ব্যবসায়ীর কাছে দারোগার চাঁদা দাবির অডিও ফাঁস

রাজশাহী মহানগর পুলিশের বোয়ালিয়া মডেল থানায় কর্মরত সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) উত্তম কুমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার ও মামলার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সম্প্রতি মাহফুজুল আলম সুজন নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদা আদায় নিয়ে মোবাইল ফোনে তার কথোপকথন রেকর্ডের কয়েকটি অডিও ক্লিপ পেয়েছে ঢাকাটাইমস।
অডিও ক্লিপগুলোর কথোপকথন থেকে জানা যায়, সুজনের কাছে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন এএসআই উত্তম ।
যোগাযোগ করা হলে সুজন ঢাকাটাইমসকে জানান, দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে থেকে বছরখানেক আগে তিনি দেশে ফেরেন। এখন ঢাকায় ব্যবসা করছেন। গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে এএসআই উত্তমসহ দুজন ব্যক্তি সাদা পোশাকে পুলিশ পরিচয়ে তার বাসায় তল্লাশি চালান। কিছু না পেয়ে তাকে থানায় নিতে চান ‘ডিসি স্যারের নির্দেশ আছে’ বলে। পরে রাজন নামে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে ডেকে এনে রক্ষা পান সুজন।
তবে যাওয়ার সময় এএসআই উত্তম হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বলেন, ‘নিয়ে আসেন, আমি বিষয়টি মীমাংসা করে দেব। তা না হলে আটক করে মামলা দেয়া হবে। তখন ঝামেলায় পড়বেন।’
এরপর এএসআই উত্তমের সঙ্গে সুজনের মোবাইল ফোনে কয়েক দফা কথা হয়। কথোপকথনগুলো তুলে ধরা হলো-
সুজন: ভাই কেমন করে এইটা থেকে পার পাব? কিছু করলাম না, জানলাম না, শুনলাম না...।
-আমি যেমন ভালো, তেমনই খারাপ। গোটা থানা এলাকায় শুনে দেইখেন।
-আপনি লাস্ট পর্যন্ত কী বললেন বুঝলাম না। মানে আমার তো ম্যানেজ করতে হবে, তাই না?
-আপনারে সাক্ষাতে বলবোনি।
-সাক্ষাতে...কখন সাক্ষাৎ করব বলেন।
-বাইরে যেকোনো জায়গায় ডাইকেন, আমি চলে আসব।
এক দিন পর সুজন এএসআই উত্তমকে ফোন করে বলেন, ভাই, ভয় পাইতাসে, যাইতে দিতাসে না কোনো দিকে।
-জি?
-ওই ওয়াইফ। ভয় পাইতাছে। বলছে, যাওয়ার দরকার নাই কোনো দিকে। আপনি আসেন না...।
-আরে যাবনি, আমি একটু ডিসি স্যারের কাছে আছি। কালকে যাবনি।
-কালকে আসবেন...। কাল একটু ঢাকা যাইতাম...।
-দেখা করার কী দরকার আছে? যেটা বলছি, ওটা ইয়া করেন।
- দশ?
-না ভাই। বললাম না পাঁচ?
-আপনি তো পাঁচ আঙুল দেখাইলেন। এখন কিছু করলাম না, জানলাম না। কেমনে কী! পঞ্চাশ কি সম্ভব? এ তো অসম্ভব ব্যাপার।
-কিছুই না। মনে করলেই হবে। আমি আপনার সমন্ধে সবই জানি, বোঝেন নাই? ভাই আমি একটা কথা বলি, আমি এ টু জেড সব জানি।
-যদি জানেন, তাইলে কিন্তু অনেস্ট, আপনি অনেস্ট হইয়া কথা বলেন। আপনি সততা বজায় রাখেন। আপনি তো জানেনই আমি এসবের ভিতরে না।
-তাহলে আমার জায়গায় আমি।
-ভাই ওই আরেকটা জিনিস। নিচের মহিলাটা খুব জ্বালাইতাছে, বিরক্ত করতাছে। ভাই আপনেরা নাকি, সাজুর কাছেও (ওই নারীর ছেলে) ২০ চাইছেন? আর মোবাইল নাকি নিয়া চলে গেছেন।
-ওগোলা সব মিথ্যা। মহিলা খুব খারাপ। মোবাইল ধুইয়া পানি খাব নাকি? মহিলা তো খারাপ, বোঝেন নাই? ওর হাতে মোবাইল দিয়া আসলাম। আবার বলে যে...।
-আমি বললাম, আপনের ছেলে গেট খুলছে তাই মোবাইল নিয়ে চলে যাবে! আমারে বিরক্ত করতাছে ভাই।
-বেশি বিরক্ত করলে আপনি আমারে জানাবেন।
এর পরের কথোপকথনে সাজুর মাকে ২০ হাজার টাকা দিতে বলার জন্য সুজনকেই চাপ দেন এএসআই উত্তম।
সুজনকে উত্তম বলেন, ভাই আপনি ওকে বলবেন, আপনি কখন দিছেন? বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি ওর গোষ্ঠীসহ তুলে নিয়ে আসব, বোঝেন নাই? মহিলা তো আসলে বেয়াদব মহিলা। আচ্ছা বাদ দেন। আর আপনারে যেইটা বলছি, আমি স্যারকে ওইটাই বলছি।
-এইটা সম্ভব না তো। একটা সময় থাকে না মানুষের? এমনি জুলুমে পইড়া গেছি।
-আচ্ছা আপনের যেইটা ভালো হয়, আপনি আমারে জানাইয়েন। আর যদি আসতে বলেন, তাহলে আমি আসব। আচ্ছা কবে দেখা করবেন? একবারই দেখা কইরেন, হ্যাঁ?
-আচ্ছা চেষ্টা কইরা দেখি, কত কী করতে পারি।
-ঠিক আছে তাহলেই হবে।
এর পরদিন সুজন এএসআই উত্তমকে ফোন করেন।
-নমস্কার উত্তম দা। ওই ডিসি সাহেবের কথা বললেন তো, আমি বিশের মতো কালকে দিতে চাই আপনেরে। যেকোনো একটা ভাবে কইরা দিমু, হ্যাঁ?
-না ভাই, আমি তো স্যারকে চল্লিশের কথা বইলা আসছি, বোঝেন নাই?
-ওইটা সম্ভব! এখন সম্ভব না। ভাই, জুলুম হইয়া যায়।
-ভাই, আপনি আমার ভাই, বোঝেন নাই?
-শুধু শুধু একটা টাকা দিতে খুবই খারাপ লাগে, বোঝেন তো।
-তো আপনি বলতেন, শুধু শুধু দিব না। এইভাবে নিয়া যান।
-ভাই, আপনি আমার ভাই। সম্মান রক্ষা করার মালিক আল্লাহ। একবারের নাস্তার বিল আপনার।
-আপনি যেভাবে আল্লাহ বললেন, তাতে তো ঈমান আইসা পড়ে, সত্য কথা। ভালো লাগলো।
-হ্যাঁ। আপনার একবারের নাস্তার বিল। আমি তো সব জানি, বোঝেন নাই? ভাই সম্মান রাখার মালিক আল্লাহ। সম্মান গেলে সম্মান পাওয়া যায় না। একটা কথা বললাম।
-তাইলে কালকে বিকাল পর্যন্ত সময় দেন। আমি দেখি। সময় সব সময় এক রকম থাকে না।
-ঠিক আছে ভাই, সমস্যা নাই। আমি তো আপনার ভাই।
-আবার ডিসি সাহেবের কথা কইছেন তো, কী জড়ায় দিছেন!
-স্যারেক দেয়া লাগবে তো, ওই জন্য।’
এরপর সুজন নগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার দ্বারস্থ হন। আওয়ামী লীগের ওই নেতা তখন এএসআই উত্তমকে ডেকে বলে দেন, সুজনকে ‘বিরক্ত করা চলবে না।’ সুজন এ যাত্রায় রক্ষা পান।
ফোন করে এ বিষয়ে জানতে চাইলে এএসআই উত্তম কুমার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপরই তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
এ সময় আবার ফোন করে অডিও ক্লিপসের কথা জানালে উত্তম কুমার বলেন, ‘ভাই, আমি আপনার ছোট ভাই। একবার দেখা করেন। তা না হলে আমারে ডাকেন। আমি আসছি। এসব লিইখেন না।’
বোয়ালিয়া থানা এলাকাটি আরএমপির পশ্চিম জোনে। এ অঞ্চলের উপকমিশনার (ডিসি) এ কেএম নাহিদুল ইসলাম। উত্তম কুমার তার নামেই ব্যবসায়ী সুজনের কাছে চাঁদা দাবি করেছিলেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে ডিসি এ কে এম নাহিদুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এর সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমার নাম ভাঙিয়ে চাঁদা দাবি করে এএসআই উত্তম চাকরি হারানোর মতো অপরাধ করেছেন। ভুক্তভোগী আরএমপিতে লিখিত অভিযোগ দিলে উত্তমের চাকরি থাকবে না।’
এ বিষয়ে কথা বলতে আরএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলামের মোবাইলে কয়েকবার ফোন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি ধরেননি।
আরএমপির মুখপাত্র রাজপাড়া জোনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর। এ ধরনের অপরাধকে কখনোই প্রশ্রয় দেয়া হবে না। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।’
(ঢাকাটাইমস/২অক্টোবর/আরআর/জেবি/মোআ)

মন্তব্য করুন