মানবমুক্তির দূত ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ

হুমায়রা তাবাসসুম
 | প্রকাশিত : ১৪ আগস্ট ২০২২, ১০:৪৩

তখন আমি চিনতাম না মানুষটিকে। মনে ধরার মতো ব্যক্তি হওয়ার পরও ইন্টারনেটের সাহায্য নিয়ে যে বিস্তারিত জানব তার সুযোগও হয়ে ওঠেনি আমার তখন।

চার-পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশের সরকারি টেলিভিশন বিটিভিতে একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে একজন অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও সমাজ চিন্তাবিদ এবং তাঁর সহধর্মিণীর সাক্ষাৎকার আমি বিমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। সেদিন আমাকে অবাক করেছিল বিশেষ করে তাঁর সহধর্মিণী। আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এবং প্রশ্নও ছিল তাঁরা এত বড়মাপের মানুষ হয়েও কীভাবে গণমানুষের জন্য, পল্লীর জনগণ নিয়ে তাদের চেষ্টা ও চিন্তা দিয়ে নিজেকে অনায়াসেই বিলিয়ে দিচ্ছেন। এটাও সম্ভব?

সত্যিকার অর্থে আমি বিশ্লেষণ করছিলাম তারা আর আট-দশজন মানুষের মতো চাকচিক্যপূর্ণ পোশাকে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানটিতে উপস্থিত হননি। আমার ছোট্ট চিন্তার পরিধিতে এটুকুই প্রতীয়মান হয়েছিল সেদিন যে তাঁরাই খাঁটি দেশপ্রেমিক। দেশের তাঁত ও তার ঐতিহ্যই তাদের দেহাবরণে জাজ্বল্যমান।

ঠিক এই কারণটা নিয়েই মানুষটিকে নিয়ে আমার কৌতূহল আর ভালো লাগার শুরু। পরবর্তী সময়ে আমি যখন স্নাতকে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, হঠাৎই জানতে পারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত প্রতিষ্ঠান ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্স সম্পর্কে। যেখানে অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্লেষিত শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। যথাযথ নিয়মেই আমি ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। ভাইভাতে যখন যাই আমি তখনও জানতাম না প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে। আমাকে সেখানে প্রশ্ন করা হলো-

- তুমি উদ্যোক্তা অর্থনীতি পড়ে কী করতে চাও?

- ছোটবেলায় যখন বাণিজ্য মেলায় যেতাম সব ছাপিয়ে তাঁতের তৈরি কাপড়ের কিংবা বাঁশ, বেতের জিনিসপত্রই আমাকে কেন জানি আকর্ষণ করত। আমি বাংলাদেশের বেত ও তাঁত নিয়ে কাজ করতে চাই।

উত্তরটা আমার সেই কেন্দ্রিকই ছিল।

  • তোমার এই নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

হঠাৎই চোখে পড়ল সুদর্শন, মিষ্টভাষী সেই মানুষটিকে। আমার হাত-পা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকে। এই কি সেই মানুষ, যাঁকে ৪-৫ বছর আগে আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম! উনি কি সেই একই মানুষ যাঁর অবদানে আধুনিক অর্থনীতি এমন উৎকর্ষের শীর্ষে আরোহণ করছে!

ভাইভা থেকে বেরোতেই আমি জানতে পারি তিনিই সেই অর্থনীতিবিদ যিনি মানবমুক্তির বিভিন্ন অধ্যায় সম্পূর্ণ করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের কল্যাণে এই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা করেছেন।

সৃষ্টিকর্তার কী অপার কৃপা, আমি মানুষটিকে কাছ থেকে জানার ও চেনার সুযোগ পেয়ে যাই। সুযোগ হয়ে গেল মানুষটির চিন্তাগুলো জানার। সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার-বিবেচনার দিক দিয়ে সব গবেষক, অর্থনীতিবিদ আমার কাছে সমান শ্রদ্ধেয় হলেও ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যারের অপূর্ব বাচনভঙ্গি, সুনির্বাচিত শব্দাবলির উচ্চারণ আর সহানুভূতিসমৃদ্ধ স্নেহসুধা আমায় আচ্ছন্ন করে রাখে।

ধীরে ধীরে এখন আমি বুঝতে পারি, তিনি আমার জীবনের অনুসরণীয় একজন ব্যক্তিত্ব। পৃথিবীতে অনন্য প্রতিভার অধিকারী যে স্বল্প কজন ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, ড. কাজী খলিকুজ্জমান আহমদ স্যার তাঁদের অন্যতম। তিনি মূলত একজন সমাজ সংস্কারক, পরহিতব্রতী ও খাঁটি দেশপ্রেমিক, যিনি জাতিকে প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন তার কর্মের দ্বারা। তিনি তাঁর প্রতিভার জাদুকরী স্পর্শে বাংলাদেশকে বিশ্ব অঙ্গনে অশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। শিল্প-সাহিত্যের সব শাখায় তিনি অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন।

বাংলার অর্থনীতিতে যে সুরটি ধ্বনিত হচ্ছে তা পূর্ণতার সুর, তৃপ্তির সুর। তাঁর যে দেশপ্রেম তা এসেছে অখণ্ড নিসর্গানুভূতি থেকে। প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, সমগ্র গ্রাম, বাংলার মানুষের সুখ-দুঃখের, তাদের সমসাময়িক জীবন ও সমস্যা নিয়ে তাঁর যে অনুসন্ধিৎসু চিন্তাধারা তা এ বাংলার ইতিহাসে চিরঅম্লান হয়ে থাকবে।

কর্মজীবনে সদা সৎ ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অধিকারী ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যার ২৩ বছর ধরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এবং এর পূর্বতন পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিক্সে (পিআইডিই) গবেষণা পেশায় এবং কয়েক বছর গবেষণা পরিচালক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ১৯৮৭ সালে বিআইডিএসের গবেষণা থেকে ইস্তফা দেন, ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন এবং এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে যোগ দেন।

তিনি ২০০৯ সালের নভেম্বর মাসে পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি পদ লাভ করার পর বাংলাদেশ উন্নয়ন পরিষদ থেকে ইস্তফা নেন। তিনি ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের প্রতিষ্ঠাতা, যা ২০১০ সালের আগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত টানা তিনবার বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের সর্বোচ্চ পরিষদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন।

তিনি বর্তমানে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের গঠনতন্ত্রের বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি দলের সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ২০১৫ পূর্ব টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার জাতিসংঘের ওপেন ওয়ার্কিং গ্রুপে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন। এ ছাড়া তিনি কিয়োটো প্রটোকলের এক্সিকিউটিভ বোর্ড অব ক্লিন ডেভেলপমেন্টের সদস্য হিসেবে নন-অ্যানেক্স-১ দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন।

মানুষ গড়ার কারিগর শ্রদ্ধেয় খলীকুজ্জমান আহমদ স্যারের গবেষণা প্রবন্ধ ও রিপোর্টের সংখ্যা দুই শ পঞ্চাশের বেশি। দেশে ও বিদেশে একক এবং যৌথভাবে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ৪০। নিম্নে কয়েকটি বইয়ের নাম উল্লেখ করা হলো:

২০২০: ক্লাইমেট অ্যাডাপটেশন ফর এ সাসটেইনেবল ইকোনমি: লেসন্স ফ্রম বাংলাদেশ, এন এমার্জিং টাইগার অব এশিয়া (সহ-সম্পাদক), নোভা সায়েন্স পাবলিশার, নিউইয়র্ক, ইউএসএ।

২০১৯: পার্সপেক্টিভ অন পিপল সেন্টারড ডেভেলপমেন্ট উইথ পার্টিকুলার রেফারেন্স অব বাংলাদেশ, আলোঘর প্রকাশনা, ঢাকা।

২০১৮: সোসিও-ইকোনমিক্স অব বাংলাদেশ থ্রু টি ডিকেডস, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।

২০১৭: এনভায়রনমেন্ট, ক্লাইমেট চেঞ্জ ও ওয়াটার রিসোর্সেস, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।

২০১৬: সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অল দেট, পাঠক সমাবেশ, ঢাকা।

২০০৯: ট্যাকলিং সোশ্যাল এক্সক্লুশন: সাউথ এশিয়া, ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

২০০৮: ইন্টারলিংকিং অব রিভারস ইন ইন্ডিয়া: ইস্যুজ অ্যান্ড কনসার্ন্‌স, সিআরসি প্রেস, ২৮ জুলাই, ২০০৮।

২০০৭: সোশিও-ইকোনমিক অ্যান্ড ইনডেটনেস-রিলেটেড ইমপ্যাক্ট অব মাইক্রো-ক্রেডিট ইন বাংলাদেশ, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ।

২০০৫: ইমার্জিং ইকোনমিক অর্ডার অ্যান্ড দ্য ডেভেলপিং কান্ট্রিজ, (সম্পাদক), ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।

২০০৫: ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্সেস ইন সাউথ এশিয়া (সহ-সম্পাদক), ফ্রান্সিস অ্যান্ড টেইলর।

গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা রিজিয়ন: অ্যা ফ্রেমওয়ার্ক ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (সহ-সম্পাদক), ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড (ইউপিএল)।

১৯৯৬: দ্য ইমপ্লিকেশন্স অব ক্লাইমেট অ্যান্ড সি-লেভেল চেঞ্জ ফর বাংলাদেশ (সহ-সম্পাদক), ক্লুওয়ার অ্যাকাডেমিক পাবলিশার্স।

১৯৮৪: রুরাল পোভার্টি অ্যালিভেশন ইন বাংলাদেশ এক্সপেরিয়েন্সেস অ্যান্ড পলিসিস (সহ-সম্পাদক)।

গণমানুষের মুক্তির জন্য তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেক পদকে ভূষিত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে:

সমাজসেবায় স্বাধীনতা পুরস্কার (২০১৯), জাতীয় পরিবেশ পদক (২০১৯), বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির স্বর্ণপদক (২০১২), সমাজসেবায় একুশে পদক (২০০৯), ২০০৭ সালের শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ইন্টারগভর্নমেন্ট প্যানেল অব ক্লাইমেট চেঞ্জের সদস্য, মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার (২০০৫) ইত্যাদি পুরস্কার ছাড়াও আরও অনেক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা।

আমি আমার ক্ষুদ্র উপলব্ধি দ্বারা বলতে চাই, মানবমুক্তির, জাতীয় ও অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রদূত ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যার সর্বোপরি একজন আদর্শ শিক্ষক, যিনি স্নেহে পিতা, বিপদে বন্ধু, অসংখ্য মানবীয় গুণে গুণান্বিত এবং দেশকে আঁধার থেকে আলোতে নিয়ে আসার যে অপার ক্ষমতা সেই বিদ্যাদানে অতিশয় দক্ষতাসম্পন্ন।

জাতীয় অর্থনীতির মুক্তির মহানায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যারের হাত ধরেই বাংলাদেশের আধুনিক অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত আছে। অর্থনৈতিক মুক্তির সূত্র ধরেই মানুষ এগিয়ে চলে সভ্যতা আর সংস্কৃতির পথে। অর্থনৈতিক মুক্তিই আনন্দ, অভিসারের পথ। আর এই আনন্দ, এই পথ লাভের জন্যই উপযুক্ত পরিবেশে বাংলাদেশকে অবগাহন করানোর অকৃত্রিম রূপটি দিতে সংকল্পবদ্ধ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ স্যার।

তার কর্মপ্রচেষ্টা শুধু অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি চারপাশের জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন। শৃঙ্খলাকে তিনি সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। সু-আচরণকে তিনি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করেন। সততা, আন্তরিকতাকে তিনি সাফল্যের উপায় হিসেবে আখ্যায়িত করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে তাঁর আদর্শ ব্যক্তিত্বের এ ধরনের অনুশীলন পরিবেশকে পাঠের যথার্থ অনুকূল করে তোলে। জীবনকে সুন্দর করার জন্য এসব উপকরণ আমাদের কাছে মূল্যবান সম্পদ হয়ে থাকুক। এই মানবমুক্তির দূত, এই মহান শিক্ষকের কাছে যা শিখলাম ও জানতে পারলাম তা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মতো আদর্শবান, নিষ্ঠাবান মানুষ পৃথিবী বদলে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের উদ্যোক্তা অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :