একজন খোকনের গল্প

ওবাইন
| আপডেট : ০৬ জুন ২০২০, ১২:০২ | প্রকাশিত : ০৫ জুন ২০২০, ১৬:১৮

রেজওয়ানুল ইসলাম খোকন। বয়স ২৬। বাড়ির সবচেয়ে আদরের ছোট ছেলে। খুব দুষ্ট আর বন্ধুদের নিয়ে মেতে থাকাটাই ছিল তার কাজ।তাই পড়াশোনায় খুব বেশি ভাল করতে পারেনি। এলাকারই একটি ডিগ্রি কলেজে সে ভর্তি হয়। বাজারে তাদের একটি কনফেকশনারির দোকান আছে। তার বড় ভাই ওই দোকানে বসতো। বড় ভাইয়ের অন্য কোন কাজ থাকলে খোকনই দোকানে বসতো। তবে খোকনের দোকানে বসতে ভাল লাগত না। সে এই দোকানের মধ্যে নিজের জীবনকে বাধতে চায় না, সে চায় এ পৃথিবীটাকে দেখতে।

আরেকজনের নাম রফিক। সে খোকনের প্রতিবেশী এবং খোকনের বাবার বয়সী। যেদিনই খোকন দোকানে বসে সেদিনই রফিক খোকনের দোকানে এসে তার ছেলের গল্প বলে। রফিকের ছেলে ইতালি থাকে। রফিক তার ছেলের কথা বলে আর খোকনের জন্য আফসোস করে। খোকনের মন খারাপ হয়।

এরকমই একদিন রফিক তার ছেলের ইতালিতে জীবন কেমন সুন্দর কাটছে তার বর্ণনা করতে করতে খোকনকে একটি লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে বসে। রফিক খোকনকে জিজ্ঞাসা করে সে ইতালি যেতে ইচ্ছুক কিনা? যদি খোকন ইতালি যেতে চায় তাহলে খুব সহজেই রফিক খোকনকে ইতালিতে নিয়ে যেতে পারবে। শুধু প্রয়োজন ৮ লক্ষ টাকা।

মাত্র ৮ লক্ষ টাকার জন্য খোকনের জীবন এই দোকানে বাধা পড়ে থাকবে! তা কী হয়? খোকন এবার ইতালির স্বপ্নে বিভোর হয়ে গেল। এই দেশকে তার আর সহ্য হয় না। মনে হয় তার শরীরটাই শুধু বাংলাদেশে আছে, তার মন প্রাণ ইতালিতে। কিন্তু বাধ সাধল তার বাবা, ভাই। তারা রাজি হলো না। খোকনের বাবা-ভাই হয়ে গেলো তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু। খোকন ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা করেছে, সে ইতালি যাবেই। শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তাই হলো। জিদের কাছে স্নেহের পরাজয় হলো। বাবা ব্যাংক থেকে ৮ লক্ষ টাকা লোন করলেন। রফিকের কাছে তুলে দিলেন ৮ লক্ষ টাকা আর তার কলিজার টুকরো ছেলেকে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। নতুন স্বপ্ন চোখে নিয়ে খোকন জীবনে প্রথমবারের মত চেপে বসলো উড়োজাহাজে। উড়োজাহাজ প্রথমে নামলো দুবাই। চকচকে দুবাই এয়ারপোর্ট দেখে আনন্দে আত্মহারা খোকন। জীবনে এতদিন সে কী করেছে? কোথায় থেকেছে? মা-বাবা-ভাইকে সে দুবাইয়ের সৌন্দর্যের গল্প বলে। গল্প শেষ হয় তার যখন ফিরতি উড়োজাহাজে উঠার সময় হয়। সে বিদায় নেয় তার পরিবারের কাছ থেকে। এবার তার গন্তব্য- ইতালি নয়। নতুন গন্তব্য লিবিয়া।

রফিক, খোকন এবং তার পরিবারকে বোঝায় ইতালির ভিসা পাওয়া যায় না। যেতে হয় লিবিয়া দিয়ে। লিবিয়া থেকে নৌপথে ইতালি। যেন ঢাকা থেকে বরিশাল। এমনকি রফিকের নিজের ছেলেও এইপথেই ইতালি গিয়েছে। রফিকের কথার তুবড়িতে নিমিষেই পৃথিবীর সকল বর্ডার সিস্টেম তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়লো। সিলেটের একটি গ্রামের সাধারণ কয়েকজন মানুষ রফিকের বাকপটুতার কাছে হিপনোটাইজড হয়ে গেলো।

এবার খোকন লিবিয়ায় নামলো। লিবিয়ায় নামার পরই খোকন বুঝতে পারলো সামনে ঘোর বিপদ। তাদের নিয়ে যাওয়া হলো একদম নির্জন এক জায়গায়। বন্দি করা হলো তাদের। সকল মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া হলো। কেড়ে নেওয়া হলো তাদের কাছে থাকা সকল মূল্যবান দ্রব্য। দালালরা মাঝে মাঝে পরিবারের সাথে খোকনকে কথা বলতে দিত।তারও একটি কারণ আছে। পরিবারের সাথে কথা বলিয়ে খোকন যে জীবিত আছে তার প্রমাণ দালাল চক্র পরিবারকে দিত এবং তার ভরণপোষণ বাবদ প্রতি সপ্তাহে ৫০০০ টাকা বাংলাদেশি দালাল রফিক খোকনের পরিবারের কাছ থেকে নিত। সপ্তাহে ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে খোকন পেত প্রতিদিন ১ বেলা খাবার আর পুরো সপ্তাহের জন্য ১ লিটার পানি। আর গোসলতো ছিল দিবাস্বপ্ন।

নিজের ছেলের এমন অবস্থা দেখে খোকনের বাবা মা রফিকের পায়ে পরে অনুরোধ করে, তার ছেলেকে ইতালি পাঠানোর প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে আসুক। কিন্তু রফিক বলে, এত সোজা কাজ নয় এটা। খোকনকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতেও ৮ লক্ষ টাকা প্রয়োজন। এর এক টাকা কমেও হবে না। এমন করতে করতে সময় চলে যায়। অসহায় বাবা মা বুঝে উঠে না কি করবে। হঠাৎ একদিন, খোকনের বাবার মোবাইলে একটি ভয়েস মেসেজ আসে, বাবা আমাদের সবাইকে রেডি হতে বলেছে। ইতালি নিয়ে যাবে মনে হয়। আমার জন্য দোয়া করো। সেদিন ছিলো ১১ই নভেম্বর।

পরেরদিন সকাল বেলায় বিভিন্ন পত্রিকায়, টেলিভিশনে খবর আসে ভূমধ্যসাগরে ইতালি যাওয়ার পথে ৩৬ জন বাংলাদেশীর মৃত্যু। খোকনের ভাই তার পরিবারে সবার আগে সংবাদটি পায়। কিন্তু সে বিশ্বাস করতে চায় না। সে তার বাবা মাকে জানায় না। কিন্তু কতক্ষণ? সবাই জেনে যায় ওই দুর্ঘটনার কথা। তারা সৃষ্টিকর্তার কাছে দোয়া করতে থাকে, মৃতদের তালিকায় যেন খোকনের নাম না থাকে। মা বাবার দোয়া তো আর ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মুছে দিতে পারে না।

এবার, খোকনের ভাই আর রফিককে ছাড়তে রাজি না। সে মামলা করে রফিকের বিরুদ্ধে। ভূক্তভোগী শুধু খোকন একা ছিলো না। খোকনের মতো ভাই হারা অনেকেই মামলা করেছেন, অনেকে করেননি। মোট ৭ টি মানবপাচার মামলা হয় রফিকের বিরুদ্ধে। রফিক পালিয়ে যায়।

মামলার অন্য অনেক আসামিই গ্রেপ্তার হয় কিন্তু প্রধান আসামী রফিককে পাওয়া যায় না। এরপর আমি চলে আসি ট্রেনিং এ। ৫ মাস ট্রেনিং করে সিলেটে ফেরত আসি। কিন্তু রফিককে আমি ভুলতে পারি নাই। আবার রফিকের খোঁজ শুরু করলাম। অবশেষে ১ বছর ১৫ দিন পর রফিককে গ্রেপ্তার করতে সমর্থ হই। আশা করবো, রফিক তার অপরাধের সর্বোচ্চ সাজাটুকু পাবে।

লেখক: সহকারী পুলিশ সুপার, বাংলাদেশ পুলিশ। (বর্তমানে র্যা ব-৯ এ কর্মরত)

সংবাদটি শেয়ার করুন

নির্বাচিত খবর বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচিত খবর এর সর্বশেষ

ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করছেন মাদ্রাসায় পড়ুয়া মাজিদুল হক

মুন্সীগঞ্জে ১০ কোটি টাকার পানি শোধনাগার কাজেই আসছে না

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে সৌর বিদ্যুৎ দিচ্ছে ‘সোলার ইলেক্ট্রো’

শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণাসহ ৯ দাবি বাস্তবায়ন চায় শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ

শিশু নির্যাতন: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বুলিং র‌্যাগিং প্রতিরোধ নীতিমালা বাস্তবায়নের আহ্বান

শহরের ব্যস্তজীবনে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ড. রাশেদা রওনকের আলোচনায় আমন্ত্রণ

২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের করোনা শনাক্ত

২৪ ঘণ্টায় ৯ জনের করোনা শনাক্ত

২৪ ঘণ্টায় ১৩ জনের করোনা শনাক্ত

দা‌ড়ি-গোঁফ গজাচ্ছে জান্না‌তির মুখে, প‌রিবর্তন হয়েছে কণ্ঠস্বর

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :