টেকনাফে লবণ উৎপাদন শুরু, আমদানি সিন্ডিকেটের ভয় চাষিদের

ছৈয়দ আলম, কক্সবাজার
 | প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর ২০২২, ১৫:২৪

টেকনাফের হ্নীলা মৌলভীবাজার এলাকার লবণ চাষি মিজানুর রহমান। প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ কানি লবণ মাঠে চাষ করেন। এ বছরও ১৫ কানি মাঠে চাষ করতে মাঠে নেমেছেন। গত শুক্রবার বিশেষ দোয়া প্রার্থনা করে মাঠে নেমেছেন। তার ভাষ্য, এ মৌসুমে তিনি টেকনাফে লবণ চাষে প্রথম মাঠে নেমেছেন। তার শুধুই আকুতি-টেকনাফ-কক্সবাজারে প্রচুর লবণ আমদানি হয়। দেশের লবণ মাঠে পড়ে থাকে। মাঝে মধ্যে মওসুমে ঝড়-বৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড় হলে হাজার হাজার টন লবণ পানিতে তলিয়ে যায়। তবুও দেশে লবণ মজুদ থাকে। দামও ভালো পাওয়া যায়।

তার মতো হ্নীলা উলুচামরী কোনারপাড়ার চাষি জাফর আলম। তিনিও ৬০ কানি মাঠে লবণ চাষে মাঠে নেমেছেন। তার রয়েছে ১৫ জন চাষি। তারা ইতোমধ্যে চৌধুরীপাড়া, কোনাপাড়া ও রংগীখালী এলাকায় মাঠে পুরোদমে কাজ করছেন। কাল বা পরশু মাঠ ভিজিয়ে লবণ উৎপাদনের শেষ মুহূর্তের কাজ শেষ করবেন। তিনিও দেশীয় লবণ বিক্রির লাভে আশা প্রকাশ করেন।

কুতুবদিয়ার লেমশীখালী ইউনিয়নের রাহাত্তারবিল এলাকায় লবণ মাঠে কথা হয় চাষি নুরুল কবিরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, গতবছরের ন্যায় এ বছরও লবণের ন্যায্য মূল্যের আশায় মাঠে নেমেছি। এখন আমরা কক্সবাজারে প্রথম লবণ উৎপাদন করেছি। গেল মাস থেকে দ্বীপের সব চাষি লবণ তুলছেন। দাম পেয়ে ভালো লাগছে।

এভাবে চলতি লবণ উৎপাদন মৌসুমে কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, টেকনাফ উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় লবণ উৎপাদনের জন্য মাঠ তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।

ইতোমধ্যে অনেক স্থানে শুরু হয়ে গেছে লবণ উৎপাদন। সাধারণত আবহাওয়া লবণ চাষের অনুকূলে থাকলে এবং উৎপাদন মৌসুমে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা গেলে চাষিরা দিনরাত শ্রম দিয়ে বিসিকের লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি লবণ উৎপাদন করতে পারবেন বলে আশা করছেন। গেল মাস থেকে কুতুবদিয়া-পেকুয়াসহ কয়েকটি এলাকায় লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে অধিকাংশ প্রান্তিক লবণচাষি সহায়-সম্বলহীন হওয়ায় মহাজনের টাকায় লবণ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন বরাবরের মতো। আমন মৌসুম শেষে ধান কাটার পর ইতিমধ্যে লবণ উৎপাদনের মাঠ তৈরীতে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের অন্যতম লবণ উৎপাদনের জেলা কক্সবাজার। এই জেলার প্রায় ৪৩ হাজার চাষি পুরোদমে লবণ উৎপাদনের প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে লবণ মাঠ পরিচর্যা। আবহাওয়া অনুকুলে থাকলে আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে লবণ উৎপাদন শুরু হবে বলে আশা করছেন চাষিরা। দেশের এক তৃতীয়াংশ লবণের চাহিদা পূরণ করে কক্সবাজার জেলার উৎপাদিত লবণ। গত বছর নানা প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও চাষিরা লক্ষমাত্রার কাছাকাছি লবণ উৎপাদনে সক্ষম হয়। বিশেষ করে ঘন ঘন দূর্যোগ ও বৈরী আবহাওয়া ছিল গত বছর।

কক্সবাজারে দুই ধরনের পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়। একটি হলো সনাতন পদ্ধতি কালো লবণ, অপরটি পলিথিন পদ্ধতিতে সাদা লবণ।

চাষিরা বলছেন, উৎপাদিত লবণ চলতি বছরে দেশের চাহিদা মিটাবে কিনা তা সন্দেহ রয়েছে। কেননা অধিকাংশ বেড়িবাঁধ এখনো মেরামত হয়নি। বিশাল লবণ উৎপাদন জোন পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ ও সদর উপজেলার হাজার হাজার একর লবণ মাঠে চলছে জোয়ার-ভাটা। এ জমিতে চলতি বছর চাষিরা লবণ উৎপাদনে সন্দিহান।

এদিকে লবণ মিল মালিকরা বলেন, দেশের একটি মুনাফালোভী চক্র প্রতিবছর সিন্ডিকেট করে বিদেশ থেকে লবণ আমদানির অশুভ পাঁয়তারা করে থাকে। যা দেশের লবণ শিল্পে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। যদি নানা অজুহাতে লবণ আমদানি করা হয় তা হলে লবণের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হবেন। লবণ চাষিদের দাবী, অবিলম্বে কক্সবাজারে স্থায়ী লবণ বোর্ড এর মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে লবণের মূল্য নির্ধারণ, প্রান্তিক লবণ চাষিদের সহজ শর্তে সুদমুক্ত ঋণদান ও বিদেশ থেকে লবণ আমদানি পারমিট বন্ধ করে দেশীয় লবণ শিল্পকে রক্ষা করতে হবে। প্রান্তিক লবণ চাষিরা দেশের অর্থনীতি ও লবণ শিল্পকে ধংসের হাত থেকে বাঁচাতে অবিলম্বে মাঠ পর্যায়ে সরকারীভাবে লবণ ক্রয়ের ব্যবস্থা করে লবণের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবী জানান।

জানা গেছে, প্রাকৃতিক পরিবেশ ভালো থাকায় দেশের একমাত্র লবণ উৎপাদন এলাকা কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী অঞ্চলের ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষে নেমেছেন চাষিরা। এরইমধ্যে গত দুই নভেম্বর মৌসুমের প্রথম দফায় মাঠ থেকে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে এবং ডিসেম্বর মাসের প্রথমদিক থেকে প্রতিটি মোকামে পুরোদমে লবণ উৎপাদন নিশ্চিত হবে এমনটাই জানিয়েছেন বিসিক কক্সবাজার। মৌসুমের শুরু থেকে আবহাওয়া লবণ উৎপাদনের অনুকূলে থাকায় বিরতিহীনভাবে চলছে লবণ চাষ। এবার মৌসুমের শুরুতেই কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার উপকুলীয় অঞ্চল, পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী, বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলার সবজমিতে একমাস আগে লবণ চাষ শুরু হয়েছে।

চাষিদের আশা, আবহাওয়ার পরিবেশ এ ধরণের থাকলে দেশে এবার চাহিদার বিপরীতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হবে। সিন্ডিকেট চক্র কর্তৃক বিদেশ থেকে লবণ আমদানির কারণে পরপর বেশ কয়েক মৌসুম চাষিরা বিপুল পরিমাণ লবণ উৎপাদন করেও লোকসান গুণতে হয়েছে। এবার সবকিছু লবণ উৎপাদন সহায়ক থাকায় চাষিদের মুখে ফুটেছে হাসি।

তবে বরাবরের মতো এবারও শিল্প মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের কাছে চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন কম হবে এইধরণের আগাম মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন কতিপয় সিন্ডিকেট চক্র। তাঁরা মূলত দেশে লবণের ঘাটতি দেখিয়ে বিদেশ সোডিয়াম লবণ আমদানির জন্য সব রকমের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইতিমধ্যে অক্টোবরে দেড় লাখ মেট্টিকটন লবণ ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছে। আরো দেড় লাখ লবণ আমদানি করার জন্য আবেদন করেছে অসাধু এই চক্র। তবে লবণ আসতে আসতে এক মাস সময় লাগবে। ততক্ষনে দেশে শতভাগ লবণ উৎপাদন হবে। আমদানির কোন দরকার হবেনা লবণের। মাঠে শুধু লবণ থাকবে।

চাষিদের দাবি সরকার যেন সিন্ডিকেট চাপের মুখে প্রভাবিত না হয়। দেশে যেভাবে লবণ উৎপাদিত হচ্ছে তাতে কোনো ঘাটতিই থাকবে না। এ ব্যাপারে লবণ উৎপাদন, মজুদ ও মূল্য পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয়ে অংশীজন সভা গত ১৫ নভেম্বর মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় বিসিক চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে বিসিক বোডরুম, বিসিক ভবন তেজগাঁও শিল্প এলাকায় অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দেশের লবণ চাষি, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্নস্থরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এতে বিদেশ থেকে লবণ আমদানি না করার গুরুত্বারোপ করা হয়।

কক্সবাজার বিসিক সুত্রে জানা গেছে, প্রতিবছর নভেম্বরের শুরুতে চাষিরা লবণ উৎপাদনে মাঠে নামেন। তবে এবছর একমাস আগে অক্টোবর থেকে মাঠে নেমেছেন চাষিরা। এবার ৩৭ হাজার চাষি লবণ চাষে নিয়োজিত হয়েছেন। মাঠে উৎপাদন কাজে জড়িত থাকে আরো ৭৫ হাজার শ্রমজীবি মানুষ। পরিবহন লোড-আনলোড এবং মিলপর্যায়ে প্যাকেটিং ও বাজারজাত সেক্টর মিলিয়ে দেশীয় লবণ শিল্পে মোট ৫ লাখ মানুষ প্রতিবছর নিয়োজিত থাকেন।

এ বছর মোট ৬৫ হাজার একর জমিতে লবণ চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। তদমধ্যে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া, পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর ও টেকনাফ উপজেলা এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলা (আংশিক এলাকা) থেকে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে বিসিক।

কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য মহেশখালীতে জমি অধিগ্রহণ করায় চলতি মওসুমে ১৫-২০ হাজার একর জমিতে লবণ উৎপাদন হচ্ছে না। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ২৫ হাজার প্রান্তিক চাষিও বেকার হয়ে পড়েছেন। কক্সবাজার জেলা ছাড়া বাঁশখালী উপজেলার কিছু এলাকাতে লবণ উৎপাদন হয়। এ ছাড়া দেশের আর কোথাও লবণ উৎপাদিত হয় না।

কক্সবাজার লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) জাফর ইকবাল ভুঁইয়া বলেন, চলতি মৌসুমে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে চাষ শুরু করা হয়েছে। গত বছর জমির পরিমাণ ৬৩ হাজার ২৯১ একর থাকলেও এবছর চাষের পরিধি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ এবার আবহাওয়ার পরিবেশ বেশ ভালো।

তিনি বলেন, প্রতিবছর নভেম্বর মাসে চাষ শুরু হলেও এবার বিভিন্ন মোকামে একমাস আগে থেকে লবণ চাষে নেমেছেন চাষিরা। এরইমধ্যে কুতুবদিয়া উপজেলার মাঠ থেকে মৌসুমের প্রথমদফার লবণ উঠেছে। পেকুয়ার রাজাখালী ইউনিয়নেও ৭০ ভাগ লবণ উৎপাদন হয়েছে।

আশা করি ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে পুরো অঞ্চলে লবণ উৎপাদন পুরোদমে শুরু হবে, তাতে লবণের কোনধরণের ঘাটতি থাকবেনা।

বাংলাদেশ লবণ চাষি-ব্যবসায়ী সমিতির হ্নীলার সভাপতি সাবের খান জানান, গেল শুক্রবার থেকে টেকনাফে মাঠে নেমেছে চাষিরা ১৪/১৫ দিনের মধ্যে উপজেলায় প্রথমবারের মতো লবণ উৎপাদন হবে। আমাদের একটাই দাবী-অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে লবণ আমদানি করতে না পারে। আমাদের দেশের লবণ বিপুল লবণ মাঠে পড়ে থাকে এবং বিভিন্ন উপায়ে রাখাও যায়। দাম পাওয়া যায় ভালো। দেশীয় লবণ চাষে চাষি, মালিক ও ব্যবসায়ীরা খুশিতে থাকেন।

তিনি আরো বলেন, আমদানি নির্ভর কিছু লবণ মিল মালিক সবসময়ই লবণ আমদানির জন্য অনুমতি পেয়ে থাকেন। তারা চান দেশীয় লবণ শিল্প চিরতরে বন্ধ হয়ে যাক। দেশের ব্যবসায়ী ও চাষিরা ভালো থাকুক তারা চাই না।

টেকনাফের লবণ ব্যবসায়ী হোসাইন মুহাম্মদ আনিম জানান, গত শুক্রবার জুমার নামাজের পর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নেমেছে চাষিরা। তাদেরকে আমরা মাসিক টাকা ও মাঠের লাগিয়ত বাবদ টাকা দিয়ে সহযোগিতা করছি। আশা করছি আগামি দুই সপ্তাহের মধ্যে এবছরের নতুন লবণ উৎপাদন হবে। এ লবণ আমরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রপ্তানি করব। যদি বিদেশি লবণ আমদানি না হয় তাহলে আশা রাখি গত বছরের ন্যায় এবারও ভাল দাম পাব।

দেশের লবণ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেলে বিদেশ থেকে আমদানির জন্য প্রতিবছর সরকারকে বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। এতে কমপক্ষে আট থেকে ১০ হাজার কোটি টাকা গচ্ছা দিতে হবে। আশাকরি সরকার বিদেশ থেকে লবণ আমদানির মতো আত্মঘাতী সিদ্বান্ত থেকে সরে আসবেন জনগণের স্বার্থে, দেশীয় লবণ শিল্পকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনে। এতে লাভবান হবেন সরকার, চাষি ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।

(ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/এআর)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :