জাপানে জনপ্রিয় হচ্ছে পিতা ও বন্ধু ভাড়ার ব্যবসা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক, ঢাকা টাইমস
 | প্রকাশিত : ১৯ জুন ২০১৯, ১০:২০

ইউচি ইশির গড়ন বেশ হালকা পাতলা। চোখ দুটো শান্ত। কিন্তু মুখে জমে আছে ক্লান্তি। অবাক হওয়ার কিছু নেই, মাত্র ৩৮ বছর বয়সে তার যতো ছেলেমেয়ে এই বয়সি আর কারও ঘরে অত সন্তান নেই। কিন্তু তাদের সঙ্গে তিনি দিনে চার ঘণ্টার মতো সময় কাটান, সপ্তাহে কয়েকবার এবং সেটাও নির্ভর করে তার মক্কেলদের চাহিদার উপর।

দশ বছর আগে ইশি ‘ফ্যামিলি রোমান্স’ নামে একটি কোম্পানি চালু করেছিলেন যারা ‘পরিবার ও বন্ধু’ ভাড়া দিতে শুরু করে।

বর্তমানে এই কোম্পানিতে কর্মীর সংখ্যা ২ হাজার ২০০। তাদের কাজ হলো যেসব পরিবার ভেঙ্গে গেছে সেসব পরিবারে পিতা, মাতা, ভাই বোন, কাজিন, চাচা মামা, খালা ফুপু, দাদা দাদী নানা নানীসহ বিভিন্ন আত্মীয়ের ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করা।শুরু হওয়ার পর থেকেই এই কোম্পানির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়তে থাকে। প্রচণ্ড জনপ্রিয় ওঠেন এর প্রতিষ্ঠাতা নিজেও।

ইশি জানান, তিনি এখন ২৫টি পরিবারে ৩৫ জন সন্তানের পিতা। কিন্তু তাদের একজনও তার নিজের পরিবারের নয়। ইউচি ইশির গড়ন বেশ হালকা পাতলা। চোখ দুটো শান্ত। কিন্তু মুখে জমে আছে ক্লান্তি।

যেভাবে শুরু

ইশি বলেন, এরকম একটি কোম্পানির ধারণা তার মাথায় এসেছিল ১৪ বছর আগে যখন তার একজন বান্ধবী তার সন্তানকে বেসরকারি একটি নার্সারিতে ভর্তি করানোর ইন্টারভিউর জন্যে তাকে ‘পিতা’ হিসেবে যেতে অনুরোধ করেছিলেন।

ভর্তির জন্যে নার্সারি কর্তৃপক্ষ বাবা মাসহ বাচ্চাটিরও সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিল। তার ওই বান্ধবী একজন সিঙ্গেল মাদার। অর্থাৎ ওই নারী একা একাই তার বাচ্চাকে বড় করছিলেন।

তখন ইশি তার বান্ধবীর সঙ্গে শিশুটির নার্সারিতে ভর্তির সাক্ষাৎকার দিতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘ওই সাক্ষাৎকার সফল হয়নি কারণ ওই বাচ্চাটি ও আমি নিজেদেরকে একটি পরিবারের মতো দেখাতে পারিনি। কিন্তু তখন আমার মনে হলো যে পরিবারের ভেতরে এরকম একটি চাহিদা থাকতে পারে।’

এই ধারণা থেকেই ফ্যামিলি রোমান্স কোম্পানির যাত্রা শুরু। তার কথায়, ‘আমি হয়তো নকল কেউ, কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমি সত্যি সত্যিই আপনার বন্ধু কিম্বা আত্মীয়ের মতো হয়ে যাচ্ছি।’

ভাড়ায় বন্ধু

ইশির যারা কাস্টমার তাদের চাহিদাও নানা রকমের। কেউ হয়তো চায় যে তার বন্ধু বা বান্ধবী তার পিতামাতার সঙ্গে দেখা করুক। কারণ তিনি হয়তো কোন কারণে তার আসল বন্ধুকে পিতামাতার কাছে নিয়ে যেতে পারছেন না।

তখন ইশির কোম্পানি থেকে তাকে একজন ‘বন্ধু’ ভাড়া দেওয়া হয়। সেটা করতে গিয়ে এমন একজনকে বাছাই করা হয় যার সঙ্গে কাস্টমারের উচ্চতা, চুলের রঙ, বয়স ইত্যাদির মিল আছে। আবার যারা খুব সহজে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে পারে না তাদেরকেও বন্ধু ভাড়া দেওয়া হয়।

তিনি জানান, ‘আমরা প্রকৃত বন্ধুর মতোই আচরণ করি। একসঙ্গে বাজারে যাই কেনাকাটা করতে। হাঁটতে যাই। আড্ডা দেই। অনেকে কোনো একটা পার্টিতে সঙ্গে যাওয়ার জন্যেও লোক ভাড়া নেয়। কখনো কখনো বৃদ্ধ বৃদ্ধারা চায় কন্যা কিম্বা পুত্রের মতো কাউকে। এমনকি নাতি নাতনিও ভাড়া নিতে চায়। তারা চায় এমন একটা পরিবার যে পরিবার তাদের একসময় ছিল কিম্বা কখনোই ছিলো না।’

সবচেয়ে জনপ্রিয় পিতার ভূমিকা

ইশি বলেন, যেসব ভূমিকায় সঙ্গ দেওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি চাহিদা সেটা হলো পিতার ভূমিকা। জাপানে প্রতি বছর দুই লাখ বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ফলে অনেক পরিবারেই আছে শুধু একজন। সেখানে পিতা কিম্বা মাতাকে একা একাই সন্তানকে বড় করতে হয়।

ইশি বলছেন, এসব পরিবার সমাজে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে এবং তার কোম্পানি এসব পরিবারের চাহিদা মেটাতে চেষ্টা করে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন যে এমন আদর্শ কোন মডেল নেই যা সব পরিবারের বেলাতে একইভাবে কাজ করবে।

তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ আছে তারা খুব নম্র ও ভদ্র ব্যক্তিকে পিতা হিসেবে চায়। কেউ কেউ পিতা হিসেবে চায় খুব কঠোর একজন মানুষ। আবার কেউ চায় সম্ভ্রান্ত কাউকে। কাস্টমারের চাহিদা অনুসারে আমরা তাদের পিতা সরবরাহ করতে পারি। যেমন ধরুন, কেউ যদি খুব কড়া একজন বাবা চান তাহলে আমরা কানসাই উচ্চারণে কথা বলেন এমন কাউকে পাঠাতে পারি। কারণ তাকে সাধারণ জাপানি ভাষাভাষীদের তুলনায় একটু কঠিন শোনাবে।’

কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা বলেন, এই কাজটা করতে গিয়ে যা তার কাছে সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে সেটা হলো পিতার ভূমিকা পালন করার পর ওই শিশুটিকে বিদায় বলে তার কাছ থেকে চলে আসা। ওই বাচ্চাকে বোঝানো খুব একটা সহজ কাজ নয়। একটা বাচ্চাকে কাঁদতে দেখা খুব কষ্টের।

কীভাবে করেন

ফ্যামিলি রোমান্স কোম্পানির কর্মীরা সর্বোচ্চ পাঁচটি পরিবারের সদস্য হয়ে কাজ করতে পারেন। কিন্তু ইশি যেহেতু নিজে এই কোম্পানি চালু করেছেন সেকারণে বর্তমানে তিনি ২৫টি পরিবারের সদস্য। মোট ৩৫ জন শিশু তাকে তাদের সত্যিকারের পিতা বলে মনে করে। এছাড়াও তাকে আরো ৬৯টি ভুয়া আত্মীয়ের সম্পর্ক চালিয়ে যেতে হয়।

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিনই একেকটা বাড়িতে যাওয়ার আগে আমাকে ওই পরিবারগুলোর সবশেষ তথ্য আপডেট করে নিতে হয়। প্রত্যেকটা পরিবারের নামে আমার কাছে একেকটা ফাইলে নানা রকমের তথ্য লেখা আছে। আছে একটা নোটবুকও। কখনো হয়তো আমি কারও ডাক নাম কিম্বা অন্য কোনো তথ্য ভুলে গেলাম। তখন আমি বাথরুমে গিয়ে একনজরে নোটবুকটা দেখে নেই।’

তিনি বলেন, ‘এসব কাজের মধ্যে আছে কোনো বাচ্চাকে সকালে স্কুলে নিয়ে যাওয়া কিম্বা বিকেলে কাউকে কোনো খেলা দেখতে নিয়ে যাওয়া এবং রাতে একসঙ্গে ডিনার করা।’

ইশি বলেন, তাকে প্রচুর কাজ করতে হয় এবং তার কোন ছুটিছাটা নেই। দিনে মাত্র তিন ঘণ্টার মতো ঘুমান তিনি।

কী কী সার্ভিস

ইশি নিজে বিয়ে করেননি এখনও। তার নিজের কোনো সন্তান সন্ততিও নেই। তিনি এসব চানও না। তিনি মনে করেন, যদি তার নিজের পরিবার হয় তাহলে তিনি হয়তো যে ২৫টি পরিবারের সদস্য হয়ে কাজ করছেন সেগুলোতে তার চাহিদা ঠিকমতো পালন করতে পারবেন না।

তার কথায়, ‘আমি নিজেই যদি বিয়ে করে ফেলি তাহলে তারা কী মনে করবে? কিম্বা আমার নিজের সন্তান থাকলে ওই পরিবারগুলোর বাচ্চাদের সঙ্গেও তো সব এলোমেলো হয়ে যেতে পারে।’

তবে তিনি বলেন, তার কর্মীরা ক্লায়েন্টদের পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও তার ব্যবসা পরিচালিত হয় পরস্পরের প্রতি সমঝোতা ও আস্থার ভিত্তিতে। উভয়পক্ষের মধ্যে যেসব সীমাবদ্ধতা আছে সেগুলোও তাদের মেনে চলতে হয়। যেমন তারা চুমু খেতে পারে না, যৌন সম্পর্ক করতে পারে না। হয়তো শুধু হাত ধরতে পারে।

এই কোম্পানি থেকে বর্তমানে ৩০ ধরনের সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে এবং প্রত্যেকটি সার্ভিসের জন্যে আছে আলাদা আলাদা গাইডলাইন ও নীতিমালা।

এই সেবার জন্যে একজন ক্লায়েন্টকে প্রতি চার ঘণ্টায় ১৮০ ডলার দিতে হয়। সঙ্গে আছে পরিবহন ভাড়া ও খাবার দাবার। একজন সিঙ্গেল মাদারের জন্যে এটা খুব একটা সস্তা নয়।

কঠিন সত্য

ফ্যামিলি রোমান্স কোম্পানির স্লোগান হচ্ছে: বাস্তবতা থেকেও সুখ বড়। তবে দীর্ঘ মেয়াদে বাস্তব সত্যটাও চেপে রাখা খুব কঠিন।

ইশি এমন একটা ঘটনার কথা বলছিলেন। তার ৩৫ জন সন্তানের মধ্যে আছে ২০ বছর বয়সী এক কন্যা যিনি সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করেন যে ইশিই তার আসল পিতা।

তিনি মনে করেন, বাবা মায়ের উচিত কোন এক সময়ে তাদের সন্তানের কাছে প্রকৃত সত্যটা খুলে বলা। ‘কিন্তু আমি তো আর এবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি না’।

তবে তিনি বলেন, যেসব সমাজে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে সমস্যা আছে সেখানে এধরনের সার্ভিসের চাহিদা আছে। জাপানি সংস্কৃতি অতিথিপরায়ণ। অন্যের মতামত ও মূল্যবোধকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে খারাপ দিকটা হলো যে আমরা নীতি নৈতিকতা নিয়ে বেশি চিন্তা করি এবং অন্যেরা কী মনে করবে সেটা নিয়েও উদ্বিগ্ন থাকি।

তিনি বলেন, আমরা যা হতে চাই তা হওয়া খুব কঠিন এবং সেটা খুলে বলাও আরও বেশি কঠিন। সমাজের যদি এরকম সার্ভিসের দরকার না হতো তাহলে সেটা ভাল হতো কিন্তু বাস্তবতা তো সেরকম নয়।

ঢাকা টাইমস/১৯জুন/একে

সংবাদটি শেয়ার করুন

আন্তর্জাতিক বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

আন্তর্জাতিক এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :