রাস্তা কত দিন আর শিক্ষার্থীদের দখলে থাকবে?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০২ আগস্ট ২০১৮, ২১:৫০

আমাদের কোমলমতি ছেলে-মেয়েগুলো এখনো রাস্তায় আছে, তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক নিহতের পরিবার দুটিকে ২০ লাখ করে টাকা এবং দাবিসমূহ মেনে নেয়ার আশ্বাস প্রদানের পর অনেকে বাসায় চলে গেছে। তবে সবাই চলে যায়নি। সন্ধ্যার একটু পরেও দেখলাম, একটা সরকারি দামি গাড়ির কী একটা কাগজ নেই, ছোট ছোট কয়েকটি ছেলে গাড়িটাকে আটকে পুলিশ বক্সে নিয়ে গেল। এমন দৃশ্য দেখে সারাদিনই চোখে পানি এসেছে। তবে আমি শঙ্কিত কিছু বিষয় নিয়ে।

ঘোলাটে পরিস্থিতিতে বড় মাছ শিকারে অর্থাৎ নাশকতা করতে ওস্তাদ জামায়াত-বিএনপি জোট। এই ছেলে-মেয়েগুলোর একটা সৃজনশীল আন্দোলনে সাপোর্ট দিয়ে বিএনপি এখন কী প্রমাণ করতে চাইছে? ফখরুল সাহেব পারলে একটু ছেলে-মেয়েদের মাঝে এসে কথা বলে যান। ছেলে-মেয়েদের মাঝে এসে পড়লে, মির্জা ফখরুল বুঝতে পারবেন, এসব সাহসী ছেলে-মেয়ে ইনাকে বা ইনার দলের লোকজনকে কী দৃষ্টিতে দেখে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনেও এভাবে সমর্থন দিয়ে আন্দোলনটা শেষ করে দিয়েছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। শেখ হাসিনার ওপর এই ছেলে-মেয়েদের ভরসা আছে বলেই তো এরা এখনো দাবি জানাচ্ছে। আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রীকে যদি ওনার কাছের লোকজন মিসগাইড না করেন তাহলে তিনি শিক্ষার্থীসহ আমাদের সবার মনের ইচ্ছা বুঝতে পারবেন।

আজ একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এই প্রশ্ন সবার কাছে। আজ ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় আমি গেছি। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা যতটুকু পারছে সঠিক মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার করছে। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়া কাউকে পেলে পুলিশে দিচ্ছে, লেন মেনে যেতে গাড়িগুলোকে বাধ্য করছে, হেলমেটবিহীন মোটরসাইকেল আরোহী পেলে তাকে হেলমেট পরতে বলছে।

সবার পাশাপাশি সারা দিনই বোতল পানি, বিস্কুট, কলা বিতরণ হয়েছে আন্দোলনকারীদের মাঝে। ছেলে-মেয়েরা নিজেদের পকেটের টাকা খরচ করে এই পানি আর বিস্কুট কিনেছে? আমি কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করেছি, আমাকে বলেছে, ‘আংকেল, এগুলো কোত্থেকে আসছে, আমরা জানি না’।

বিএনপি-জামায়াত জোট যে নাশকতা করতে চাইছে, সেটি তো দুই একটা ভুয়া অনলাইনের নিউজ দেখলেই বোঝা যায়। প্রধানমন্ত্রী নাকি সংসদে এই আন্দোলন নিয়ে কী বলেছেন! এখন তো সংসদে কোনো অধিবেশনই নেই। সরকার-বিরোধী কিছু বাম নেতাকেও দেখলাম ছেলে-মেয়েদের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ছেলে-মেয়েরা খুব একটা পাত্তা দিচ্ছিল না যদিও।

যাই হোক, বড় প্রশ্ন হল, এখন এই অভিনব আন্দোলনের শেষ হবে কীভাবে? একটা জিনিস লক্ষ করলাম। ছেলে-মেয়েরা যখন রাস্তায় ব্যস্ত, তখন টেলিভিশনে স্ক্রল দেখানো হচ্ছে, সরকার কী কী করেছে! ছেলে-মেয়েদের মাঝে এই বার্তাগুলো যে কেউ একটু একসময়ে নিয়ে যাবে, তার অভাব অনুভব করলাম। এই বার্তাবাহক হতে পারতেন দেশের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বরা, যাঁদের ছেলে-মেয়েরা ভালোবাসে।

যেমন ধরুন আমাদের ক্রিকেটাররা। কিংবা আমাদের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে যারা জনপ্রিয়। কিংবা তারকা শিক্ষক ডক্টর জাফর ইকবাল স্যারের মত মানুষ যারা এদেশের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের মাঝে খুব জনপ্রিয়।

ছেলে-মেয়েগুলো রাস্তায় কেউ টেলিভিশন দেখছিল না। ওরা ভাবছে সরকার কিছুই করছে না, এদের ক্ষোভ বেড়ে যায় এতে। যোগাযোগের জগতে বৈকল্য দেখা দিলেই যত দুর্যোগ ঘটে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুণগত মানের মিশ্রণ আছে। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়ে খুবই ভদ্র, চৌকস, সাহসী আর বিনয়ী এবং সৃজনশীল।

তবে কিছু ছেলে আছে খুব উচ্ছৃঙ্খল। এরা খুব নোংরা ভাষায় পুলিশকে গালি দিচ্ছিল, অশ্লীল ভাষায় স্লোগান দিচ্ছিল। একা পুলিশকে দায়ী করে বাজে কথা বলার সাথে এই সৃজনশীল আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই, থাকা উচিত না। পুলিশ একাই খারাপ, আর সবাই ভালো, এমনটা ভাবাও অন্যায়।

রাজনীতিবিদ আর আমলারা মিলে এই দুষ্টচক্র তৈরি করেছে এবং পুলিশ হচ্ছে শুধু একটা উপজাত মাত্র। নীতিনির্ধারকরা ঘুষের বিনিময়ে চাকরি দেয়া বন্ধ করে দিলেই কিন্তু পুলিশসহ সবাই সৎ হওয়ার একটা কারণ খুঁজে পায়।

আরেকটা বিষয় বলি, ছেলে-মেয়েরা সবাই শাজাহান খানের পদত্যাগ চাইছে না। একদল পদত্যাগ চাইছে, আরেক দল বলছে, উনি পদত্যাগ করলে কোনো লাভ হবে না। পরিবর্তন মন্ত্রীর নয়, পরিবর্তন দরকার সিস্টেমের। মাইকে শাহবাগে একটা ছেলে বলছিল, ‘সরকার লিখিতভাবে একটা অফিসিয়াল বিবৃতি দিয়ে সব দাবি মেনে নেয়ার ঘোষণা দিক, এরা আন্দোলন ছেড়ে চলে যাবে।’

আরেকটা ছেলে বলছিল, ‘আমরা কারও মুখের কথায় বিশ্বাস করি না, লিখিত বিজ্ঞপ্তি আসুক সরকারি কাগজে। চলমান পরিস্থিতির দ্রুত একটা অবসান দরকার। ছেলে-মেয়েরা তো আর আজীবন এই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করবে না। একদিন না একদিন তো ঘরে ফিরে যেতেই হবে। এর ফাঁকে যদি কোনো শক্তি নাশকতা করে দেয়, তখন কিন্তু আমছালা দুটোই যাবে। চলমান পরিস্থিতিও নৈরাজ্যের আরেক রূপ।

চূড়ান্তভাবে পুলিশই ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করবে, বিআরটিএ লাইসেন্স দেবে। এখন কথা হল, বড় মানুষগুলো সমাজকে যে ধাক্কা দিতে পারেনি, ছোট ছোট স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীরা কিন্তু সেই ধাক্কা দিতে সক্ষম হলো। এই ধাক্কা আমাদের দুর্নীতিবাজ আমলা আর রাজনীতিবিদদের গায়ে লাগলেও মনে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে কি না, সেটিও আমরা দেখব ভবিষ্যতে। ভবিষ্যতের পরিবর্তন দরকার হলে সময় লাগবে, কিন্তু এখন রাস্তায় একটা সাধারণ অবস্থা ফিরিয়ে আনা যায় কীভাবে, সেটি নিশ্চয়ই সবার মনের জিজ্ঞাসা।

লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :