হাইশুর বৃদ্ধাশ্রমে ২৬ বছর ধরে সেবা দিচ্ছেন আশুতোষ ও মনিকা রানী দম্পতি

শেখ মোস্তফা জামান, গোপালগঞ্জ
| আপডেট : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৫৬ | প্রকাশিত : ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ১৪:৪৯

‘তৃষ্ণার্তকে জল দান, ক্ষুধার্তকে অন্ন; আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দান, ইহাই মানব ধর্ম’ এমন একটি স্লোগান নিয়ে ১৯৯৬ সালে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রাহুথর ইউনিয়নের হাইশুর গ্রামে স্থাপিত হয় হাইশুর বৃদ্ধাশ্রম। সেই থেকে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে চললেও বৃদ্ধাশ্রমটি এখন ওই এলাকার বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শেষ বয়সের ঠিকানা ও আশ্রয় হয়ে উঠেছে। চরম অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা এ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নিয়েছেন, তারাও খুঁজে পেয়েছেন তাদের শেষ বয়সের নিরাপদ ও নিশ্চিত আবাসস্থল। স্বামী আশুতোষ বিশ্বাস ও স্ত্রী মনিকা রানী বোস এর অক্লান্ত পরিশ্রমে এ মহানুভবতায় এখনও বেঁচে রয়েছে বৃদ্ধাশ্রমটি।

গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রাহুথর ইউনিয়নের হাইশুর গ্রামে ২৬ বছর ধরে বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে আশুতোষ বিশ্বাস ও মনিকা রানী বোস দম্পতি আর্ত মানবতার সেবা করে আসছেন। এই বৃদ্ধাশ্রমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসহায় ও দুঃস্থ প্রবীণরা আশ্রয় নিয়েছেন। এই দম্পতি পরম মমতায় বৃদ্ধাদের দেখভাল করেন। তারা বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা ও অসহায় প্রবীণদের এখানে রেখে সেবা প্রদান করে সুনাম অর্জন করেছেন।

মানব সেবাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিশ্ব মানব সেবা সংঘ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে একজন বৃদ্ধ নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমটির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। বর্তমানে এখানে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা রয়েছেন ২৬জন। এর মধ্যে সাত জন মুসলিম এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মের রয়েছে ১৯ জন। যাদের আটজন মানসিক প্রতিবন্ধী, দুজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এবং পাঁচজন রয়েছেন স্ট্রোকের রোগী। এদের মধ্যে রয়েছেন অসহায়, নি:সন্তান, বিধবা ও স্বামী-পরিত্যক্তা। এই বৃদ্ধাশ্রমে বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মের থাকলেও হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে নেই কোন ভেদাভেদ। মুসলিমদের জন্য রয়েছে নামাজ ও ইবাদতের ব্যবস্থা, আবার হিন্দু ধর্মের জন্য রয়েছে মন্দিরও, তাদের সময় কাটাতে রয়েছে পাঠাগার বা বই পড়ার ও ব্যবস্থা।

তাদের থাকা-খাওয়া, সেবা ও চিকিৎসাসহ যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে প্রতিনিয়ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমের সেবক আশুতোষ বিশ্বাস (আশু)। বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খাবার যোগাতে তিনি প্রথম দিকে বাদ্যযন্ত্র নিয়ে পথে পথে গান-বাজনা করেও ভিক্ষা করেন।

বিভিন্ন সময়ে সমাজের অবহেলিত, সহায়-সম্বলহীন অসহায় বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এসেছেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। এ পর্যন্ত বৃদ্ধাশ্রমে ৩২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। যাদের মধ্যে পুরুষ ৭ ও মহিলা ছিলো ১৯ জন। আশুতোষ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে আশেপাশের বিভিন্ন শ্মশাণে তাদের সৎকার করেছেন। আর মুসলিমদের কবর স্থানে দাফন করেছেন। যারা এখনও আছেন, তারা এ বৃদ্ধাশ্রমটিকে মনে করেন এটাই তাদের শেষ বয়সের নিরাপদ ঠিকানা। তাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কিছু হৃদয়-বিদারক ঘটনা রয়েছে। একসময় অসহায় সহায়-সম্বলহীনভাবেই তারা এ বৃদ্ধাশ্রমে এসে আশ্রয় নিয়েছে।

কিন্তু শুধুমাত্র খাদ্য-প্রদানকারী সদস্যদের সহযোগিতা দিয়ে তাদের আহার, পরিধেয় বস্ত্রাদি ও চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানো ভেলায় করে সাগর পাড়ি দেয়ার মতোই কঠিন হয়ে পড়েছে।

বছরে ১ দিনের খাদ্য প্রদানকারী যে ২৪০ জন সদস্য রয়েছেন, তাদের কেউ কেউ বছরে একাধিক দিনের খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। তাদের দান করা বস্ত্রাদি দিয়েই বৃদ্ধাশ্রমের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পরিধেয় বস্ত্রের ব্যবস্থা করা হয়। তারপরও বছরে বেশকিছু দিন তাকে ভিক্ষা করতে বের হতে হয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরে এবং পথে-ঘাটে গান-বাজনা করে তিনি যা পান তাই দিয়ে বছরের বাকি দিনগুলো কোনরকমে চালিয়ে নিচ্ছেন।

প্রতিবছর শীতের সময় এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রচুর শীতবস্ত্র দরকার হয়। মাঝে মধ্যে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও ধনাট্য ব্যক্তিরা খাদ্য ও বস্ত্র দিয়ে থাকেন। তবে তা পর্যাপ্ত নয়।

আশুতোষ বিশ্বাস এর সহধর্মিনী কাশিয়ানী ৮৭ নং হাইশুর পাঁচকাহনীয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষিকা মনিকা রানী বোস বলেন, প্রতিদিন সকালে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের ঘুম ভাঙানো থেকে বাজার-ঘাট, খাওয়া-দাওয়াসহ রাতে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত প্রায় সকল কাজেই আমার স্বামীকে সহযোগিতা করি। আমি একটি প্রাইমারী স্কুলের প্রধান শিক্ষক। আমার মাসিক বেতনের বড় একটি অংশ তুলে দেন স্বামীর হাতে, ওই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের প্রয়োজন মেটাতে।

বৃদ্ধাশ্রমের সেবক আশুতোষ বিশ্বাস জানিয়েছেন, প্রথম দিকে আমি ভিক্ষা করে বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনা করেছি, দিনে দিনে বৃদ্ধাশ্রমে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছে। বসবাসের ঘর-বারান্দা থেকে শুরু করে কোনকিছুই পর্যাপ্ত নয়। অর্থাভাবে বৃদ্ধাশ্রমের অনেক প্রয়োজনই মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এখানে ছোট্ট একটি মন্দির রয়েছে; যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সকাল-সন্ধ্যায় প্রার্থনা করতে পারছেন; মুসলিমদের জন্য রয়েছে একটি নামাজের ঘর। সেখানে নামাজ পড়তে পারেন।

গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহাবুব আলী খান বলেছেন, বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে আমি অভিভূত হয়েছি। এটি প্রতিষ্ঠা করে আশুতোষ একটি মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন। এ কাজে সমাজের বিত্তবানদের সহায়তা করা উচিত। আশুতোষ বিশ্বাস ও মনিকা রানী বোস দম্পতি এই মমতাময়ী ও মানবিক কাজ করে এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাদের এ কাজ এলাকায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছে। আশুতোষ কৃষক পরিবারের সন্তান। নিজের কোন সম্পদ নেই। অন্যের কাছ থেকে ভিক্ষা করে টাকা পয়সা, ধান, চাল, সবজি, মাছ এনে আশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

(ঢাকাটাইমস/৩০জানুয়ারি/এসএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :