মাল্টা চাষে গারো পাহাড়ে বিপ্লব

সুজন সেন, শেরপুর
 | প্রকাশিত : ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:০৪

শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ে বারি-২ ও বারি-৪ জাতসহ অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানি বিভিন্ন প্রজাতির সবুজ মাল্টা চাষে নিরব বিপ্লব শুরু হয়েছে। পাহাড়ি উঁচুনিচু টিলা আর টিলা ঘেষা পতিত জমিতে অনেকেই ঝুঁকছেন মাল্টা চাষে।

ফলটি খুব লাভজনক ও সুস্বাধু হওয়ায় জেলার সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে মাল্টা চাষ। দেশীয় প্রযুক্তিতে চাষকৃত এসব মাল্টার চাহিদাও রয়েছে বেশ।

গারো পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি সুনিষ্কাশিত, উর্বর, মধ্যম থেকে দোঁ-আশ এবং এখানকার আবহাওয়া শুষ্ক ও উষ্ণ হওয়ায় এখানে সাইট্রাস (লেবু) জাতীয় ফল চাষের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। আর এ জাতীয় ফল বিশেষ করে লেবু ও মাল্টা চাষ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় ও একই সঙ্গে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব।

তিন বছর আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় লেবু ও মাল্টা চাষ করে সফলতা পেয়েছেন উদ্যোক্তা আব্দুল বাতেন। বাতেন ঝিনাইগাতীর হলদী গ্রামের মফিজ উদ্দিনের ছেলে। তিনি পেশায় সরকারি গাড়ি চালক।

নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হলে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে এ অঞ্চলে লেবু ও মাল্টা চাষে বিপ্লব ঘটবে এবং এই বিদেশি ফলটিই দেশে উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব বলে মনে করেন আব্দুল বাতেন। একইসঙ্গে এ অঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হওয়ার নতুন দ্বার উন্মোচন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

উদ্যোক্তা আব্দুল বাতেন বলেন, সীমান্তে হাতির উপদ্রব থাকায় তার ২২ বিঘা জমি পতিত পড়ে থাকত। গত চার বছর আগে কৃষি বিভাগের লোকজনের পরার্মশে ছয় বিঘা জমিতে সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় ব্লক প্রদর্শনীর মাধ্যমে ও তার নিজ উদ্যোগে আরো নয় বিঘা জমিতে লেবু জাতীয় ফলের চাষ শুরু করেন।

বর্তমানে তার বাগানে ১৩০০ সিডলেস ও ৫০০ কাগজি লেবু, ৩০০ মাল্টা, ২০টি কমলা, ২০টি জাম্বুরা ও ৬০টি আম গাছ রয়েছে। বাগান দেখাশুনা করার জন্য তিনজন শ্রমিক রয়েছে বছর চুক্তিতে। এছাড়া দৈনিক মুজুরি ভিত্তিতে পাঁচজন শ্রমিক কাজ করে।

এ পর্যন্ত আব্দুল বাতেনের খরচ হয়েছে প্রায় ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। শুধু লেবু বিক্রি করেছেন সাড়ে ১৮ লাখ টাকা। মাল্টা প্রথম বছর বিক্রি হয় এক লাখ ২০ হাজার এবং গত বছর বিক্রি হয় তিন লাখ টাকা। এ বছর টার্গেট আরো অনেক বেশি।

আব্দুল বাতেন ছাড়াও আশপাশের অনেকেই ঝুঁকছেন মাল্টা চাষে। নালিতাবাড়ীর বুরুঙ্গা গ্রামে গাজীপুর থেকে উদ্যোক্তা শওকত আলম প্রায় নয় বিঘা পাহাড়ি টিলার ওপর বেশ কয়েকবছর আগে মিশ্র ফল বাগান করেন। গত দুই বছর থেকে অন্যান্য ফল বাগানের পাশাপাশি মাল্টা চাষ শুরু করেছেন। তিনিও বেশ লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন।

এছাড়া পাহাড়ি টিলা ছাড়াও বিভিন্নস্থানে অনেকেই নিজস্ব জমিতে ৫০ থেকে ১০০টি মাল্টার চারা রোপণ করে মাল্টা চাষ শুরু করছেন। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ছোট-বড় বেশ কিছু মাল্টা বাগান গড়ে উঠেছে।

চাষি হাসান মিয়া ও আব্বাস শেখ বলেন, পাহাড়ি বিভিন্ন টিলা ও টিলা ঘেষা বিভিন্ন পতিত জমিতে সারি সারি মাল্টা গাছ। সেসব গাছে লিচুর মতো গাঢ় সবুজ রঙের মাল্টা ঝুলছে। বারি-২ ও বারি-৪ জাতসহ অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানি বিভিন্ন প্রজাতির মাল্টার চাষ হচ্ছে শেরপুর এলাকায়। বিদেশি রঙিন মাল্টার মতো এ মাল্টার রঙ সবুজ হলেও স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয় এবং এর পুষ্টিগুণও অনেক বেশি।

চাষি তৈয়ব আলী জানান, বিদেশি মাল্টার মতো রঙ আনতে কেমিকেল ব্যবহার করলেই আধ ঘণ্টার মধ্যেই এর রঙ বাজারের বিদেশি মাল্টার মতোই হয়ে উঠে। কিন্তু তারা সেটা করেননি। দেশীয় প্রাকৃতিক সবুজ রঙের মাল্টাতেই সাধারণ মানুষের মন আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে পরিপূর্ণ মাল্টার রঙ প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা হালকা কাঁচা হলুদের রঙ আসে।

এসব মাল্টা শেরপুর জেলাসহ ঢাকায় বেশ চাহিদাও রয়েছে। শেরপুরের খোলা বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।

কৃষক আব্দুল বাতেন জানান, প্রথম যখন মাল্টা চাষ শুরু করেন তখন স্থানীয়রা হাসতেন এবং বলতেন ছেলেটার মাথা খারাপ হয়েছে। বিদেশি ফল কি এখানে হবে! কিন্তু যখন মাল্টার ফলন হলো এবং খেতে বিদেশি মাল্টার চেয়ে অনেক সুস্বাধু, তখন তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠে। দিন দিন আমাকে দেখে আশপাশের অনেকেই ঝুঁকে পড়েছেন মাল্টা চাষে।

এ বিষয়ে দেশিয় ফল নিয়ে কাজ করা অনলাইন উদ্যোক্তা এবং আওয়ার শেরপুর ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা দেলোয়ার হোসেন বলেন, গারো পাহাড়ে উৎপাদিত মাল্টা ই-কমার্সের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে পরিকল্পনা করেছি। তাই ঝিনাইগাতী এলাকায় বেশ কয়েকটি বাগান পরিদর্শনে গিয়েছি এবং মাল্টা খেয়েছি। অন্যান্য মাল্টার চেয়ে স্বাদে ভিন্নতা রয়েছে শেরপুরের মাল্টার।

ঝিনাইগাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, এ এলাকার আবহাওয়া ও জলবায়ু সাইট্রাস (লেবু) জাতীয় ফল চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। সাইট্রাস ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পের আওতায় কৃষকদের প্রশিক্ষণসহ বিনামূল্যে বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করা হয়েছে।

এ সম্পর্কে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক ড. মুহিত কুমার দে বলেন, জেলায় সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকার ঝিনাইগাতী, নালিতাবাড়ী ও শ্রীবরর্দীসহ সদর উপজেলাতে মোট ২৪ হেক্টর জমিতে মাল্টার চাষ হচ্ছে। এসব মাল্টা দেশে উৎপাদিত অন্যান্য জেলার মাল্টার চেয়ে অনেকগুণ বেশি সুস্বাদু। এছাড়া আশা করা হচ্ছে আগামীতে জেলায় মাল্টার আরো আবাদ বাড়বে।

(ঢাকাটাইমস/১৭সেপ্টেম্বর/কেএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :