চাক জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও প্রদীপ্ত তরুণ ছাগ্যহ্লা চাক

রকি গৌড়ি
 | প্রকাশিত : ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৫

বাংলাদেশে বসবাসকারী চাক জনগোষ্ঠীর কোনো লিখিত বর্ণমালা ছিল না। এখন চাকদের বর্ণমালার কথা সবাই কিছুটা হলেও শুনেছেন। ২০১১ সালে মংমং চাক প্রথম চাকদের বর্ণমালা উদ্ভাবন এবং চাক শব্দটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন। এর আগে নিজেরা চাক বললেও অফিস আদালতে নামের শেষে টাইটেল চাক শব্দটি লিখিত ছিল না।

চাকদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি, লোককথা, গান, ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ। তাদের উৎসবের মধ্যে রয়েছে থিংকানাই (গ্রামরক্ষক দেবতার কাছে বলী উৎসর্গের উৎসব), লাব্রে (অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা), সাংগ্রাই, কাথিং পোয়ে (কঠিন চীবর দান), কাতাং য়িশু পোঃ, তেংছংবুক লাব্রে (কার্তিক পূর্ণিমা), আংনাইবুক পোয়ে (নবান্ন উৎসব) ইত্যাদি সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব।

চাকদের জীবনধারা বৈচিত্র্যময়। শিশুর জন্ম ও নামকরণ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদির মধ্যে নাইংছাঙাহাং-এ অবস্থান, পুতরংবুওয়ে (জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠান), ভেগলুংশাত পো (চুংবংলং উচ্ছেং ছাহেকা) উল্লেখযোগ্য। বিবাহ সংক্রান্ত প্রথার মধ্যে আচাংগায়ুগা (কনে দেখা), চাঁগায়ুগা (কোষ্ঠী বিচার)সহ আরও অনেক প্রথা পালন করা হয়।

এছাড়া মৃত্যুপরবর্তী আচার, কাবাকে শয়ন, তালাহ্-তে স্থাপন, দাহকার্য, কাঙবোয়েং (শুদ্ধকরণ), ছানিংওয়াক্ সভীক ফ্রেহ, সাইন্ বলব্ (পুনঃজন্ম কামনা) চাকদের নিজস্ব সংস্কৃতিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

চাক সমাজের কবি, লেখক ও গীতিকারদের মধ্যে রয়েছেন ওয়াং চিংচাক, চামাপ্রু চাক, নাংউচাক, চাইছাঅং চাক, মংনু চাক, এম আর চাক, মং কোচিং চাক, মংমং চাক (চাক বর্ণমালার উদ্ভাবক), অংখ্যাই চাক, এছাইনচিং চাক, চিংলামং চাক, ছক্রাঅং চাক, চিং ছালা চাক, ছাগ্যহ্লা চাক, উখাইচিং চাক।

পূর্বে উল্লেখিত সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবগুলোকে কেন্দ্র করে চাক গোষ্ঠীর কবি, লেখক ও শিল্পীরা সৃষ্টি করছেন লোককথা, গান, ছড়া, কবিতা ও প্রবন্ধ। ছাগ্যহ্লা চাক হলেন এমন একজন মেধাবী তরুণ শিল্পী। নিজের সংষ্কৃতিকে ধারণ করেছেন সত্তায়। চাক ভাষায় গান রচনা করে, চাক ভাষার গানে সুর দিয়ে, গান করে, কখনও বা চাক ভাষার নাটকে অভিনয় করে জীবন চলছে তার।

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার দৌছড়ি ইউনিয়নের ক্রোক্ষ্যং চাক পাড়া গ্রামে তার জন্ম। শিক্ষা জীবনে স্নাতক শেষ করেছেন এই মেধাবী তরুণ। ছোট বেলায় টিভিতে বিভিন্ন চ্যানেলে গানের প্রতিযোগিতা দেখে শিল্পী হওয়ার ইচ্ছে জাগে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের বার্ষিক ক্রীড়া গান প্রতিযোগিতায় আধুনিক গান গেয়ে ২য় স্থান অর্জন করেন পুরো উপজেলায়। তখন থেকে গানের জগতে প্রবেশের উদ্দীপনা ও প্রেরণা পান। নিজ ভাষা ও সংস্কৃতিকে লালন করে নিজ ভাষায় গান রচনা ও সুর দেওয়া শুরু করেন।

‘প্রাইংয়াগা আপ্য সাংগোক নাংজুক লুওয়েংমাক নাংঙাং ঙা চোকাকহেক মাং ঙাপিয়েংমাক।’ (পৃথিবীর সব সুখ তোমাকে দান করলাম তোমায় আমি ভালোবাসি বলেই রাখলাম’)।

একজন তরুণ গায়ক ও গীতিকার হিসেবে তার গানের কথায় রয়েছে প্রেম, ভালোবাসা ও বিরহ ইত্যাদি। তিনি প্রায় ডজন খানেক গান রচনা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছে: আচাক বাছা ঞিগামাক, ইং মাকতা মাকতা, ঙাগা কাবাপ্রেং (আমার পৃথিবী), ছিংহেক থাংনেক (শীতের রাতে), নাং সেলাংহেলে (তুই কি জানতি)।

সদ্য যারা বিয়ে করেছেন তাদের উৎসর্গ করে এই তরুণ গায়ক ও গীতিকার লিখেছেন সাকপং সাকরে (আজীবন), এক সুন্দরীকে দেখে ভালো লাগা থেকে লিখেছেন মেদেদাং কানাংহেচ্যো (এত সুন্দর) গানটি। মাকে নিয়ে লিখেছেন ‘মা (আনো)’। চাক ভাষায় লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন একটি জাগরণের গানে, যার বাংলা ‘ও… হো হো আধাঁর জগতে আলো ছড়াব রুপালি চাঁদের মতো আলোড়িত হবো, আমরাই জ্বলব, আমারাই উঠব, আমারাই গড়ব।’

তার গানের কথায় বোঝা যায় নিজের সংস্কৃতিকে তিনি কতটা লালন করছেন।

চাক গোষ্ঠীর ‘পাইকচুং ব্যান্ড’ এর হয়ে অনেক গান করেছেন এই তরুণ মেধাবী শিল্পী। বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে নিজের গান গেয়ে অনেক প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই তরুণ।

অনুবাদ কাজেও পিছিয়ে নেই তরুণ ছাগ্যহ্লা চাক। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং একুশে ফেব্রুয়ারির জনপ্রিয় গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ চাক ভাষায় অনুবাদ করেছেন এই মেধাবী শিল্পী। পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু অংশ তুলে ধরা হলো : ঙাগা শৈছাং বাংলা (আমার সোনার বাংলা)/ঙা নাংঙাং রামাকহে (আমি তোমায় ভালোবাসি)। ‘ঙাগা হুব্রারাক্কা ছেইং লুহেকা একুশে ফেব্রুয়ারি’ (আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি), ঙা ছাকতা মাইক ক্লাংলুগালে (আমি কি ভুলিতে পারি)’।

সম্প্রতি তার পরিচালনায় ইউটিউব চ্যানেল Chak Film- এ প্রকাশ হয়েছে চাক ভাষায় গান ও নাটক। চাক সমাজে অন্যান্য তরুণ শিল্পী, মডেল, গায়কদের মধ্যে রয়েছের-উখ্যাইচিং চাক, য়াইনুপ্রুফ চাক, ও মিয়া সাইন চাক, চিংমংলা চাক, চাইল্যাগ্য চাক ।

ইউটিউব চ্যানেল লিংক youtube.com/watch?v=3Hjed1shgOA

(ঢাকাটাইমস/২৮এপ্রিল/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :