ইতিবাচক জীবনদৃষ্টির ‘আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাসে বাঁচি’

অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন
| আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৪১ | প্রকাশিত : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৬:৩২

‘নিঃসঙ্গতার কুয়োতে নয়, হোক সন্তরণ সুহৃদ সমুদ্রে

বাঁচার আনন্দে চলো বাঁচি, জেগে রঙিন স্বপ্ন রৌদ্রে।’

‘আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাসে বাঁচি’- রাশনা রশীদ এবং আবদুল্লাহ আল মোহনের লেখা বইটির মূল স্লোগানই বলা যায় উপরের চরণ দুটোকে। কারণ দেশে আত্মহত্যাজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আত্মহত্যা পরিসংখ্যানের বিষয়ও নয়। অতি মূল্যবান একটি জীবন স্বেচ্ছায় সমাপ্তি টানার ঘটনা বৃদ্ধি আমাদের গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করছে। আত্মহত্যা দেশজুড়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষ করলেও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করছে বা উচ্চশিক্ষায় পড়া একজন শিক্ষার্থী অতি তুচ্ছ কারণে কেন আত্মহত্যা করছে সেই মনস্তত্ত্বই এখন আলোচনার বিষয়। এভাবে প্রাণগুলো ঝরলে সমাজের আর কী অবশিষ্ট থাকে? এই মনস্তত্ত্ব কীভাবে পরিবর্তন করা সম্ভব সেই গবেষণা সর্বাগ্রে স্থান দিতে হবে। দেশের অনেক সমস্যার মধ্যে এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এই সামাজিক ব্যাধি না সারালে ক্ষত ক্রমেই বৃদ্ধি পাবে।

২.

‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে, মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই’- সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শাশ্বত আকুতি এটি। অথচ কিছু মানুষ জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে আত্মহত্যাকে নিষিদ্ধ এবং কাপুরুষোচিত কাজ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তারপরেও সাম্প্রতিক সময়ে সারা বিশ্বে আত্মহত্যার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায় প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮ থেকে ১০ লাখ লোক আত্মহত্যা করে থাকে। মানুষের মনোজগতে বাস করে দৈনন্দিন জীবনের অসংখ্য মৃত্যুযন্ত্রণা। মূলত আত্মহত্যার ইতিহাস লুকিয়ে আছে সংস্কৃতি, দর্শন, পুরাণ ও জন-ইতিহাসের গোপন অলিখিত দস্তাবেজে। সেইসব কথাও পাওয়া যায় বইটিতে।

৩.

আত্মহত্যার চিন্তা খুব কম সময়ের। তবুও ঘটে। কোথা থেকে সংকট দেখা দেয় তা অজানাই থাকে। মূলত এক অজানা অদৃশ্যে জন্ম নেওয়া এক পোকা কুট কুট করে কেটে দেয় বাঁচার অদ্ভুত স্নায়ুমণ্ডলীকে। ঘটে যায় মানব জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা- আত্মহত্যা। আর সেই বিবেচনাতেই বইটিতে মানুষের হৃদয়ের মুক্তির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে আত্মহত্যার কারণ, প্রতিকার, আত্মহত্যাকারী ব্যক্তির মনোসমীক্ষণ বিশ্লেষণাত্মক এবং গবেষণাধর্মী দৃষ্টিকোণ থেকে বইটিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক-যুগল। রাশনা রশীদ এবং আবদুল্লাহ আল মোহন ব্যক্তিগত জীবনে স্বামী-স্ত্রী। একজন মনোবিজ্ঞানী, অপরজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। দুজনেই শিক্ষকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দুজনেরই রয়েছে প্রত্যক্ষ নিবিড় যোগাযোগ। তরুণদের মনোজগৎ, আচার-আচরণ, চাহিদা খুব কাছে থেকে প্রতিনিয়ত দেখার সুযোগ হয়ে থাকে দুজনেরই। রাশনা রশীদ মনোবিজ্ঞানের শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তরুণ শিক্ষার্থীদের মনোজাগতিক ক্রিয়াকর্মের প্রতি রয়েছে তাঁর গভীর আগ্রহ। অপরদিকে আবদুল্লাহ আল মোহন শ্রেণিকার্যক্রম ছাড়াও শিক্ষার্থীদের নিয়ে আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। বইপড়া, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংশ্লিষ্ট বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলাসহ নানাবিধ ইতিবাচক কার্যক্রমের সঙ্গে রয়েছে তাঁর নিবিড় সংশ্লিষ্টতা। যে কারণে লেখক দুজনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে আত্মহত্যার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সমস্যা অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে বর্ণিত হয়েছে বইটিতে।

৪.

লেখকদ্বয় মোট ১৯টি আলাদা আলাদা পরিচ্ছেদে আত্মহত্যার মনস্তত্ত্ব, ইতিহাস, কারণ, প্রবণতা, প্রতিরোধ, প্রতিকার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, মানসিক স্বাস্থ্যে গুরুত্ব, আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধকরণসহ বিভিন্ন বিষয় তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে ‘আত্মহত্যা: প্রাথমিক ধারণা’ পরিচ্ছেদ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি- ‘আত্মহত্যাকে খ্রিষ্টান-ইউরোপিয় অঞ্চলেও একটি পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। ৪৫২ সালে ‘আরলেস’-এর কাউন্সিলে আত্মহত্যাকে শয়তানের কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। ফ্রান্সের লুই চতুর্দশের ১৬৭০ সালে তৈরি করা ফৌজদারি অধ্যাদেশও অত্যন্ত অমানবিক ছিল। আত্মহত্যাকারী করা ব্যক্তির মৃতদেহ রাস্তায় টেনে আনা হতো। মাথা নিচের দিকে দিয়ে আবর্জনা দিয়ে আবৃত করা হতো সেই মৃতদেহ। এমনকি মৃত ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হতো।’

৫.

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে- বর্তমান সময়ে কিশোর এবং তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েই চলেছ। হতাশা, বেকারত্ব, প্রেমে ব্যর্থতা, পরীক্ষায় আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়া, ধর্ষণ বা হেনস্থার শিকার হওয়া, এমনকি বাবা-মার কাছ থেকে কাক্সিক্ষত বস্তুটি না পাওয়ার মতো তুচ্ছ কারণেও তারা আত্মহত্যা করে বসে। হতাশাগ্রস্ত তরুণদের আত্মহত্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে অভিভাবক এবং শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে বলে বইটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, শিক্ষকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যের সেবা বৃদ্ধি করা এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে।’ শুধু কিশোর বা তরুণরাই নয় বয়স্ক মানুষের মধ্যেও রয়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ, পরকীয়া, আর্থ-সামাজিক সমস্যা এবং পারিবারিক কারণে অনেকেই আত্মহত্যা করে থাকেন। শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনয়শিল্পীসহ সৃষ্টিশীল বিখ্যাত মানুষজনও রয়েছেন এই তালিকায়। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ-প্রতিপত্তি থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেকে ধ্বংস করার খেলায় মত্ত হয়ে আত্মবিনাশ ঘটিয়ে থাকেন। ‘অর্থ নয় কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়- আর এক বিপন্ন বিস্ময়’ যেন তাদের ‘রক্তের ভেতর খেলা করে’- যাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলেন। ইতিবাচক জীবন-দর্শনে বিশ্বাসী হয়েও অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস, লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, সিলভিয়া প্লাথ, ভার্জিনিয়া উলফসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ আত্মহত্যা করেছিলেন। অতি সম্প্রতি প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাদি মহম্মদের আত্মহত্যা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন এবং বোদ্ধামহলকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথকে যিনি জীবনের ধ্রবতারা মেনে নিয়েছিলেন, যার গাওয়া রবীন্দ্রনাথের গানের সঞ্জীবনী সুরা আস্বাদন করে হতাশ মনে আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে, অথচ সেই তিনিই আত্মহননের পথ বেছে নিলেন। সৃজনশীল মানুষের এমন স্বেচ্ছামৃত্যুর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে সমগ্র বিশ্বেই। সেসবেরও সংক্ষিপ্তসার খুঁজে পাওয়া যায় বইটিতে।

৬.

এবার আসা যাক নামকরণ প্রসঙ্গে। ‘আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাসে বাঁচি’- বইটির ‘আত্মবিশ্বাসে বাঁচি’ পরিচ্ছেদের শুরুতেই একটি উদ্ধৃতি রয়েছে- ‘বিশ্বে এক ও অদ্বিতীয় বিশ্বাসের নাম আত্মবিশ্বাস’। নিজের উপর যার আত্মবিশ্বাস আছে সে কখনোই আত্মহত্যা করতে পারে না- লেখকগণ এই সত্যটির উপর বেশ জোরালো তথ্য সন্নিবেশ করেছেন। বিশেষজ্ঞ-মনোবিদদের মতামতসহ জানিয়েছেন, ‘স্বাধীনতা, স্বকীয়তা, উৎসাহ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, সমালোচনার মুখোমুখি হওয়া, ইতিবাচক মনোভাব- সবকিছুই গড়ে উঠে আত্মবিশ্বাসের চাকায়।’ জীবন একটাই, সেই জীবনটাকে ভালোবাসতে হবে, যেকোনো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিক শক্তি অর্জন করার জন্য আত্মবিশ্বাস থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। নিজের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাসটুকু উবে গেলেই চরম হতাশায় জর্জরিত হয়ে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। সেজন্য শৈশব থেকেই শিশুর জন্য একটি ইতিবাচক পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল থাকাটা আবশ্যিক। ইতিবাচক মানসিকতা আর আত্মবিশ্বাসী মানুষ গড়ে তোলার জন্য পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকার উপরও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বইটিতে। ‘নাই পরাজয় ভয়, হতাশার গ্লানি ভুলি’র প্রত্যয়ী আত্মবিশ্বাসে বাঁচি- এই মর্মবাণীটিই বলা যায় বইটির মূল প্রতিপাদ্য। সুতরাং এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় বইটির নামকরণ সার্থক এবং যথার্থ। নবীন-প্রবীণ সকল বয়স-শ্রেণির মানুষের জন্য নিজের প্রতি আস্থা অটুট রাখতে বইয়ের রচনাগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলেই প্রবলভাবে আশাবাদী।

৭.

‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’ শেষে যে কথাটি না বললেই নয় মুদ্রণজনিত ত্রুটি, কিছু ভুল বানান দৃষ্টিকটু লেগেছে। আশা করি পরবর্তী সংস্করণে সে বানানগুলো সংশোধিত হবে। ইতিবাচক জীবনদৃষ্টির, মানসিক সুস্থতার জরুরি গ্রন্থটির প্রচ্ছদ মনকাড়া, ভাষা সরল ও সহজবোধ্য, সকল শ্রেণির পাঠকের কাছেই যা সুখপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হবে বলে মনে করি। সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতায় আমাদের শিক্ষার্থীদের এবং তাদের অভিভাবকদের জন্য বইটির অসম্ভব প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে। আত্মহত্যাপ্রবণতা প্রতিরোধ মানসিক শক্তি জোগাবে বইটি। ‘আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাসে বাঁচি’ বইটি বিশেষ করে তরুণপ্রজন্মসহ স্বাভাবিক মৃত্যু প্রত্যাশী প্রতিটি মানুষের, সকল বয়সী পাঠকের কাছেই সমাদৃত হবে বলে আশা করছি। ‘আত্মহত্যা নয় আত্মবিশ্বাসে বাঁচি’ বইটির যৌথ লেখক: রাশনা রশীদ এবং আবদুল্লাহ আল মোহন। বইটি প্রকাশ রেছে: অন্যধারা, বইটির মূল্য : ৪০০ টাকা, প্রকাশকাল: বইমেলা- ২০২৪

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :