বাবুল আক্তারের একগুচ্ছ কবিতা...
একটি দিয়াশলাই বাক্সের এপিটাফ
কয়টা কাঠি থাকে, প্লাস মাইনাস চল্লিশ, এই তো?
কয়েকটা পোড়ানো হলো নিজেকে দেখতে।
কয়েকটা নষ্ট হলো। ফুঁত করে উঠেই ধোঁয়া,
ভোঁষকা গন্ধ। কয়েকটায় জ্বালানো হলো বিড়ি কয়েকটায় বাতি, কয়েকটায় চুলা!
বাদবাকি জ্বালানোর জন্য বেত নিয়ে এলো গুরু
প্রেমিকারা এলো, ঘষে ঘষে নিজেকে দেখলো,
দেখালো। যথানিয়মে চলেও গেল। সেই সাথে চলে গেল যোগ-বিয়োগের চনমনে চল্লিশটা
কাঠি পোড়ানোর দিন।এখন অবশিষ্ট আর কাঠি নেই। সবাই পাশ
ফিরে যায়। বাক্সটা নিজেই নিজেকে কাঁধে নিয়ে
দৌড়ায়, কখনও নিজেই কাঠি হয়ে নিজের মধ্যে
ঢুকে চল্লিশটা কাঠির শূন্যতা কামড়ে শুয়ে থাকে
এভাবে আরও ত্রিশ/চল্লিটা কাঠির মতো সময়
পোহাতে হবে হে ফাঁকা দিয়াশলাই বাক্স!
------------------
হিমালয় এখন মাদাম তুষোর মিউজিয়মে
ফিলিস্তিনের মতো মেয়েটিকে নীলনদে স্নান করিয়ে
কুন্তলে ঝুলিয়ে দিলাম ব্যাবিলনের উদ্যান
নায়াগ্রার প্রপাত বইয়ে দিলাম তার নব-বরষার ধারার সাথে।
বারমুডার বিচিত্র সব আলোকখণ্ডে সাজালাম কটিদেশ, নিতম্ব আর বক্ষসৌষ্ঠব
বসরাই গোলাপ-লোবান ছোঁয়ালাম চিবুকে তার
অতঃপর
আগ্রার তাজমহল এনে হাতে ধরিয়ে দিতেই
চোখের সামনে গেঁথে দিলো চীনের প্রাচীর!হোয়াংহোর মতো দুঃখ নিয়ে এখন আমি
হিমালয়
নির্বিবাদ পড়ে আছি মাদাম তুসোর মিউজিয়ামে!
------------------------
অদৃশ্য সময় সমীপে
বিশেষ একটা পড়াশোনা করার ইচ্ছে নেই আর
অধিক পাঠ মানুষকে অপ্রকৃতস্ত করে দেয়
আরও অপ্রকৃতস্থ করে দেয় তার নাম, ধাম
পোশাক ও পশরাসমূহ!
আমি চেয়েছিলাম শান্তশিষ্ট একটা দিন
আমার পাশে শুয়ে থাকুক
সূর্য না উঠলেও ক্ষতি নেই
চাঁদ না হাসলেও উতলা হওয়ার কিছু দেখি না
আমি চেয়েছিলাম শুধু নির্বিবাদ কিছুটা সময়
যে সময়ের কোলঘেঁষে স্বপ্নহীন ঘুমিয়ে পড়া যায়
স্বপ্নের অনেক বিড়ম্বনা, অনেক ভয়
আমি ভয়কে ভয় পাই
উঁচুতে তাকালে মাথাঘোরার অসুখ মাথাচারা দেয়
আকাশ ছুঁতে গেলে পা মাটিছাড়া হয়
সকলে দেখুক, নাম জানুক, নামেই চিনুক
এ ভাবনা ছেলেবেলাতেই ডাস্টার দিয়ে মুছে ফেলেছি
আমি বিশাল হতে চাই না
সমুদ্র বিশাল বলে তার পানি অপেয়
পাহাড় বিশাল বলে তার শরীর জুড়ে বরফের
দৌরাত্ম্য, ঝড়ের তাণ্ডব!
আমি শুধু চেয়েছিলাম শান্তশিষ্ট কমনীয় দিন
যার আবরণ একটার পর একটা খুলে ফেলে
আমাকেই দেখতে চেয়েছিলাম
আমাকে আলিঙ্গন করে
আমারই চোখে তাকিয়ে অর্থহীন হেসে উঠতে
চেয়েছিলাম
কিন্তু অস্থির সময় আমাকে বুনো শুয়োরের মতো
তাড়া করেছে আজন্মকাল ধরে!
কারণ আমার জন্ম হয়েছিল মনুষ্যসৃষ্ট সমাজ
আর কাঁটাতারের তীক্ষèতার মাঝখানে !
-------------------------
নাম নিলে যে মরে যায়
যেই বললাম ‘ভালোবাসি’, অমনি ভালোবাসা
মরে গেল
মরার পরেও ভেবেছিলাম, প্রজাপতি হয়ে
একদিন উঠে দাঁড়াবে, উড়বে
কিন্তু মৃত্যান্তরে হলো গোবরে পোকা
অবোধ মাটি দ্বিধা করে ঢুকে গেল সে!
এত হাতড়াই, লাঙল চালাই, শাবল ঢুকাই,
আঁশটে গন্ধের গোলাপজল দিই, তবু
সেই গোবরেপোকা আর জেগে উঠলো না!
উঠলে সামনে দাঁড়িয়ে কান ধরে বলতাম
মহাত্মন, জনাব, হুজুর, আমি ভুল করেছিলাম
ভুল করে বলেছিলাম, ‘ভালোবাসি’
আমায় ক্ষমা করুন হে মহান ভালোবাসা
আপনার এই অকাল মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী!
--------------
আগামী পাঁচশো বছর শীতকাল
নিভে যাওয়া জোনাকির মতো
চোখ খুঁড়ে কী পাবে আর প্রত্নতাত্ত্বিকগণ?
সুরঙ্গের শেষ প্রান্তে নতুন সুরঙ্গের শুরু
উঁই-ডিবির মতো ভুরভুরে মাটিতে ফের
পাঁচসালা বন্দোবস্তর সওগাত আসবেআগামী পাঁচশো বছর শীতকাল
হাজার বছর ঘুমে কাটানোর পরও
ছা তুলবে না বৈশাখী মেঘের দম্পতি
নিভে যাওয়া সূর্যের পেটে শাবল চালিয়ে
ছাই ছাড়া আর কী পাবে প্রত্নবিদগণ!
ইতিহাসবিশারদ হলে তাও না হয়
লিখে যেতে পারতো আমাদেরও
পশ্চিম থেকে টেনে আনা সূর্য ছিল
পকেটে পুরে যত্ন করেই মেরে ফেলেছি!
---------------