মনে হয় বাবা যেন ডাকছে আমায়...

সুমনা রায়
 | প্রকাশিত : ১৭ জুন ২০২০, ২০:৫১

এখনো যেন সেই ডাক শুনতে পাই...শুনতে পাই গেট খুলে বাড়িতে ঢোকার শব্দ। মাঝে মাঝেই মনের ভুলে মোবাইল কি-প্যাডে আঙ্গুল রাখি কল করব ভেবে আর মুহূর্তেই বুঝে যাই এখন তোমার সাথে কথা বলতে আর তো মোবাইলের দরকার নেই।তুমি আছো তুমি ছিলে তুমি থাকবে জানি তবু ও একটা নাই নাই হাহাকার মাঝে মাঝেই ভেতরে গুমড়ে ওঠে – তোমার আশিস মাথায় আছে জানি তবু কাছে না পাওয়ার কষ্টটা থেকে থেকেই ব্যথা হয়ে ওঠে।

সব কিছু থাকার পর ও সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায় একটা শূণ্যতা। কত কথা কত স্মৃতি মনে পড়ে - টুকরো কিছু কথা টুকরো কিছু স্মৃতির পথ ধরে বারবারই ফিরে যাই ফেলে আসা দিনে। বাবা-মেয়ের এমনি দু-একটা কথা আজ বলতে খুব মন চাইছে।

আজকের দিনের মত ইন্টারনেট তখন এত পরিচিত ও ছিলনা, ছিলনা এত সহজলভ্যও, বিশেষ করে আমাদের জন্যে। তাই কিছু দরকার হলেই হেল্প লাইন – বাবা। মা চাকরির পর ও ঘরের কাজসহ নানা কাজে এত ব্যস্ত থাকতেন যে সব সময় মাকে জিজ্ঞেস করার সাহস হত না। এই হেল্প লাইন নিয়ে বলতে গিয়ে খুব বেশি করে মনে পড়ছে একটি দিনের কথা। দিনটা ছিল চার সেপ্টেম্বর - আমি তখন সবে দিল্লি পাবলিক স্কুলে শিক্ষকতায় জয়েন করেছি। স্কুল ছুটির ঠিক এক ঘণ্টা আগেই হল বিনা মেঘে বজ্রপাত – প্রিন্সিপাল স্যারের ডাক পড়ল। পরের দিন শিক্ষকদিবসে আমাকে বলতে হবে।

সত্যি বলতে কী আমার দু-চার লাইনের বেশি বলার মত কিছুই মনে আসছিলনা। সহজ সমাধান মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে কল করে ফেললাম। বাবা না থেমে প্রায় মিনিট কুড়ি বলে গেলেন আর তাই দিয়ে পরের দিন যাহোক করে মান রক্ষে হল। খুব পড়াশুনো করতেন বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল অথচ বাবাকে খুব কমই দেখেছি মঞ্চে বক্তব্য রাখতে। বরং মঞ্চের পেছনে আড়ালে থেকে মঞ্চকে ভরিয়ে রেখেছেন নানা অনুষ্ঠানে। এই শিক্ষক দিবসে এক শিক্ষকের ওপরই শুধু নয়, সব শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা আর ও বেড়ে গেল। এমন ঘটনা অনেক হয়েছে সব মনে করে আজ বলা ও যাবেনা। সেইসব দিনে আমার বাবাই ছিলেন আমার গুগল, আমার উইকিপিডিয়া।

তখন আমি হয়তো ক্লাশ থ্রিতে পড়ি। বাবার সঙ্গে প্রায় সব অনুষ্ঠানেই যেতাম – সেইদিন ও রিকশা করে যাচ্ছিলাম সুকান্ত জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে শ্রীভূমি স্কুলে । যাওয়ার পথে হাল্কা বৃষ্টি।ধর্মপুর স্কুলের সামনে পৌঁছুতেই বৃষ্টি আরও বেড়ে গেল। ওই স্কুলে তখন নতুন ক্লাশ ঘরের কাজ হচ্ছে। বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বলতো ঘরের একটা দেওয়ালে যদি চারটে পিলার দিতে হয় তবে একটা ঘরে মোট কটা পিলার লাগবে?

প্রশ্ন শোনামাত্র মুহূর্ত বিলম্ব না করেই বলে দিলাম চার চারে ষোল। বাবা একটু হেসে বললেন যাও দেখে এসো। ততোক্ষণে বৃষ্টি আমাদের তিনজনকেই নামিয়ে দিয়েছে স্কুলের বারান্দায়। আমি সত্যি গুনে এলাম আর বুঝতে পারলাম নিজের ভুলটা। ভবিষ্যতে অংক নিয়ে পড়ার পেছনে সেই দিনের সেই হাতে কলমে অংক শেখার অনেক বড় ভূমিকা আছে – আমার আজও এই বিশ্বাস। বাবা হয়ত আমাদের নিয়ে ঘটা করে পড়াতে বসতেন না কিন্তু অনেক কিছুই এভাবেই শেখাতেন বোঝাতেন জানাতেন না পড়ানোর ভানে।

বাবার শাসন আর সোহাগ দুইই ছিল মাত্রার মধ্যে। কোনোটাই জোর করে বুঝিয়ে দেবার মত বাড়াবাড়িতে ছিল না।

একবার দুর্গাপুজোর কদিন আগে আমি আর বাবা পার্ক স্ট্রীট গেলাম প্যান্ট কিনতে। আমি একটা কার্গো কিনলাম।বাড়ি ঢুকেই বাবা মাকে বললেন ও তো যাওয়ার আগে বলছিল প্যান্ট কিনবে কিন্তু গিয়ে কিনে নিল গুচ্ছের পকেট, যাক অনেক খুঁজে পেতে একটু প্যান্ট ও পেয়েছে হয়তো এতে।এমন কম কথায় রসবোধের পরিচয় হয়ত খুব কম লোকই দিতে পারেন।

শুধু সংস্কৃতিই ভালোবাসতেন তাই নয়, খেলা ধুলায় ও যথেষ্ট উৎসাহ ছিল। ওনার শিলং জীবনে ভাল ব্যাডমিনটন খেলতেন বলে জেনেছি, ফটো দেখেছি কিন্তু সেভাবে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে আমাদের সঙ্গে খেলতেন আমাদেরই বাড়ির সামনের মাঠে। পোলো মাঠের ও সাক্ষী হতেন মাঝে মাঝেই দর্শক হয়ে শুনেছি শিলংয়ে আমাদের এক জেঠিমার কাছে। আমাদের খুব ছোটবেলাতেই বাবা নিজেই আমাদের সাঁতার শিখিয়েছেন, সাত আট বছর বয়সেই দাবা খেলাটা ও শিখিয়েছেন, কতটা শিখতে পেরেছি তা অবশ্য আলাদা কথা। মনে আছে বালির ওপর শতরঞ্জি বিছিয়ে আমাদের শেখাতেন ডিগবাজি খাওয়া আসন করা আর শেখাতেন মেডিটেশন ও, নিজে ও করতেন আমাদের সাথে আমাদেরই বন্ধু হয়ে। আমরা খুশি হতাম দুষ্টুমিতে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে আর উনি হয়ত হাসতেন মনে মনে। সাইকেল চালানোতেও বাবারই উৎসাহ পেয়েছি সবচেয়ে বেশী। আর যখন কখনও কোথাও ব্যথা পেয়ে ঘরে আসতাম বাবার দিকে তাকালে মনে হতো ব্যথাটা আসলে বাবাই পেয়েছেন।

আমাদের ছোটবেলায় বাবার স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রীরা নতুন ক্লাশে উঠে বা বোর্ড এক্সামে পাশ করে বাবাকে এসে প্রণাম করে যেত। আমাদের সঙ্গেও ওদের পরিচয় করিয়ে দিতেন বাবা। আমরা জানতাম এরা সবাই স্কলারশিপ পেয়েছে আর সেই টাকাতেই পড়েছে। মনে প্রশ্ন আসতো বাবার স্কুলে এত ছাত্রছাত্রীরা স্কলারশিপ পায় তাহলে তো বাবার স্কুলে পড়লেই ভাল হতো। একটু বড় হয়ে মানে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একটু বেশি সাহসি হয়ে ঘরে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম যে বাবার স্কুলের এত ছাত্রছাত্রীরা সত্যিই স্কলারশিপ পেত? মা রান্নায় একটু বাড়তি মনোযোগ দিয়ে কথাটা এড়িয়ে গেলেন কিন্তু পেছনে বাবা কখন এসে পড়েছিলেন বুঝতেই পারিনি, উত্তরে বুঝলাম – উত্তর ছিল হ্যাঁ ওরা পেয়েছে, কে দিয়েছে কেন দিয়েছে এটাই বড় কথা নয়–ওদের এতে পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়াটা কিছুটা সহজ হয়েছে এটাই কি আনন্দের কথা নয়! এই অল্প কথাতেই অনেক কিছু বুঝতে পেরে শ্রদ্ধায় গর্বে ভিজে উঠেছিল চোখের পাতা আর তাই নীরব পায়ে চলে যাই নিজের পড়ার ঘরে। আমরা যেমন জানতে পারিনি বহুদিন এই স্কলারশিপের কথা তেমনি যারা পেত তারা কখনও জানতে পারেনি। নীরবে শুধু ভালো করে যেতে চেয়েছেন, পাব্লিসিটি নয়।

আমাদের বাড়িটা প্রায় সারা বছরই উৎসবের মেজাজে কচিকাঁচাদের কোলাহলে মেতে থাকতো। আজ যদি রবীন্দ্র জয়ন্তীর রিহার্সাল তবে কাল নজরুল জয়ন্তীর কিংবা সপ্তাহব্যাপী কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের – সারা উঠোন আর ঘর জুড়ে ছোট বড়দের পায়ের ছন্দ আর বাতাস জুড়ে স্বরলিপি।

লেখক: কবি, মুম্বাই, ভারত থেকে

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :