‘স্থিতিশীল সামষ্টিক অর্থনীতির স্বার্থে সরকারকে ভারসাম্যমূলক নীতি-উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে’: ড. আতিউর রহমান
ড. আতিউর রহমান। বাংলাদেশের খ্যাতনামা একজন অর্থনীতিবিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস প্রফেসর। বাংলাদেশ রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের নির্বাহী সভাপতি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজ-এর সিনিয়র ফেলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক। দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক পদে। অর্থনীতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে লেখার কারণে তিনি পাঠক মহলে সুবিদিত। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই তার লেখা শধাধিক গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে; রয়েছে রবীন্দ্রনাথ, বঙ্গবন্ধু, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও বিভিন্ন পাঠকপ্রিয় গ্রন্থ। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও রবীন্দ্র পুরস্কার ছাড়াও দেশ-বিদেশের অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত গরিবের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত এই কীর্তিমান অধ্যাপক-গবেষক-লেখকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দৈনিক ঢাকা টাইমস্-এর এসিস্টেন্ট এডিটর আলী হাসান। এখানে তিনি দেশের অর্থনীতি ও বর্তমান সরকার, সমাজ সংস্কার, আগামী বাজেট, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাঙালির সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন।
আলী হাসান: টানা চতুর্থ মেয়াদের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বিগত তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার উন্নয়নের যে স্বাক্ষর রেখেছে এবার চতুর্থ মেয়াদে এসেও তারা এর ধারাবাহিকতা কতটুকু রক্ষা করতে পারবে বলে আপনি মনে করেন? এছাড়া নতুন কী কী উন্নয়ন উদ্যোগ এই সরকার সংযুক্ত করবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আতিউর রহমান: আওয়ামী লীগকে এর আগে গত তিনবার টানা ক্ষমতায় থেকে অনেক আবর্জনা প্রথমে দূর করতে হয়েছিল। তারপর নতুন করে তারা উন্নয়নের জন্য কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে অর্থনীতিকে তারা আরো অনেক বেশি করে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার চেষ্টা করেছে এবং আমি বলবো এজন্য তারা তাদের সুফলটাও পেয়েছে। আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতি গত তিন টার্মে ইতিবাচক ছিল। কোভিডকালেও সারা পৃথিবীতে যে চার-পাঁচটা দেশের প্রবৃদ্ধির হার ইতিবাচক ছিল তার মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। বাংলাদেশে এ সময় ৪ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধির হার ছিল। বিশ্বের সকলেই তখন বাংলাদেশের এই অর্জনের প্রশংসা করেছে। কিন্তু এটা কিছুটা উলট-পালট হয়ে গেল কোভিড শেষ হওয়ার পর; যখন নতুন করে আবার অর্থনীতি দৌড়াতে শুরু করলো। হঠাৎ খুলে যাওয়া অর্থনীতির ব্যাপক চাহিদা মেটাতে অনেক বেশি আমদানি করতে হলো। বিভিন্ন ধরনের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য বেশি করে আমদানি করতে হলো। একইসঙ্গে এই সময়ে সবকিছুর দামও বেড়ে গেল কিন্তু সরবরাহ চেইন তখনও বিপর্যস্ত। তাই চাহিদার সাথে সরবরাহ তখন মেলাতে পারছিল না। আর সে কারণেই দাম বেড়ে গেল। এ সময় পৃথিবীব্যাপী সবকিছুর চাহিদা বেড়ে গেল- বিশেষ করে সার, জ্বালানি তেল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর দাম বেড়ে গেল। সেটার প্রভাব আমাদের অর্থনীতির উপর পড়েছে। এক্সপোর্ট এবং রেমিটেন্স সেই অর্থে বাড়ছিল না তখন। সেই কারণে একটি গ্যাপ তৈরি হলো, একটি বড়ো মাপের বাণিজ্যিক ঘাটতি তৈরি হলো। এর মধ্যে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। অনাকাঙ্ক্ষিত এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সরবরাহের চেইনের চাপ আরো বাড়তে থাকলো।
সাপ্লাই চেইনটি বিপর্যস্ত হয়ে যাবার কারণে এ সময় জাহাজ পাওয়া যাচ্ছিল না; আর কিছু জাহাজ পাওয়া গেলেও তার ভাড়া ছিল অনেক বেশি। আর জাহাজগুলো নিরাপত্তার কারণে সে সময় যাতায়াতই করতেই পারছিল না। বিমা খরচও ছিল বেশি। পাশাপাশি জ¦ালানি তেলের দাম বেড়ে গেল। এর ওপরে হঠাৎ করে ভূ-রাজনৈতিক সংকট দেখা দিল। মূলত ইউরোপের ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে ইউক্রেন থেকে আমরা যে সমস্ত পণ্য কিনতাম কিংবা রাশিয়া অথবা বেলারুশ থেকে আমরা যে সমস্ত পণ্য কিনতাম- বিশেষ করে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য- যেমন: গম, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন রকমের খাদ্য; এগুলো তখন পাওয়া যাচ্ছিল না। এতে করে সামষ্টিক অর্থনীতিতে খুব বড়ো একটি চোট লাগে। এর প্রভাবে আমরা দুটো জিনিস ঘটতে দেখলাম। একটা হলো- টাকা ও ডলারের যে বিনিময় হার, সেটার ভারসাম্যটা ধরে রাখা গেল না। এ সময় টাকার মান অবমূল্যায়িত হলো; তা না হলে রিজার্ভ ধরে রাখা যাচ্ছিল না। এ সময় ইমপোর্ট কমাতে হলো। দুইভাবে ইমপোর্ট কমানো যায়। একটা হলো প্রশাসনিক অর্ডার দিয়ে- অন্যটি এলসির মার্জিন দিয়ে; কিংবা কোনো বিলাস পণ্য আমদানি করবো না- এরকম নিয়ন্ত্রণ করেও করা যায়; এসবই করেছি আমরা।
একটা সময় সেটাও যথেষ্ট ছিল না; তখন আমরা ইমপোর্ট কস্টটা বাড়িয়ে দিলাম- কিন্তু টাকার দাম কমিয়ে দেওয়া মানে- ১০০ টাকায় যে পণ্য কেনা যেত আগে এখন তা বিদেশে থেকে কিনতে হচ্ছে ১৩০ টাকায়। নিয়ম হলো কোনো পণ্যের দাম বাড়লে পরে তখন আমদানিটা কমবে। অর্থনীতির নিয়মে এরকমই করতে হয়- বাংলাদেশও তাই করেছে। এতে কী হয়েছে- দুটো ঘটনা ঘটেছে; একটা হলো বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। বিলাসপণ্য কমে গেছে এটা ভালো কথা কিন্তু পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দামও বেড়ে গেছে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অঙ্কে সবকিছুর দাম বেড়ে গেল। এটার কারণে মানুষের বিশেষ করে ছোটো ছোটো যারা উদ্যোক্তা- তারা সহজেই ডলারে আর আমদানি করতে পারছিল না; টাকাও জোগাড় করতে পারছিল না; এবং সবচেয়ে বড়ো কথা ডলারের এক্সচেঞ্জ রেটটা খুব দ্রুত স্থিতিশীল করতে পারছিলাম না আমরা; সঙ্গে সঙ্গে যদি বিনিময় হারটা বাজারের সমান-সমান করে ফেলা যেত তখন- তাহলে সাধারণ লোকজন আশঙ্কা করতো না যে- সামনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আরো বাড়বে, ডলারের দাম আরো বাড়বে।
দেখা গেল মানুষের মনে এক ধরনের ভীতি এসে গেল। তারা ভাবতে শুরু করলেন যে- বোধহয় ডলারের দাম আরো বাড়বে। তখন ডলারের চাহিদা গেল আরো বেড়ে। যেখানে চাহিদা আমরা আরো কমাতে চাচ্ছি, সেখানে ডলারের চাহিদা আরো বেড়ে গেল। চাহিদা বেড়ে যাওয়ার ফলে যেটা হলো- বিদেশ থেকে যারা বিশেষভাবে রেমিটেন্স পাঠায়; তারা আনুষ্ঠানিক পথে তা না পাঠিয়ে তখন বিকল্প হিসেবে অনানুষ্ঠানিক পথে পাঠাতে শুরু করলো। আনুষ্ঠানিক পথে যে একটা রেট বেঁধে দেওয়া হলো- বাজারে গিয়ে দেখা গেল, ওই রেটে ডলার পাওয়া যায় না। পাশেই দেখা গেল অনানুষ্ঠানিকভাবে হুন্ডির মাধ্যমে আরেকজন দশ টাকা বেশি দিচ্ছে; তখন মধ্যবিত্ত এমনকি উচ্চবিত্তরাও দেখলো যে- তারা ডলার প্রতি দশ টাকা কেন কম নেবে? এজন্য বেশিরভাগই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেন শুরু করলো। এই তফাৎটা কিন্তু এখনো অতটা না হলেও কিছুটা রয়ে গেছে। এজন্য আনুষ্ঠানিক পথে যত বেশি ডলার আসার কথা ছিল সেটা আসেনি। ইদানীংকালে কিছুটা বেড়েছে- এই সময়ে দেখা যাচ্ছে ডলারের প্রবাহ অনেকটাই বেড়েছে। এখন যখন ডলারের প্রবাহ বাড়তে শুরু করেছে তখন ব্যাংকগুলো প্রবাসীর কাছ থেকে যে ডলার কেনে সেটার রেট তারা কমাতে শুরু করেছে। আগে যেমন ১২২/১২৩ টাকার নিচে ডলার কিনতো না; এখন ১১৫/১১৬ টাকায়ও তারা ডলার কিনছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যদি চলতে থাকে তাহলে একটা জায়গায় এসে ডলারের মূল্য স্থিতিশীল হতে থাকবে। কিন্তু স্পেকুলেশনের কারণে রপ্তানিতে যে আয়টা হতো, সেটা আবার পুরোটা দেশে তারা আনতো না। মনে করতো যে- দুদিন পরে আনলে তো অপেক্ষাকৃত আরও একটু বেশি টাকা পাবে। সে কারণেও দশ/বারো শতাংশের মতো রপ্তানি আয় তখন দেশে আসেনি। এখনো এই পরিস্থিতির বড়ো ধরনের পরিবর্তন হয়নি। এগুলোর কারণে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে একটা ইমব্যালান্স তৈরি হয়ে গেছে। এটাকে ব্যালান্স অফ পেমেন্টের সমস্যা বলা চলে। ইমব্যালান্সটা এমনভাবে তৈরি হলো যে- আর্থিক হিসাব সেখানে গিয়ে প্রভাব ফেলতে শুরু করলো। আর্থিক হিসাব সাধারণত ডেফিসিট হলে পরে ঐ টাকাটা রিজার্ভ থেকে সমন্বয় করতে হয়। সেটাই করতে হয়েছে আমাদেরকে। সেজন্য রিজার্ভও কমে গেছে। আর রিজার্ভ যখন কমে যায় তখন আশঙ্কা আরো বাড়ে। এই কারণে একটা অস্থিতিশীলতা ছিল তখন। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ করছি যে- বিদেশ থেকেও আমরা পর্যাপ্ত ঋণ পাচ্ছি। আমাদের এক্সপোর্ট বাড়ছে, আমাদের রেমিটেন্সও বাড়তে শুরু করেছে। সবকিছু মিলে আমরা একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকেই অগ্রসর হচ্ছি বলেই আমার ধারণা। কিন্তু একটা অসুবিধা হলো- এই বিষয়টার মধ্যে বাধ সেধেছে মূল্যস্ফীতি।
আমাদের বিদেশ থেকে বেশি দামে জিনিসপত্র কেনার কারণেও দেশের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বড়ো আকারে কমানো যাচ্ছে না। অর্থাৎ বিদেশে থেকে আমরা যে জিনিসপত্র আমদানি করছি সেখানে যদি ৩০% দাম বেড়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমাদের দেশে যে সমস্ত জিনিস উৎপাদন করছে সেগুলোর দামও কিন্তু বেড়ে যায়। এই আমদানিকৃত বিদেশি পণ্যের সঙ্গে দেশেও উৎপাদিত পণ্যের একটা সম্পর্ক আছে। তাই এসব পণ্যের কাঁচামালের বড়ো অংশও বিদেশ থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। ডলার সংকটে কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যের সরবরাহও সংকোচিত হয়ে গেছে। অনানুষ্ঠানিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনে এসব পণ্য আমদানি করা গেলেও এসময়ের দামও বেড়ে গেছে। সে জন্য ভোগ্যপণ্য- বিশেষ করে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেল। সে জন্য সরকারকে যেহেতু এগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করে আনতে হয়- বিশেষ করে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ। আমরা এখন বিদ্যুৎও আমদানি করি আর জ্বালানি তেল দিয়েও অনেক সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। সুতরাং জ্বালানি তেলের দামটাও বাজারে বৃদ্ধি করার চেষ্টা করা হয় কখনো। সরকার হয়তো এই সময়ে বিদ্যুতের দামটা বাড়িয়ে দিলো। বিদ্যুতের দাম বাড়লে পরে যেটা হয় সেটা হলো- মুদ্রাস্ফীতির উপর প্রভাব ফেলে- আবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহণের খরচও বেড়ে যায়। সেটা আবার পণ্যমূল্যের উপরও প্রভাব ফেলে। এ কারণে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাচ্ছিল না। এখনো বেশি কমানো গেছে তা বলা যাবে না। এখনো পর্যন্ত ৯.৬% মুদ্রাস্ফীতি রয়েই গেছে। এটাই আমার কাছে মনে হচ্ছে যে- সরকারের অনেক সাফল্য ম্লান করে দিচ্ছে। কারণ মুদ্রাস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনকে এফেক্ট করে। মানুষের দারিদ্র্য বাড়ায়। যে টাকা দিয়ে মানুষ খেতে-পরতে পারতো, এখন আর ওই টাকা দিয়ে তারা ওই রকমভাবে খেতে-পরতে পারছিল না। তাই ভোগ কমিয়ে ফেলছেন।
আরেকটা কথা- জিনিসপত্রের দাম বাড়লে ফ্যাক্টরিগুলো আর আগের মতো পুরোপুরি পরিচালনা করা যায় না। তখন দেখা যায় কর্মসংস্থান না বাড়িয়ে এ সময় বরং তা কমানোর আশঙ্কা দেখা দেয়। যেটা হয়তো ঘটেছে। তবে সব মিলিয়ে মূল্যস্ফীতিটা এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে বড়ো সমস্যা ও সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধুমাত্র যে বিনিময় হার বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতিটা বেড়েছে তাও নয়- মূল্যস্ফীতি বাড়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে যথোপযুক্ত মুদ্রানীতি গ্রহণে দ্বিধা। আমরা একটা সময় সুদের হার বেঁধে দিয়েছিলাম। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে, যেকোনো ঋণ প্রদানে ৯ শতাংশের বেশি আমরা চার্জ করবো না। অথচ তথন মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল ১০/১১ পার্সেন্ট। তখন বলতে গেলে আমরা প্রায় বিনা পয়সায় লোন দিচ্ছিলাম। প্রকৃত রেট অফ ইন্টারেস্ট মাইনাস টু হয়ে গিয়েছিল বা সমান সমান হয়ে গিয়েছিল। তো ন্যাচারালি বিনা পয়সায় যারা লোনগুলো নিয়েছে, সকলেই তো আর নিতে পারেনি- যারা নিতে সমর্থ হয়েছে তারা আবার সঠিক জায়গায় সেটা খরচ করেনি। যদি দাম দিয়ে সেটা কিনতো তাহলে হয়তো কোনো একটা প্রোডাক্টিভ খাতে সেটা তারা ব্যয় করতো। দেখা গেছে যেখানে-সেখানে ব্যয় করেছে সেই টাকা। যে কারণে মূলত দুটো ঘটনা ঘটেছে। এক- উৎপাদন যথেষ্ট বাড়েনি; সেটা আবার মুদ্রাস্ফীতির উপর ইম্প্যাক্ট হয়। দুই নম্বর হলো- মানুষের হাতে প্রচুর টাকা গেছে, যে টাকা তারা খরচ করেননি- মানে প্রোডাক্টিভ খাতে খরচ করেননি; আনপ্রোডাক্টিভ খাতে খরচ করেছেন। তো আনপ্রোডাক্টিভ খাতে খরচ করলে পরে টাকাগুলো আসলে মুদ্রাস্ফীতিকে আরও ইনফ্লিউশনারি করে দেয়। দ্বিতীয়ত হলো- কিছু টাকা চলেও গেছে, পাচার হয়ে গেছে- যেটা খরচ করেনি। এগুলো ঠেকাতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আবার বাণিজ্যিক অর্থায়নে কড়াকড়ি করেছে। বিশেষ করে ইমপোর্ট-এর ক্ষেত্রে। পণ্য যে দামে আসার কথা সে দামে পণ্য আসছে কি না সেটা দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কড়াকড়ি করেছে। অস্বাভাবিক কিছু আসছে কি না সেটা দেখার জন্য। কিন্তু এই কড়াকড়ির ফলে যেটা হয়েছে- আগের চেয়ে পণ্য আমদানি আরও কম হয়েছে। সেটা আমরাও চেয়েছিলাম পণ্য আমদানি কম আসুক। কিন্তু এটা আবার সাপ্লাই সাইডে সমস্যা তৈরি করছে। যেহেতু উৎপাদন ও আমদানিকৃত পণ্য কম আসছে তাই সরবরাহ কম হচ্ছে। যেমন: গরুর খাবার, ওষুধপত্র, মুরগির খামারের ফিড- এগুলো আর আগের দামে পাওয়া যাচ্ছে না। তো আগের মতো না পেলে ছোট্ট যে খামারের মালিক সে তো আর আগের মতো পণ্য উৎপাদন করতে পারবেন না। এ অবস্থায় পণ্য উৎপাদন আবার কমে গেল। পণ্য উৎপাদন কমে গেলে বাজারে একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। আবার অন্যদিকে বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ করা না গেলে পণ্যের দামও কমবে না। মূল্যস্ফীতিটা একটা জায়গায় গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কমলেও তার গতি খুবই ধীর। নানা সাফল্য থাকার সত্ত্বেও এই মূল্যস্ফীতি সরকারকে বেশ বিড়ম্বনায় ফেলে দিয়েছে। সরকারকে এই জায়গাটাতে এখন বেশি করে নজর দিতে হবে। সরকার কিন্তু এই বছরই অর্থাৎ ২০২৪ সালে ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার যে হার ওইটি উঠিয়ে দিয়েছে। এতে ডিপোজিট কম-বেশি করা যায়- এতে করে কিছুটা ভালো প্রভাব পড়েছে। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা হলেও কমছে। কিন্তু কমার হারটা খুব ধীরে। কারণ শুধুমাত্র রেট অব ইন্টারেস্ট দিয়ে তো মুদ্রাস্ফীতি কমানো যায় না। এটা কমাতে হলে আমাদের টাকার মানটাকে আবার স্থিতিশীল করতে হবে। এর সাথে অন্যান্য যে রাজস্ব ব্যয় আছে যেমন: রাস্তাঘাট নির্মাণ, বিভিন্ন প্রকল্প ব্যয়- ওইটাও কমাতে হবে। এখন একটা টাকা যখন আমি খরচ করি তার একটা অংশ কিন্তু আমরা ফরেন এক্সচেঞ্জেও খরচ করি। তাই ফরেন এক্সচেঞ্জে খরচ কমাতে হলে আমাদের সরকারি এক্সপেন্ডিচারও কমাতে হবে। চলতি বছরের বাজেটে আমার ধারণা সেটা সরকার করবে। এক্সপেন্ডিচার অনেকটাই কমাবে বাজেট ডেফিসিট কমানোর জন্য। তো সব মিলিয়ে প্রবৃদ্ধি তাহলে আবার কমবে এবং মুদ্রাস্ফীতির জন্য এটা উপকারই হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে- এসবের ইম্প্যাক্টটা সঙ্গে সঙ্গে হয় না; একটু সময় লাগে। হয়তো মুদ্রাস্ফীতি আমাদের আরও কিছুদিন পীড়া দিতেই থাকবে।
আলী হাসান: বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে কীভাবে মুদ্রাস্ফীতিটা স্বাভাবিক করা যায় বলে আপনি মনে করেন?
ড. আতিউর রহমান: আমি মনে করি- চতুর্থ মেয়াদের এই নতুন সরকারের জন্য কষ্টের বিষয় হবে মুদ্রাস্ফীতি আরও দ্রুত কীভাবে কমিয়ে আনা যায়, সেটা। একটি উপায়ে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যায়- সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক চেষ্টাও করছে। সেটা হলো- মানি সাপ্লাই কমিয়ে ফেলা। সেটা কমানোর জন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। এখন আর আগের মতো সরকারকে অত বেশি ধার দিচ্ছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে টাকা ধার দিলে যেটা করতে হয় সেটা হলো নতুন টাকা প্রিন্ট করতে হয়। সেই টাকা তখন বাজারে দৌড়াতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটা কমিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটা একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। এখন সরকারকে টাকা নিতে হলে সাধারণ ব্যাংকগুলো থেকে নিতে হয়, সেন্ট্রাল ব্যাংক থেকে নিতে হয় না। ওটা একটা ভালো উপায় হয়েছে। তা সত্ত্বেও যে টাকা আগেই ঢুকে গেছে বাজারে, সেই টাকা তো দৌড়াদৌড়ি করছে। আরেকটা হলো- হুন্ডির মাধ্যমে যে সমস্ত টাকা বা ডলার আসছে সেই টাকা তো বাজারে কারো না কারো ডিপোজিট একাউন্টেই আছে। সেই টাকাগুলো খুব দ্রুত হাত বদল হচ্ছে, একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে যাচ্ছে। এটাকে বলে ভ্যেলুসিটি অফ মানি। এই ভ্যেলুসিটি বেড়ে যাওয়ার কারণেও মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। এটাকে কমিয়ে আনা বেশ কঠিন। এর জন্য হুন্ডি কমাতে হবে। সরকার হুন্ডি কমাতে অবশ্য ইদানীং নানাভাবে উদ্যোগ নিচ্ছে। এজন্য মনিটরিং পলিসি যেটা সরকারের সেটা আরো টাইট করতে হবে। এটাকে আরো টাইট করলে রেট অফ ইন্টারেস্ট আরো বাড়বে। রেট অফ ইন্টারেস্ট আরো বাড়লে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ তৈরি হবে। ব্যবসায়ীদের ওপর যে এই চাপটা পড়ছে সেটা তারা ইতোমধ্যেই বলতে শুরু করেছে। সুতরাং সরকারকে একটা খুব ভারসাম্যপূর্ণ নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ বছর প্রবৃদ্ধির চেয়ে স্থিতিশীলতা যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা সবাইকে বুঝতে হবে। উদ্যোক্তাদেরও ধৈর্য ধরতে হবে।
অন্যদিকে রাজস্ব যদি আমরা না বাড়াতে পারি তাহলে তো বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সরকারকে আবার যেতে হবে। রাজস্ব বাড়াতে হলে আমাদের দুটি উপায় আছে। একটা হলো- অনেক বেশি মানুষকে ট্যাক্সের আওতায় আনা- যেটা এখনো সরকার করে উঠতে পারছে না ডিজিটাল পদ্ধতিতে; দ্বিতীয়ত যে সুযোগগুলো আমরা দিয়েছিলাম সরকারের মাধ্যমে বিভিন্ন জনকে, সেই সুযোগ কমিয়ে ফেলা। ট্যাক্স মওকুফ দেওয়া হয়েছিল অনেক জায়গায়। যেমন: আমরা এর আগে বলেছি এই শিল্প করতে হলে তোমাদের ভ্যাট দিতে হবে না, তোমাদের আয়কর দিতে হবে না। সেগুলোই মূলত আমরা আস্তে আস্তে উঠাতে চেষ্টা করছি। দ্বিতীয়ত আমরা যে কাজটি করেছি- আমরা যে ক্যাশ ইন্সেন্টিভ দিয়েছিলাম বিভিন্ন জায়গাতে- বিশেষ করে, গার্মেন্টসের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে। সেটাও আস্তে আস্তে কমানোর চেষ্টা চলছে। না কমালে তো আমাদের বাজেটে কুলাবে না। আমার মনে হয় সরকার ঠিক পথেই এগুচ্ছে। তবে এই বছরটি যেহেতু খুবই স্পর্শকাতর হয়ে ওঠেছে মূলত মূল্যস্ফীতির কারণে, তাই খুবই ভেবেচিন্তে নীতি সংস্কারে হাত দিতে হবে।
আলী হাসান: স্যার আগামী জুন মাসের প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে কিছু বলুন।
ড. আতিউর রহমান: আমার একটা পরামর্শ থাকবে সরকারের প্রতি- এই বছর একটু সাবধানতার সাথে বাজেটটা করতে হবে। অর্থাৎ এই চাপটা যেন সবদিক থেকে একসাথে না পড়ে। যেমন ক্যাশ ইন্সেন্টিভ-এর হার অবশ্যই কমাতে হবে। কিন্তু ইমিডিয়েটলি না কমিয়ে আগামী ছয় মাস কিংবা এক বছর পরে থেকে কমানো যায় কি না সেটা ভাবতে হবে। দ্বিতীয়ত, ক্যাশ ইন্সেন্টিভ নিয়ে যারা অন্যায়ভাবে সুবিধা নিয়েছে অর্থাৎ প্রতিশ্রুত রপ্তানি করেনি কিন্তু রপ্তানির সুবিধাটা নিয়ে নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো শক্ত অবস্থান নিতে হবে। সেগুলো হয়তো করবে সরকার। তবে আমার প্রস্তাব থাকবে যেটা সেটা হলো- আইএমএফ-এর চাপেই হোক কিংবা বাস্তবতার নিরিখেই হোক সবগুলো চাপ যেন একসঙ্গে না দেওয়া হয়। অবশ্যই আমাদের করের হার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। অবশ্যই আমাদের ভর্তুকি কমাতে হবে। কিন্তু কোথায় কমাবো, কতটা কমাবো এবং কতটুকু কমালে আমাদের প্রকৃত ভোক্তা যারা তাদের ওপর চাপ পড়বে না এবং সরকারের ওপরও চাপ পড়বে না- সেসব বিষয় মাথায় রাখতে হবে। সবকিছু মিলে একটা বিচক্ষণতার সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে। যেমন: ধরা যাক সিগারেটের দাম বাড়িয়ে তার ওপর বেশি করারোপ করলে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা বাড়তি কর সরকার পাবে। পাশাপাশি এতে করে জনস্বাস্থ্য খাতে সরকারের ব্যয় কমবে। এমন ধারার ভারসাম্যমূলক নীতি গ্রহণ করাই শ্রেয়।
আলী হাসান: চতুর্থ মেয়াদের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে এক নম্বরে সংকট হিসেবে রেখেছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো- এই জায়গাটাতে তারা কতটুকু সফল হবে এবং আগামী বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য কমাতে তারা কী কী পদক্ষেপ নেবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আতিউর রহমান: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমাতে সরকার কী কী পদক্ষেপ নেবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। কিন্তু সরকারের যেটা করা উচিত সেটা হলো সাপ্লাই চেইনে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো আছে সেগুলো দূর করতে হবে। যেমন গ্রাম থেকে একটি পণ্য শহরে আসতে ঘাটে ঘাটে তাকে চাঁদা দিতে হয়, এটাকে বন্ধ করতে হবে। এর বাইরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের পরিবহণ ভাড়া যদি বেশি হয় সেই জায়গাটাতে সরকারকে সাবসিডি দিতে হবে। যেমন: আমের সময়ে আমরা রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ট্রেনের মধ্যে করে আম আনি। এ লক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আনা-নেওয়ায় ট্রেনের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু বগি পণ্যবাহী করতে পারি কি না সেটা দেখা উচিত। কৃষকদের জন্য সাবসিডাইজেশন অব্যাহত রাখতে হবে এবং এটা আরও বাড়াতে হবে। যেমন: বিদ্যুৎ খরচ। কৃষকদের জন্য যদি ১০% বা ২০% বিদ্যুৎ খরচ কমিয়ে দিতে পারি, তাহলে কৃষকরা এক্ষেত্রে কিছুটা রেহাই পাবে। সেটার প্রভাব নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপরও পড়বে। যেমন: রাসায়নিক সার ব্যবহার করে কৃষকের জমির উর্বরতা কমে গেছে। কেঁচো সার উৎপাদনের বাড়তি প্রণোদনা দিয়ে এ ক্ষেত্রে পরিবেশ সংরক্ষণকারী উদ্যোগ বাজেটে নেওয়া সম্ভব।
আরেকটা সমস্যা হলো- কৃষকরা যেসব পণ্য উৎপাদন করে সেগুলো তারা সরাসরি বিক্রি করতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকারের আইসিটি ডিভিশনকে ই-কমার্সের মাধ্যমে কতগুলো ই-প্লাটফর্ম তৈরি করতে হবে। এটা হলে প্রত্যন্ত গ্রামে- যেমন: ঈশ্বরদীর একজন কৃষক তার উৎপাদিত পাঁচ মণ বেগুন বিক্রি করার তথ্য সে নির্দিষ্ট অ্যাপে আপলোড করবে। সে এই অ্যাপে বলবে যে- আমি আমার খেতের এই বেগুনগুলো ঢাকার কারওয়ান বাজারে বিক্রি করতে চাই। সেখানে সরকারের আইসিটি ডিপার্টমেন্ট উচিতমূল্যে কৃষকের এই পণ্যটিকে বাজারে বিক্রি করতে সহায়তা করবে। এরপর যেটা করা যায়- যে সমস্ত পণ্য ওপেন মার্কেট সেল করছি আমরা ট্রাকের মাধ্যমে এবং বিভিন্ন দোকানের মাধ্যমে, এর সংখ্যা ও পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিতে হবে। সুনির্দিষ্ট দোকানে কার্ডের মাধ্যমে বিক্রির পরিমাণ আরও বাড়ানো যেতে পারে। সরকার অবশ্য বাড়াচ্ছে; এরই মধ্যে দেশে এক কোটির উপরে কার্ড দিয়েছে সরকার। আমি মনে করি- আগামী এক বছর এটার পরিমাণ আরো কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের যে গার্মেন্টস শ্রমিকরা তারা যেখানে যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করে সেখানে যদি প্রত্যেককে এক বান্ডিল খাবার অপেক্ষাকৃত কম দামে সরবরাহ করা হয়- যেটা ওএমএস-এর মতো হবে- যেটার খরচ সরকার এবং মালিক উভয় পক্ষই বহন করবে ওই বাড়তি সাবসিডিটা। এরকম উদ্ভাবনমূলক কিছু চিন্তার বাস্তবায়ন করলে মানুষের কিছুটা রেহাই মিলবে। আমি মনে করি- নতুন করে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে ভাবা যেতে পারে।
আলী হাসান: স্যার, এপ্রিল-মে থেকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি খরচের অভাবের কারণে বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিবে- এমন কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে- সরকার এটা কীভাবে সামাল দেবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. আতিউর রহমান: বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানি লাগে সে সমস্ত জ্বালানির মধ্যে কিছু জ্বালানি তো আমরা নিজেরাই উৎপাদন করে থাকি। যেমন: গ্যাস। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে জ্বালানি আমদানি করতে হয়- সে আমদানি কমাতে হলে তো আমাদের নিজস্ব জ্বালানির দাম বাড়াতেই হবে এবং সেটা সরকার বাড়াচ্ছেও। এরই মধ্যে বিদ্যুতের দাম সরকার ৮.৫০ পার্সেন্ট বাড়িয়েছে। না বাড়িয়ে অবশ্য সরকারের কোনো উপায়ও ছিল না। বাজেট ঠিক রাখতে হলে এটাকে বাড়াতেই হয়। কিন্তু এর দাম এমন একটা সময় বাড়ানো হচ্ছে যখন অন্য সূচকগুলোর উপরও রীতিমতো চাপ রয়েছে। আমার মনে হয়- এই জায়গাটাতে আর একটু চিন্তা করতে হবে সরকারকে। দাম বাড়লেও যারা বেশি এফেক্টেড হবে তাদেরকে সাবসিটি দেওয়া যায় কি না। যেমন রপ্তানিকারক কিংবা কৃষক- এদের জন্য ১০% বিদ্যুৎ খরচ আমরা সাশ্রয় করতে সহায়তা দিতে পারি কি না। এরকম চিন্তা করা যেতে পারে।
আলী হাসান: এবার একটি ভিন্ন প্রসঙ্গে কথা বলতে চাই। সম্প্রতি তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন শেষ হলো- আপনি এই রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের নির্বাহী সভাপতি। খুবই স্বতঃস্ফুর্তভাবে সারা দেশ থেকে অনেক প্রতিযোগী অংশ নিয়েছে এই রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনে- এই বিষয়টা নিয়ে একটু বলুন।
ড. আতিউর রহমান: আমাদের রবীন্দ্রচর্চাটা আরো অনেক বেশি হওয়া দরকার। আমি মনে করি- শুধু রবীন্দ্রচর্চা নয়; নজরুল চর্চাটাও আরো অনেক বেশি হওয়া দরকার। এরা দুজনই আমাদের শ্রেষ্ঠ কবি, আমাদের চেতনার শ্রেষ্ঠ নির্মাতা। এরাই আমাদের মননের কথা বলেন- বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলেন। সম্মেলনটি রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন হলেও এখানে কিন্তু আমরা পঞ্চ কবির গানও পরিবেশন করে থাকি। এমনকি গ্রামীণ যে লোকসংগীত ও লোকসংস্কৃতি, সেগুলোকেও আমরা সামনে তুলে ধরি। তবে এখানে রবীন্দ্রসংগীতটাকে মূলত প্রধান চর্চা হিসেবে আমরা ধরে নেই। সারা দেশে আমাদের রবীন্দ্রসংগীতচর্চার ৮৫০টিরও বেশি শাখা রয়েছে। সেই শাখাগুলোর মধ্যে প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আমরা ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করে থাকি। এবার আমার অনেক বেশি ভালো লেগেছে একটা কারণে যে- এবার প্রচুরসংখ্যক প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেছে সারা দেশ থেকে এবং সকলেরই গায়কী-মান অনেক ভালো; অনেক চর্চার মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রস্তুত করেছে। আমরা করোনাকালীনও কিন্তু অনলাইনের মাধ্যমে সারা দেশে এই প্রশিক্ষণের কাজটি অব্যাহত গতিতে পরিচালনা করেছি। আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা এই শাখাগুলোকে আমরা আরো বেশি শক্তিশালী করবো যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। আগামী বছরের মার্চে আমরা বগুড়াতে সম্মেলনটি করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এভাবেই আমরা রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমাদের নিয়মটা হলো- এক বছর আমরা ঢাকায় করি, আরেক বছর আমরা ঢাকার বাইরে করি।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি আমরা এই সংগীতচর্চাটাকে অপরিহার্য করে তুলতে পারতাম তাহলে একদিকে যেমন আমরা সারা দেশ থেকে আরো অনেক বেশি ছেলেমেয়ে পেতাম; অন্যদিকে ছেলেমেয়েদের শিক্ষার ভেতর একটি অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানসিকতা অখণ্ডভাবে গড়ে উঠতো। এখন সংগীতচর্চাটা মূলতই বিভিন্ন পরিবারে-পরিবারে হচ্ছে কিন্তু একটা সময় আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে নিয়মিত সংস্কৃতি চর্চা হতো। একটা জিনিস মনে রাখতে হবে- আমাদের দেশে নানা কারণে মুসলমান পরিবারগুলোতে সেইরকমভাবে সংগীত কিংবা সংস্কৃতিচর্চা হচ্ছে না। এটা যেকোনো চাপের কারণেই হোক না কেন, কথাটি সত্য। আমি মনে করি- বিষয়টির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। এ লক্ষ্যে রাজধানীসহ জেলা উপজেলার শিল্পকলা একাডেমিগুলোকে অনেক বেশি সক্রিয় করে গড়ে তোলা প্রয়োজন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গানের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত চর্চার মধ্য দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে রবীন্দ্র-নজরুল-বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী ও মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে পালন করা প্রয়োজন। এগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলে সংস্কৃতিবান শিক্ষার্থী তৈরি হবে দেশে এবং নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতার পরিমাণটাও বাড়বে। এটা সম্ভব হলে আমরা সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অনেক বেশি এগিয়ে যেতে পারবো। শিক্ষা ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক এই পরিবর্তনগুলো যদি আনা যায় তাহলে সার্বিকভাবেই শিক্ষার একটি দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়ন ঘটবে। আর সরকার নতুন যে শিক্ষাক্রম চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে তাতেও পরীক্ষার চাপ খানিকটা কমবে। ছেলেমেয়েরা এখন সংস্কৃতিচর্চায় কিছুটা সময় ব্যয় করতে পারবে।
আমরা তিনদিনব্যাপী যে রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনটি সম্পন্ন করলাম এটি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারকে দিয়ে উদ্বোধন করেছি এবং সমাপনী অনুষ্ঠানটি করেছি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দিয়ে। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমরা এই বার্তাটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাই যে- আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হলে আমাদের শুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এই মেসেজগুলো সকলকে দেওয়াও রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। আমি নিজে কোনো সংগীতের লোক নই কিন্তু আমি এই মেসেজগুলো সবাইকে দেওয়ার জন্যই এই সংগঠনদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘দেশে জন্ম নিলেই দেশ আপন হয় না, দেশকে আপন করে নিতে হয়, দেশকে জানতে হয়, দেশকে ভালোবাসতে হয়।’
আমি মনে করি- রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে এবং নজরুলকে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে আমরা দেশকে আরো বেশি ভালোবাসতে পারবো। সার্বিকভাবে আমি যেটা চাই সেটা হলো- রবীন্দ্রচর্চা, নজরুলচর্চা এবং বঙ্গবন্ধুচর্চা- এই তিনটি বিষয়কে একই সঙ্গে যুগপৎভাবে এগিয়ে নিতে হবে- তাহলেই দেশ প্রত্যাশিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের জাতি-রাষ্ট্রের পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সার্বক্ষণিকভাবেই রবীন্দ্র ও নজরুলের চেতনা ধারণ করতেন এবং সেভাবেই তিনি বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন। আমি মনে করি- এই তিন মহামানবের চর্চার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের দেশকে আগামী দিনগুলোতে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। এরাই হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ বাঙালি। এদের কাছ থেকেই আমাদের প্রাণশক্তি আহরণ করতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে।
আলী হাসান: স্যার, অনেক সময় ব্যয় করে এই সাক্ষাৎকারটি দেওয়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ড. আতিউর রহমান: তোমাকেও ধন্যবাদ।