ফেনীতে প্রাথমিক স্কুলে ২৭৪ শিক্ষকের পদ শূন্য
প্রধান শিক্ষকের গুরুত্বপূর্ণ পদটি শূন্য রেখেই বছরের পর বছর চলছে ফেনীর প্রায় অর্ধশতাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাঠদানসহ শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার নেতৃত্ব দেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু বর্তমানে এ জেলায় ৫৩ জন প্রধান শিক্ষক ও ২২১ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্বিক কার্যক্রমের নেতৃত্ব ও তদারকিতে বেশ স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
দীর্ঘদিন যাবত শিক্ষক সংকট থাকায় জেলার উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের পাচ্ছে না প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীরা স্কুলে ভর্তি হয়ে পড়ালেখায় মৌলিক তত্ত্বাবধান ও প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শিগগিরই শিক্ষক সংকট সমাধান না হলে আগামীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট দেখা দেবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টদের।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস জানায়, ফেনীর ৬ উপজেলায় ৫৫৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৩ জন প্রধান শিক্ষক ও ২২১ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে ফেনী সদর উপজেলার ১৫১টি স্কুলের ১৬টিতে প্রধান শিক্ষক ও ৯ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
একইভাবে দাগনভূঞা উপজেলার ১০২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে একটিতে প্রধান শিক্ষক ও ৫৩ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য। সোনাগাজীর ১১০টি স্কুলের মধ্যে ১৮টিতে প্রধান শিক্ষক ও ৭৪ জন সহকারী শিক্ষক পদ শূন্য। ছাগলনাইয়ায় ৭৮টি স্কুলের ৩ জন প্রধান শিক্ষক ও ২৯ জন সহকারী শিক্ষক, পরশুরামের ৫১টি স্কুলের ৪ জন প্রধান শিক্ষক ও ২২ জন সহকারী শিক্ষক, ফুলগাজীর ৬৭ স্কুলের ১১ জন প্রধান শিক্ষক ও ৩৪ জন সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে।
এছাড়াও জেলায় সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ২৫টি পদের মাঝে ১৩টিতে জনবল পদায়ন হয়নি। জেলায় সহকারী মনিটরিং অফিসার, কম্পিউটার অপারেটর ও ক্যাশিয়ারের একটি করে পদ থাকলেও বছরের পর বছর তা শূন্য পড়ে আছে। অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের ১৩টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র ৪ জন। একইভাবে দীর্ঘদিন যাবত অফিস সহকারীর ১০ পদের মধ্যে ৭ পদই খালি অবস্থায় রয়েছে।
দাগনভূঞা সিন্দুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি সুমন চন্দ্র ভৌমিক জানান, উপজেলার বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক না থাকায় প্রশাসনিক কাজে তৈরি হচ্ছে স্থবিরতা, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সহকারী শিক্ষক না থাকায় পাঠদান কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে জনবল নিয়োগ ও পদোন্নতি বন্ধ থাকায় এমন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
সোনাগাজী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা কর্মকর্তা মো. ওয়াহিদুর রহমান জানান, দক্ষিণ চর ছান্দিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পালগিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হাজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে ২ জন শিক্ষক দিয়ে। এছাড়াও উপজেলার দাগনপাড়া মোশাররফ হোসেন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, জয়নাল আবেদীন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০১৩ সালে জাতীয়করণের পর থেকেই প্রধান শিক্ষক নেই। কোনো রকম জোড়া তালি দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২০১২ সালের পর আর সরাসরি প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বিলম্বিত হয়েছে সহকারী শিক্ষকের পদোন্নতিও। কয়েক বছর আগে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়েছে প্রধান শিক্ষক। করোনাভাইরাস মহামারির সময় শূন্য পদ নিয়ে অনলাইনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো চালানো গেলেও, নিয়মিত স্কুল শুরু হওয়ার পর দেখা দিতে শুরু করেছে নানা সমস্যা।
বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, করোনাকালে শ্রেণি কার্যক্রম নিয়মিত না থাকায় শিক্ষক কর্মচারী সংকট থাকলেও তেমন কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি। গত ১৪ মার্চ থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পুরোপুরি চালুর ঘোষণা হলে পরিপূর্ণ জনবল কাঠামো জরুরি হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদে জনবল কম থাকায় প্রশাসনিক ও শ্রেণি কার্যক্রমে প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়ছে।
শিক্ষা বিভাগ জানায়, প্রধান শিক্ষক না থাকায় সিনিয়র সহকারী শিক্ষকদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে জোড়াতালির মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করালেও তাতে গতি আসছে না। শিক্ষক শূন্যতাসহ নানাবিধ সংকটের কারণে জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের ভর্তি করাতে আগ্রহ হারাচ্ছে অভিভাবকরা। অভিভাবকদের অভিযোগ, প্রধান শিক্ষকের শূন্যতায় অনেকটা দায়সারাভাবে সহকারী শিক্ষকরা পাঠদানের নামে সময় পার করছেন। শিক্ষক সংকটে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পাচ্ছে না। পাঠ্যসূচি অনুযায়ী পড়ালেখা নিয়েও হতাশায় রয়েছেন তারা। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনেও পিছিয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অভিভাবকরা।
ফেনী সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. সাইফুর রহমান জানান, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পদোন্নতি ও নিয়োগ দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু প্রতি বছরই অনেক শিক্ষক অবসরে যাচ্ছেন। এতে দিন দিন শিক্ষক সংকট বাড়ছে।
তিনি জানান, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো কষ্টসাধ্য। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ না থাকায় তারা দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক কাজ তেমন বোঝেন না। অনেক ক্ষেত্রে উপজেলা ও জেলা কার্যালয় থেকে তাদের বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও সঠিকভাবে কাজ আদায় করা যায় না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরুল ইসলাম জানান, সরকারি বিধি মোতাবেক ৬৫ ভাগ সহকারী শিক্ষক পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পান। ৩৫ ভাগ নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পদোন্নতি বন্ধ থাকায় দিন দিন প্রধান শিক্ষকের শূন্য পদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সহকারী শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর করোনা মহামারি শুরু হওয়ায় নিয়োগ কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় নিয়োগ কার্যক্রমের বাকি ধাপগুলো শুরু হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী নিয়োগ সম্পন্ন হলে শিক্ষক সংকট কেটে যাবে বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
(ঢাকাটাইমস/০৬মে/এআর)