শিক্ষা ও ক্যাথারসিসের সংগমে স্নাত হোক আত্মার পরিশুদ্ধি

ইমরুল কায়েস
| আপডেট : ০২ মে ২০২৪, ২৩:০৭ | প্রকাশিত : ০২ মে ২০২৪, ১৬:৪৪

শিক্ষার সবচেয়ে পুরোনো প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় উপনিষদীয় যুগপর্বে। তপোবন শিক্ষার সবচেয়ে সুন্দর চিত্রকলা মুনি এবং মুনি বালক। মুনি বালকেরা শিক্ষার প্রয়োজনে সে সময় মুনিগৃহে পদার্পণ করতেন। তারা শিক্ষাগ্রহণ করতেন- ‘এই জগৎ বিচ্ছিন্ন নয়। তৃণমুল থেকে সুদূর আকাশের প্রতিটি নক্ষত্রমণ্ডলি সম্পর্কযুক্ত।’

স্বতন্ত্র অবস্থানের কোনো সুযোগ এখানে নেই। বরং সমগ্র জগৎ মিলেমিশে এক ও অখণ্ড। চারপাশের প্রকৃতির সাথে মানুষের স্বসংবেদ অনুভব। রবীন্দ্রনাথও চিরকাল এই অখণ্ডতাকে ধারণ করেছেন তাঁর শিল্প-সাহিত্যে।

‘তপোবন’ রবীন্দ্রনাথের চিন্তার একটি মর্মজ্ঞাপন প্রবন্ধ। মানুষ যখন সমগ্র প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে এক হয়ে যায়, তখন তার ভিতরে আর আমিত্ব (ইগো) আঁকড়ে থাকতে পারে না। আমিত্বের বিসর্জনে দূর হয়ে যায় তার সমগ্র সংকীর্ণতা, ভয় ও দুরাচার। ফলে সে প্রস্ফুটিত হতে থাকে আনন্দ আর ক্যাথারসিসের ভিতর দিয়ে।

আমরা জানি, উপনিষদীয় উত্তরকালের উন্মেষ ঘটে গ্রিক সভ্যতার। সৃষ্টি হতে থাকে সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টেটলসহ বিভিন্ন চিন্তাবিদের কালোত্তীর্ণ উর্বর ফসল। কীভাবে মানুষের অনুর্বর চেতনাকে আরো বেশি সমৃদ্ধশালী করা যায়, এই ভাবনায় তাঁরা তৈরি করেছিলেন বিভিন্ন ডিসকোর্স। সে সময় যুদ্ধ, নিগ্রহ, দুঃশাসন, মানুষের পশুসুলভ আচরণ রাষ্ট্রকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছিল। ন্যায় এবং সৌন্দর্য পদদলিত হচ্ছিল জ্ঞানহীনতার বিচারদণ্ডে। জীবনের এই বর্বতার উত্তরণে এ সকল মনীষা তৈরি করলেন মননশীলতার শিল্পকৌশল। সেই শিল্পকৌশলে ধরা দিয়েছিল কবিতা, নাটকের মতো সুন্দর সুকুমার কলা। কেন এই শিল্পকলার প্রয়োজন? মানুষ চিরকালই কাম-ক্রোধ-মাৎসর্য আর ভয়ের চিত্তবৃত্তিতে আবদ্ধ থাকে। মানুষের এই বৃত্তিকে সংযত ও সংহত করতে না পারলে কখনোই উন্নতি করা যায় না। আর রাষ্ট্র তো মানুষের বাহিরে নয়, তাই রাষ্ট্রবিকাশের মূল সুত্রগুলোও এই মানবিক বৃত্তির উপরই নির্ভরশীল। তাই তারা আবিষ্কার করলেন নাটকের শিল্পমান। কারণ মানুষ যখন কোনো নাটকের বিভিন্ন রস-বিভাব-অনুভাবের মুখোমুখি হয় তখন তার অবদমিত মনের ভিতরেও সেই একই রসের লীলাখেলা ও উৎকণ্ঠা চলতে থাকে। আর ধীরে ধীরে মন ক্যাথারসিসের মাধ্যমে মুক্ত হয় মনের পশুপাশ থেকে। মনস্তাত্ত্বিক পরিভাষায়- মন যখন যাকে ভয় পায় তার মুখোমুখি হতে পারলে আর কোনো ভয় থাকে না। কিন্তু বাস্তবজীবনে সে ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। সিনেমা নাটকগুলো এই বাস্তবতার বিকল্প অনুষঙ্গ।

গ্রিকপর্ব পেরিয়ে আমরা পৌঁছে যাই আধুনিক যুগে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অসংখ্য কলেবর এই সময়টাকে একটা নতুন মাত্রায় বিকশিত করেছে। হাজারো তথ্যভান্ডারে সমৃদ্ধ হয় আমাদের জ্ঞান ভান্ডার। কিন্তু সম্পদ এবং জীবনের ভারসাম্যহীনতায় আধুনিক সময়ের ভিতরেও তৈরি হয় মানসিক নিষ্পেষিত ক্ষত। বৈষম্যের ব্যঞ্জনায় তৈরি হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা; যেনতেন প্রকারে সামাজিক স্তরের উঁচুতে পৌঁছানোই তখন হয়ে ওঠে একমাত্র লক্ষ্য। আর এই প্রতিযোগিতা শিক্ষা ক্ষেত্রেও তার প্রভাব তৈরি করে। তখন শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে উঠে অর্থ-অর্জনের এক ও অদ্বিতীয় কৌশল।

কারণ সম্পদ যত বেশি হয় তার পরিচয়ের আইডেনটিটিও ততই শক্তিশালী হয়। রসে পরিপুষ্ট হয় আমিত্বের আলোকলতা। ফলে অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিক্ষেপ করেন স্বকালের অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। এতে অনেক শিক্ষকও অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। শিক্ষার্থীরা জীবনের সুন্দরতম, আনন্দময় সময়কে পাশ কাটিয়ে ডুবে থাকে মুখস্থ নামক মৃত-তথ্যসাগরে। দিনে-দিনে শিক্ষার্থীরাও জেনে যায়, তাকেও যেকোনো উপায়ে প্রথম সারিতে অবস্থান করতে হবে। কিন্তু এই বিষম প্রতিযোগিতা শুধু আর্থ-সামাজিক উন্নয়নই ঘটায় না, তৈরি করে অসুস্থ মনোবিকলনও। যে মনোবিকলন শুধু তার ব্যক্তি জীবনেই নয়, কখনো-কখনো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রেও তার অসংগতিকে ফুটিয়ে তোলে। কারণ মানুষ যদি ব্যক্তিকেন্দ্রিক দেওয়াল ভেঙে বের হতে না পারে, তাহলে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কখনোই সুন্দর হতে পারে না। কিন্তু একটি কথা ধ্রুব সত্য; শিক্ষা এবং তথ্য আহরণ একই বস্তু নয়। তথ্য এখন বিভিন্ন উপায়ে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু শিক্ষা? শিক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক নৈতিকতা এবং বিমোহ গুরু বা শিক্ষক। তাই বিশ্বের অনেক দেশ শিক্ষাকে শুধু একাডেমিক তথ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে যুক্ত করেছে মানবিক মুল্যবোধ, নৈতিকতা, মনস্তাত্ত্বিক এবং বৈজ্ঞানিক ভাবনায়।

যাহোক, মানুষের যে গভীর শিক্ষা শুরু হয়েছিল উপনিষদীয় অখণ্ড দর্শন দিয়ে, তা গ্রিক-রাষ্ট্রীয় শিল্প-ভাবনার পর্যায় পেরিয়ে চুড়ান্তভাবে খণ্ডিত হয়েছে আধুনিক ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনায়; অখণ্ড থেকে খণ্ডে; সমগ্র থেকে অংশে। অর্থাৎ শিক্ষার উচ্চতর দর্শন থেকে আমরা রূপান্তরিত হয়েছি উৎপাদনশীলতার পণ্যে। তবে যতই খণ্ডতা ঘটুক, আমরা এখন অনেক বেশি ঋদ্ধ। আমাদের আছে আধুনিক তথ্য, গ্রিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং উপনিষদীয় যুগের প্রজ্ঞা-দর্শন। এ যেন ত্রিবেণী, যে ত্রিবেণীতে স্নান করে আমরা হতে পারি পরিশুদ্ধ ও প্রকৃত স্নাতক।

ইমরুল কায়েস: কলেজ শিক্ষক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :