখ খানের পিতা দিল্লিতে। দেশে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নাই। দিল্লিতে তাঁর হিন্দু বন্ধুবান্ধবরা আশ্বাস দিলেন-পাকিস্তান যাওয়ার দরকার নাই। এখানে তাঁরাই আগলে রাখবেন। বন্ধুবান্ধবের আশ্বাসে মীর তাজ মোহাম্মদ দিল্লিতেই থেকে গেলেন। কানহাইয়া লাল পশ্বল নামে এক বন্ধু শাহরুখের পিতাকে সার্বক্ষণিক সহায়তা করলেন

কানহাইয়া পরে মন্ত্রী হয়েছিলেন। মীর তাজ মোহাম্মদ আইন বিভাগে গ্রাজুয়েশন লাভ করলেন দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৪৯ সালে। কিন্তু আর আইন পেশায় আসেননি। ৪০ বছর পর তাঁর ছেলে যে কাজটা করেছিল, তিনিও সেই পথ ধরলেন। দিল্লি থেকে মুম্বাই গেলেন সিনেমার অভিনেতা হওয়ার বাসনায়।

কিন্তু হলো না:-

হিন্দি সিনেমার তখন স্বর্ণযুগ। দিলীপ কুমার-দেব আনন্দ-রাজ কাপুর-এই ত্রিরত্ন মিলে বলিউড শাসন করছেন। বাঙালি বুদ্ধিজীবী শশধর মুখার্জী, অমিয় চক্রবর্তী, বিমল রায়রা হিন্দি সিনেমার হাল ধরেছেন। লতা মুঙ্গেশকার, মোহাম্মদ রাফি, মুকেশদের সুরেলা কন্ঠের গান সবার ঘরে ঘরে। ১৯৫৭ সালে মেহবুব খান নির্মাণ করলেন কালজয়ী সিনেমা ‘মাদার ইন্ডিয়া’। ‘মাদার ইন্ডিয়া’ই প্রথম হিন্দি সিনেমা যেটি অস্কারের জন্য মনোনীত হয়। যদিও ফ্রেদিরিক ফেলিনির ‘নাইটস অব ক্যাভিরিয়া’র কাছে এক ভোটের ব্যবধানে হেরে যায়।

মা বাবা ও একমাত্র বড় বোন শাহনাজ লালারুখ

১৯৬০ সালে নির্মিত হয় আরেক কালজয়ী সিনেমা ‘মুঘল-ই আজম’। সেই ‘মুঘল-ই আজম’ সিনেমার সেটে উপস্থিত শাহরুখ পিতা মীর তাজ মোহাম্মদ খান। মীর তাজ সাহেব ভেবেছিলেন-তার সুদর্শন পাঠান ফিগার সহজেই প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যাবে। কিন্তু হায়! তাকে দেয়া হয়েছিল ‘এক্সট্রা শিল্পী’র চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ। একদিন শুটিং করেই তিনি অপমানিত বোধ করলেন। আর শুটিং করতে আসেননি। তৎকালীন সময়ের আরেক বিখ্যাত অভিনেতা অশোক কুমারের বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দরজার সামনে থেকেই ফিরে আসতে হয়। সিনেমায় অভিনয়ের আশা ছেড়েই দেন। তবুও মুম্বাই নগরীতে ভবঘুরের মতো দিন কাটাতে লাগলেন। মেরিন ড্রাইভের পাড় ধরে প্রায়ই হাঁটেন। হঠাৎ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লে বন্ধু কানহাইয়া লাল তাকে দিল্লি নিয়ে যান। মীর তাজ মোহাম্মদ খান তখন ২৯ বছরের যুবক।

উর্দু কবিতার ভক্ত মীর দিল্লিতে পান চিবোতে চিবোতে রাস্তায় হাঁটেন উদাস মনে। কোনো কর্ম নাই, উপার্জন নাই-এভাবেই চলছে দিন; বন্ধু কানহাইয়া লালের দয়ায়।

দিল্লির বিখ্যাত ইন্ডিয়া গেইট এলাকায় হাঁটতে গিয়ে একদিন দেখলেন-গাড়ি দুর্ঘটনায় এক কিশোরী মারাত্মক আহত হয়ে পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি তাকে নিয়ে হাসপাতালে গেলেন। রোগীর রক্ত দরকার। ডাক্তার পরীক্ষা করে দেখলেন-মীরের সাথে দুর্ঘটনায় আহত কিশোরীর রক্তের গ্রুপ মিলে গেছে। মীর রক্ত দিলেন কিশোরীকে। কিশোরী সুস্থ হলে তাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর রওয়ানা হলেন মীর। গিয়ে দেখেন কিশোরীর মা পঞ্চম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় আছেন। তাঁরও রক্ত দরকার। আশ্চর্যের বিষয় মেয়ের মায়ের রক্তের গ্রুপও মীরের সাথে মিল। মাকেও রক্ত দিলেন মীর।

প্রিয় পাঠক! যাদের ছেলে পরবর্তীকালে হিন্দি সিনেমার সর্বকালের সেরা সুপারস্টার হবেন, তাদের পরিচয়পর্বের কাহিনি হিন্দি সিনেমার চিত্রনাট্যকে হার তো মানাবেই। দিল্লির দুর্ঘটনার আহত তরুণীই হলেন শাহরুখ খানের মা ফাতেমা লতিফ।

ফাতেমা লতিফ হলেন অত্যন্ত সুশিক্ষিত হায়দরাবাদের এক রাজপরিবারের মেয়ে। মীর ফাতেমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলেন। বেকার ছেলের সাথে বিয়ে দিতে কোনোমতেই রাজি ছিল না ফাতেমার পরিবার। কিন্তু মীর নাছোড়বান্দা, বিয়ে তিনি ফাতেমাকেই করবেন। ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মীর ও ফাতেমা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

চলবে...

ঢাকাটাইমস/০৮নভেম্বর/এআই/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :