শিক্ষিতরা সৎ হলে অব্যবস্থা দূরে থাকবে

শরদিন্দু ভট্টাচার্য্য টুটুল
| আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:২৯ | প্রকাশিত : ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১৮:১১

আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের কথাই বলুন আর চিকিৎসাব্যবস্থার কথা, খাতটাকে যে নামেই ডাকুন, এই খাতের অবস্থা কিন্তু ভালো নয়। একশ্রেণির চিকিৎসকের অমানবিক আচরণ কিংবা তাদের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয়, তারা ভুলেই গেছেন চিকিৎসাসেবার মতো মহান পেশাটা বাজারের আর সব ব্যবসার মতো নয়। চিকিৎসা পেশা মানবিক সেবার একটি বিশেষ দিক।

কিন্তু দুঃখজনক হলো, এর মধ্যে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বহু ক্লিনিক ব্যবসায়ী ধরে নিয়েছে যে, যেহেতু দেশের অসহায় মানুষ চিকিৎসার মতো জটিল বিষয়টা তেমন কিছুই বোঝে না, তাই তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন কৌশলে টাকা পয়সা চুষে নিয়ে আসো। সরকারি হাসপাতালে বিভিন্ন ক্লিনিকের নিয়োগ করা দালালদের উপদ্রবে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে।

দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক ক্লিনিকের সামনে ঝুলিয়ে রাখা সাইনবোর্ডে দেখা যায় অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তারের নাম। প্রচলিত আছে সাইনবোর্ডে ডাক্তারদের নাম লেখা থাকলেও বাস্তবে তাদের বেশির ভাগ কখনো ওই ক্লিনিকগুলোতে যান না। তারা কেবল রোগী আকর্ষণের শোভাবর্ধনকারী। তার মধ্যে আবার আমরা পত্রপত্রিকায় দেখতে পাই বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভুয়া ডাক্তারদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় দেখে থাকি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধৃত ‘ডাক্তার’ পদবিধারী ব্যক্তিটি মাধ্যমিকের গণ্ডিই পার হয়নি। আবার অনেক সময় দেখা যায় ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভ পাস করা ব্যক্তিরা নিজেদের নামের পাশে বড় বড় ডিগ্রি লাগিয়ে নিজেদের ডাক্তার হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে এবং মানুষের অপচিকিৎসা করে যাচ্ছে। যখন ধরা পড়ে তখন আসল সত্য বেরিয়ে আসে। তখন এ নিয়ে জেলার সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জনকে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদোত্তর দিতে পারেন না।

অনেক সময় দেখা যায়, সিভিল সার্জনের নাকের ডগার ওপর দিয়ে কিছু অসৎ মানুষেরা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ছেলেখেলা করছে। অনেকেই বলে থাকেন ভুয়া ডাক্তার ও অসৎ ক্লিনিক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বাস্থ্য বিভাগের অসৎ কর্তাব্যক্তিরা টাকা-পয়সা খেয়ে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বলতে গেলে খাদের কিনারে দাঁড় করিয়েছেন।

বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে যখন কোভিড-১৯ ভাইরাস হানা দেয়, তখন পৃথিবীর সব কোনার মানুষের জীবন-যাপন এলোমেলো কিংবা তছনছ হয়ে যায়। ইউরোপসহ পৃথিবীর শীতপ্রধান দেশের মানুষ এই কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বলতে গেলে অমানবিক জীবন যাপন করতে থাকে। পৃথিবীর মানুষকে কোভিড-১৯ ভাইরাসের আতঙ্ক এতটাই পেয়ে বসে যে, মানুষ আপন সন্তানকে কাছে টানতে দ্বিধা করতে থাকে কিংবা বন্ধুবান্ধব, আপন সন্তানকে কাছে আসতে না দিয়ে দূরে রাখতে থাকে। কোভিড-১৯ ভাইরাসের তাণ্ডবলীলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশে মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এই মৃত্যুর মিছিল কোথায় গিয়ে থামবে কেউ বলতে পারছে না। মৃত্যুর হিসাব এখানেই যে থেমে থাকবে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

কোভিড-১৯ ভাইরাসের তাণ্ডবলীলার মধ্যেই আমরা দেখতে পাই লোভী বর্বর দুর্নীতিবাজ মানুষের আনন্দের নৃত্য। এত মৃত্যু দেখেও তাদের মধ্যে বিন্দুমাত্র বোধোদয় ঘটেনি। তারা বরং একে ব্যবসার ধান্ধা করে নিয়েছে। তারা মানুষের দুরবস্থা নিয়ে তাদের দুর্নীতি ও অমানবিকতা চালিয়ে যেতে থাকে। এই মহামারিতে আমাদের দেশমাতৃকার মানুষের যখন করুণ অবস্থা, তখন এসব শিক্ষিত দুর্নীতিবাজরা ভাইরাসের দোহাই দিয়ে শুরু করল তাদের অনৈতিক ব্যবসাপাতি। ভাইরাসের সুযোগ নিয়ে তারা দেশের সাধারণ মানুষের পকেট কাটতে শুরু করল। আর তখনই আমরা দেশবাসী জানতে পারি রিজেন্ট কিংবা জেকেজির মতো নৈতিকতাহীন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের কথা। তখন মানুষ দেখতে পায়, এ দেশের লেখাপড়া জানা একশ্রেণীর মানুষ কতটা নিষ্ঠুর আর ধান্ধাবাজ হতে পারে।

বিশ^জুড়ে চলমান এই অসহায় কালে দেশের মানুষের করুণ অসহায়ত্বকে পুঁজি করে একশ্রেণির লোক লুটপাটের উদ্বাহু নৃত্য জুড়ে দিল। তারা মানুষের পকেট কাটতে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তারা ভুলে গেল সব শুরুরই যেমন একটা শেষ আছে, তেমনি সব অন্যায়ের একটা সীমা আছে। এই আপ্তবাক্যের জোরেই হয়তো আমরা দেশবাসী জানতে পারলাম সাহেদ ও ডা. সাবরিনার কথা। সাহেদের হাত এতই লম্বা ছিল যে, দেশের উচ্চস্তরের মানুষের সাথে তার উঠাবসা চলাফেরা। এমনকি দেশের উচ্চস্তরের মানুষের চেম্বার থেকে শুরু করে তাদের সর্বত্র তার যাওয়া-আসা। আবার দেখা যায় টিভির টকশোতে কথা বলে সে আমাদের মতো মানুষকে ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দের ছবক দিচ্ছে।

প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাসের আমার জানামতে (যদি ভুল না করে থাকি) একটা গান আছে এ রকম- ‘থাকিলে ডোবাখানা হবে কচুরিপানা/ বাঘে মহিষে খানা একসাথে খাবে না/ মরি স্বভাব তো কখনো যাবে না।’

আমাদের দেশের নৈতিকতা-বর্জিত মানুষ যতই লেখাপড়া করে আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি, সাংবাদিক, লেখক, গায়ক হোক না কেন, তাদের আসল স্বভাব যদি হয় পরধন হরণ করা, তাহলে সে স্বভাব কখনো সহজে যায় না। যা আমরা নষ্ট মানুষের বাস্তব জীবনে কর্মকাণ্ড দেখেই বুঝতে পারি।

আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, লেখাপড়া করে আইনজীবী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, কবি, সাংবাদিক, লেখক, গায়ক হয়ে দামি কাপড় পরে দামি গাড়িতে চড়লেই ভদ্রলোক হওয়া যায় না। ভদ্রলোক হতে হলে নৈতিকতার প্রয়োজন হয়। একটা মানুষের মধ্যে নৈতিকতা তখনই দেখা দেয় যখন সে ন্যায়-অন্যায় বোধ বিচার করে নৈতিকতার চর্চা করে।

একশ্রেণির মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ কতটা নিচে নামলে তারা মৃত চিকিৎসকের সই দিয়ে কোভিড-১৯ পরীক্ষার রিপোর্ট দিয়ে থাকে মানুষকে! সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ ভাষ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এক চিকিৎসকের নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে রোগীদের প্যাথলজি রিপোর্ট দিত খোদ রাজধানীর শ্যামলীর একটি চিকিৎসা সেন্টার। পরে ওই প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়া হয়। সেখানে অভিযান চালালে সেন্টারটিতে ভুয়া ল্যাবের সন্ধান পাওয়া যায়। সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেট বলেন, শ্যামলীর চিকিৎসা সেন্টারটি হার মানিয়েছে রিজেন্ট কিংবা জেকেজিকেও। প্রতিষ্ঠানটি মে মাসে মারা যাওয়া এক ডাক্তারের নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করে অক্টোবরেও রিপোর্ট দিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার হলো, সেন্টারটিতে এক-দুটি টেস্ট করা হতো, আর বাকিগুলোর রিপোর্ট দেওয়া হতো অনুমানের ওপর ভিত্তি করে। এই যদি হয় আমাদের বেসরকারি চিকিৎসাসেবার চিত্র, তাহলে আমরা সাধারণ অসহায় দেশবাসী তলানির কোন পর্যায়ে আছি!

মূলত আমাদের অসৎ কর্তাব্যক্তিরা ভুলে গেছেন তাদের কোনো না কোনো দায়িত্ব দিয়ে মানুষের মঙ্গলের জন্য সরকার বসিয়েছেন। তাদের কাজ হলো মানুষের সেবা করা এবং বিভিন্ন অব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব চুরি-চামারি প্রতিরোধ করা। কিন্তু একশ্রেণীর কর্তাব্যক্তি যদি দায়িত্বহীন, জ্ঞানহীন মানুষের মতো তাদের ওপর অর্পিত দায়-দায়িত্বের কথা ভুলে নিজেরাই দুর্নীতিতে লিপ্ত হন, তাহলে মৃত ডাক্তারের নাম স্বাক্ষর ব্যবহার করে কোভিড-১৯ ভাইরাসের রিপোর্ট দেওয়া তো হবেই। খেতের বেড়া যদি গৃহস্থের ফসলে মুখ দেয়, তাহলে কি কোনো ফসল চাষি তার ঘরে তুলতে পারবে? প্রবাদ আছে, শুঁটকির নৌকার বিড়াল যদি হয় মাঝি, তাহলে সেই শুঁটকি কখনো গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে না। আসলে এখন সর্বত্র একশ্রেণির দুষ্ট মানুষের আধিপত্য বিরাজ করছে। ভালো মানুষের কোথাও স্থান পাওয়া কঠিন।

এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ দেশের সাধারণ অসহায় মানুষ দুর্নীতি কিংবা লুটপাট করে না। এ দেশে দুর্নীতি ও অনিয়ম করে একশ্রেণির শিক্ষিত ভদ্রলোক। দুর্নীতিবাজ শিক্ষিত ভদ্রলোকরা যদি সৎ হয়ে যান, তাহলেই দেশের মানুষ সুখে থাকবে এবং সব অনিয়ম থেকে রক্ষা পাবে।

লেখক: আইনজীবী, কবি ও গল্পকার, হবিগঞ্জ।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :