হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায় কৃত্রিম চিনি
সফট ড্রিংকস, বেইক করা খাবার, ফ্রিজে রাখা ডেজার্ট, লজেন্স, দই, চুইং গাম সবকিছুতেই দেখা মেলে কৃত্রিম চিনির। চা, কফি ইত্যাদি পানীয়তে মেশানোর জন্য প্যাকেটজাত তো আছেই, রান্নায় কিংবা বেইক করতে ব্যবহারযোগ্য কৃত্রিম চিনিও মেলে বাজারে। তবে কৃত্রিম কিংবা প্রাকৃতিক যে কোনো চিনিই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। খাদ্যতালিকা থেকে চিনি বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন প্রায় সব চিকিৎসক।
শুধু ক্যালোরি বেড়ে যাওয়াই নয়, ভুঁড়ি হওয়া, ত্বকের জেল্লা হারিয়ে ফেলা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া কিংবা চুল পড়ার মতো নানা রকম সমস্যাও দেখা দেয় সাধারণ চিনি বা কৃত্রিম চিনি থেকেই। তাই সাম্প্রতিক সময় বিজ্ঞানের ভাষায় চিনিকে ‘স্লো পয়জন’ও বলা হয়।
ডায়াবেটিস রোগীসহ অনেক স্বাস্থ্য সচেতনরাই বর্তমানে চিনির বিকল্প হিসেবে আর্টিফিসিয়াল সুইটনার বা কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করেন। বিশেষ করে চায়ের সঙ্গেই বেশি মেশানো হয় এই কৃত্রিম চিনি। তবে এটি কতটা স্বাস্থ্যকর, তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।
অনেকেই ভেবে বসেন, চিনি বারণ কিন্তু কৃত্রিম চিনি খাওয়া যাবে। কিন্তু জানেন কি, এই কৃত্রিম চিনি শরীরের জন্য আরও বেশি ক্ষতিকর। এতে থাকা অ্যাসপার্টেম শরীরে চিনির চেয়েও বেশি ক্ষতি করে। মেদ বৃদ্ধি থেকে শুরু করে শরীরের অন্যান্য সমস্যাকেও উস্কে দেয়।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, সাধারণ চিনির চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি মিষ্টি অ্যাসপার্টেম কৃত্রিম চিনির অন্যতম উপাদান। কৃত্রিম চিনিতে ওজন কমে না, উল্টে এতে ব্যবহৃত উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রাও খুব একটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
‘নেচার মেডিসিন’-এ প্রকাশিত গবেষণা বলছে, কৃত্রিম চিনিতে থাকা ‘এরিথ্রিটল’ নামক একটি যৌগ রক্ত জমাট বাঁধা, স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। সেখানে বলা হয়েছে, বিগত ৩ বছরে হৃদ্রোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যতগুলো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, তার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে এই ‘এরিথ্রিটল’-এর যোগ রয়েছে। যদিও এই যৌগটিকে নিশ্চিত ভাবে দায়ী করার আগে বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা।
২০১১ সালে ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন’ (এনসিবিআই)-এর সমীক্ষা বলছে, স্বাদে চিনির মতো হলেও চিনির মতো ক্যালোরি নেই এই যৌগটিতে। ‘সর্বিটল’ বা ‘জ়াইলিটল’এর মতো ‘এরিথ্রিটল’ও এক প্রকার অ্যালকোহল, যা প্রাকৃতিকভাবে থাকে ফল এবং সব্জির মধ্যে। কিন্তু পুষ্টিবিদদের মতে, অতিরিক্ত ক্যালোরি ছাড়াই চিনির মতো মিষ্টত্ব দিতে পারে এই যৌগটি। কিন্তু সমস্যা হল, এই ‘এরিথ্রিটল’ কৃত্রিমভাবে তৈরি করতে গেলেই এর ফল হয় উল্টো।
প্রাকৃতিকভাবে ফল বা সব্জিতে থাকা ‘এরিথ্রিটল’ ভাল হলেও, কৃত্রিমভাবে তৈরি এই যৌগটি শরীরের বিপাকহারের গতি কমিয়ে দিতে পারে। রক্তের বদলে প্রস্রাবের মধ্যে মিশতে থাকে যৌগটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সুগার ফ্রি, স্টিভিয়া’সহ বাজারে যে সব কৃত্রিম চিনি পাওয়া যায়, তাতে অ্যাসপারটেম ও সুক্রালোজ নামক যৌগ থাকে। এর কারণেই মিষ্টি ভাব আসে। যা শরীরের জন্য একেবারেই ভালো নয়।
সুক্রালোজের তুলনায় অ্যাসপারটেম আরও বেশি ক্ষতিকর। এই দুই যৌগ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হৃদ্যন্ত্র, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুর উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। শরীরে নেগেটিভ ইলেকট্রন তৈরি হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
‘দ্য বিএমজে’ দ্বারা প্রকাশিত ফরাসি প্রাপ্তবয়স্কদের একটি বড় গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চতর কৃত্রিম সুইটনার সেবন হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকসহ কার্ডিওভাসকুলার বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
কৃত্রিম সুইটেইনার বানানোই হয়েছে কম ক্যালোরিযুক্ত মিষ্টি খাওয়ার সুযোগ করে দিতে। কিন্তু বহু গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, এই খাদ্যপণ্যটি উল্টো ওজন বাড়ায়। যারা এসব মিষ্টি খায় তাদের ওজন বাড়ার ঝুঁকি ৪৭ শতাংশ বেড়ে যায়।
স্যাকারিন, সুকরালোজ এবং অ্যাসপারটেমে অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে। এতে হজমের প্রক্রিয়া প্রভাবিত হওয়ায় রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। আর এ সমস্যা টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
কৃত্রিম চিনির বিকল্প হিসেবে যেসব খাবার খাবেন
মধু
প্রাকৃতিক এনার্জি বুস্টার হিসেবে মধু আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। চিকিৎসকদের মতে, চিনির বদলে খাঁটি মধু মেশান রান্নায়। স্বাদেও মন ভোলাবে, চিনির চেয়ে উপকারও বেশি। চিনির বিকল্প হিসেবে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর ন্যাচারাল সুইটেনার মধু। ১ টেবল চামচ মধুতে ক্যালোরির পরিমাণ থাকে ৬৪।
নারিকেল
নারকেলের চিনি স্বাস্থ্যকর ও একেবারেই ডায়াবেটিক নয়। এই কারণে এর চাহিদা তুঙ্গে। নারকেল থেকে বানানো এই চিনিও ব্যবহার করতে পারেন রান্নায়। কোকোনাট সুগারে ক্যালোরি অনেক কম থাকে। ১ টেবল চামচ কোকোনাট সুগারে ক্যালোরির পরিমাণ ৪৫।
খাঁটি গুড়
গুড় চিনির চেয়ে বেশি মিষ্টি। তবু এর ক্যালোরি অনেক কম। হলেও গুড়ে ক্যালোরির পরিমাণ অনেক কম। ১ টেবল চামচ গুড়ে থাকে মাত্র ৪৭ ক্যালোরি। গুড়ের বদলে গুড়ের বাতাসাও ব্যবহার করতে পারেন রান্নায়।
তাজা ফল
বেদানা, আপেল, আঙুর, কলার মতো ফলগুলো এমনিতেই মিষ্টি৷ খুব মিষ্টি খাওয়ার ইচ্ছে করলে ফল খেতে পারেন৷ ফলের রস নয়, গোটা ফল চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যেস তৈরি করুন৷ এর ফলে প্রয়োজনীয় ফাইবারটাও আপনার শরীরে ঢুকবে৷
বাদাম
আমন্ড, কাজু, আখরোটের মতো বাদামের পাশাপাশি কুমড়ো, তিসি ইত্যাদির বীজ রাখুন প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়৷ এগুলোর প্রভাবে আপনার পেট বেশিক্ষণ ভরে থাকবে৷ বাড়তি চিনির প্রয়োজন হবে না
ডিটক্স ওয়াটার
অনেকে মিষ্টি খেতে খুব ভালোবাসেন এবং সারা দিনের যখন-তখন মিষ্টি কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হয়, তাদের জন্য আদর্শ ডিটক্স ওয়াটার বা ফ্লেভারড ওয়াটার৷ এক বোতল পানিতে মিশিয়ে নিন আপনার পছন্দের ফল৷ স্ট্রবেরি, আঙুর, আপেল, তরমুজ, পুদিনা, লেবু যা খুশি মেশাতে পারেন৷ এক রাত ফ্রিজে রাখুন৷ পরদিন পানিটা ছেঁকে পান করুন৷ সারাদিনে অল্প অল্প করে চুমুক দিয়ে খেলে আপনার মিষ্টি খাওয়ার তীব্র ইচ্ছে নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে ৷
স্টেভিয়া
স্টেভিয়া এক ধরনের ভেষজ পাতা। গবেষণায় দেখা গেছে, এর অনেকগুলো পাতা একসঙ্গে নিলে এটি খেতে চিনির চাইতেও মিষ্টি লাগে। এটি দাঁতের ক্ষয়রোগ রোধ করে। স্কিন কেয়ার হিসেবে কাজ করে, তাই ত্বকের কোমলতা এবং লাবণ্য বৃদ্ধি করে। স্বাদ বৃদ্ধিকারক হিসেবেও স্টেভিয়ার অনেক চাহিদা রয়েছে। চা, কফি, মিষ্টি, দই, বেকারি ফুড, আইসক্রিম, কোমল পানীয়সহ এ জাতীয় নানা খাদ্যপণ্য তৈরিতে স্টেভিয়া ব্যবহার করা যায়। এর ভেষজ উপাদান মানুষের দেহে কোনো পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না।