ইরানের ঈদ স্মৃতি

মীম মিজান
 | প্রকাশিত : ০৪ মে ২০২৩, ১৩:০৩

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করার সুবাদে ২০১২ সালে ইরান সরকারের বৃত্তি লাভ করে ইরানের কাজভিনে অবস্থিত ইমাম খোমেনি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন ফারসি ভাষার উচ্চতর কোর্স সম্পন্ন করার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে সময় আমাদের সাথে বিশ্বের ২৭টি দেশের ১২১ জন শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থী ছিলেন।

ছোট্ট এ জীবনে মাত্র দুটো ঈদ পরিবারের আপনজনের বাইরে করেছি। সে দুটো ঈদের স্মৃতি সত্যিই ব্যতিক্রমী। একটি ঈদ ইরানে। আরেকটি ঢাকার কল্যাণপুরে। ঢাকার কল্যাণপুরের ঈদটি ছিল দেশের রাজধানীতে। তার সাথে গ্রামীণ ঈদের আমেজের বেশ পার্থক্য। আর ইরানের ঈদটি ছিল ভিন্ন দেশীয়, ভিন্ন সংস্কৃতি ও মানের। যা আমার জীবনে অভিজ্ঞতার ঝুলিকে করেছে ঋদ্ধ। এবার সেই ভিন্ন দেশীয় ও সংস্কৃতির ঈদের স্মৃতি আপনাদের কাছে আমার ভ্রমণ দিনলিপি থেকে তুলে ধরছি।

১৮.০৮.২০১২ খ্রিস্টাব্দ। দিনটি ছিল শনিবার।

প্রতিদিনের ন্যায় ক্লাসে যাওয়া। ক্লাস থেকে ফেরা। ক্লাস থেকে ফেরার আগে কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, আগামীকাল যদি ঈদ হয়, তা হলে আগামীকাল ও পরশু দুইদিন ক্লাস ছুটি থাকবে। ঈদের ছুটির কথা শুনেই মনের ভিতর এক আনন্দের সুবাতাস বয়ে গেল। মনে পড়ল বাড়ির কথা। ঈদের আগের দিন কত আয়োজন থাকত! জামা-কাপড় ইস্তিরি করা। ঈদের দিনের রান্নার জন্য কোনো কিছু বাদ পড়লে তা বাজার থেকে নিয়ে আসা। বাজারের ভিতরে দেখতাম চেনা পরিচিত কত মুখ। যারা একবারই এই ঈদের সময় বাড়িতে আসেন। চায়ের দোকানের বেঞ্চগুলোতে বন্ধু-বান্ধবের প্রাণবন্ত আড্ডা। আর আজ আমিই নেই। কিন্তু বাকিরা ঠিকই ব্যস্ত গল্পে। মাগরিবের নামাজের সালাম ফেরালেই সব্বাই তাকবির বলতেন। মনে হতেই উচাটন হলাম।

আমাদের সাথে অধ্যয়নরত অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই খ্রিস্টান। আর ভারতের চন্দ্রগুপ্ত ভারতীয়া ছিল একমাত্র সনাতন ধর্মাবলম্বী। ওরা রোজা বা নামাজের বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিত না। তবুও ইরানের শিয়ায়ী মুসলিম সংস্কৃতির জন্য ওদেরকে অনেক কিছু মানতে হতো। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে ইফতার করলাম। ক্যাম্পাসের বাসে করে আবাসিকে ফিরলাম। মূলত ক্যাম্পাস এক স্থানে আরেক স্থানে আবাসিক, খেলার মাঠ, জিমনেসিয়াম ইত্যাদি। শুনছি নানা গুঞ্জন। ঈদ হবে, হবে না ইত্যাদি। আসলে এ নিয়ে যত মাথাব্যথা, তা শুধু আমাদের আর ভারতীয়দের।

আমরা হলে ঢুকে জানলাম যে, আগামীকাল ঈদ তবে একটি বিষয় যে, ইরানের আকাশে কোনো কালবোশেখির মেঘ বা অন্য কোনো বৃষ্টিধারী মেঘের সন্ধান মেলে না। তাই চাঁদ দেখা যেত। কিন্তু শাওয়ালের চাঁদকে আমরা দেখতে পেলাম না। শফিউল্লাহ স্যার খুশিতে হাতে তালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘কাল ঈদ! খুব খুশি লাগছে।’ তিনি মিষ্টি এনেছেন। হাসি মুখে সবাইকে বিতরণ করলেন। সবাই মিলে খেলাম আর চাঁনরাতের আনন্দ উপভোগ শুরু করলাম। কিছু সময় পরে স্যারকে দেখলাম যে, দেশে ভাবিকে ফোন করছেন। আর বলছেন, ‘শরীফা, আগামীকাল ঈদ। ঈদের শুভেচ্ছা নাও! শরীয়তুল্লাহ ও অন্যদেরকেও শুভেচ্ছা দিও!’

চাঁনরাতে বউয়ের জন্য মেহেদী, চুড়ি, স্নো ইত্যাদি নিয়ে বাসায় ফিরতে হতো। কিন্তু আজ বিদেশ বিভুঁইয়ে শুধু সে স্মৃতি হাতড়িয়ে রাত গুজরাতে হবে। মোবাইলে ক্রেডিট শেষ। একটা কলও দিতে পারলাম না দেশে।

১৯.০৮.২০১২ খ্রিস্টাব্দ। রবিবার।

আজ ঈদ কি মজা হবে! ফজর শেষে তাকবির পড়তে পড়তে আমরা একটা মিটিংয়ে মিলিত হলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসির শিক্ষক আবুল কালাম সরকার স্যার বললেন, ‘সকাল সাড়ে ছয়টার মধ্যে রেডি হয়ে আমরা বাসে করে শহরে নামাজ পড়তে যাব।’

যথারীতি প্রস্তুতি নিয়ে সবাই পাঞ্জাবি ও টুপি পরে চললাম বাসের জন্য। একি ইরান জাতি! তারা ঈদে ততটা আনন্দ করে না! খুব একটা পাত্তাও দেয় না।

আবাসিকে কেবল জাহেরি সাহেবকে দেখলাম পরিচ্ছন্ন শার্ট-প্যান্ট পরে, গাড়িতে করে একা নামাজ পড়তে গেল। আমরা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা অর্থাৎ বাংলাদেশীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গুটিকয়েক ছাত্র বাসে করে চললাম নামাজের জন্য। উদ্দেশ্য কাজভিনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মসজিদুন নবি।

আমরা দেশীয় ঢঙ হিসেবে সাদা পাঞ্জাবি ও টুপি পরেছি। সবাই তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ইরানিদের গায়ে শার্ট-প্যান্ট। একজনের গায়েও পাঞ্জাবি নেই। এরা নওরোজ বা নববর্ষের ছুটি কাটায় দু সপ্তাহ। আর ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দুইদিন।

উৎসব বলতে রাস্তার ধারে বড় বড় ব্যানার লাগিয়েছে। ‘ঈদে সায়িদে ফেতের মোবারকবাদ’ ইত্যাদি লেখা সেই ব্যানারে।

এসব দেখতে দেখতে যাচ্ছি মসজিদে। দেখি সরকারিভাবে মিষ্টির ব্যবস্থা করেছে। অনেক ধরনের মিষ্টির উন্মুক্ত প্যাকেট। মোহাররম বলে উঠল, ‘ভাই, এত মিষ্টি! একটা একটা করে খাইলেই তো পেট ভইরা যাইবো।’ যৎসামান্য মিষ্টি ভক্ষণ করে নামাজে গেলাম। যাওয়া-আসার রাস্তায় সারি সারি করে ফিতরা ও কাফফারা আদায়ের জন্য বাক্স সাজিয়ে রাখা আছে। অনেক বাক্স। প্রায় রাস্তাজুড়ে ফিতরা ও কাফফারার বাক্স।

এটি কাজভিনের সবচেয়ে বড় মসজিদ। বেশ বড়। ডিজিটাল ঘড়ি। টাইলস। চকমকি। ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ আরম্ভ হওয়া মসজিদটি ‘মসজিদে নবি’, ‘মসজিদে সুলতানি’ এবং ‘মসজিদে শাহ’ নামে পরিচিত। ওস্তাদ মির্জা শিরাজি এটির স্থাপত্যশিল্পী। নান্দনিক মসজিদটির আয়তন ১৪০০০ স্কয়ার মিটার। প্রবেশ পথের দু ধারে মধ্য অবয়বের কয়েকটি সবুজ পাতাঅলা গাছ। সারি সারি করে টবে ছোট্ট ছোট্ট ফুল, ভেষজের গাছ। একটি টবে আকর্ষণীয় কিছু হলুদ ফুল সব নামাজির নজর কেড়েছে। সামনে এগুলেই পানির ফোয়ারা। কত সুন্দর, পরিপাটি। আকাশে খণ্ড খণ্ড সাদা মেঘ। সব মিলিয়ে দারুণ সাজ ও পরিপাটি।

মসজিদের ডানের অংশে পুরুষদের সাথে লাইনে মিশে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম যে, এ অংশটি শুধু পুরুষ মুসল্লিদের জন্য নির্দিষ্ট। বাঁয়ের অংশে মেয়েরা। নামাজ শুরু হলো। একজন তাকবির দিয়ে শুরু করলেন। তবে নামাজের মধ্যে সুরা-কেরাত পাঠ করেন আয়াতুল্লাহ। আর বাকি দোয়া ও তাকবির বলেন আরেকজন। ১২ তাকবিরের সাথে নামাজ পড়েন এরা। তবে তাকবিরের মাঝখানে অনেক বড় দোয়া পড়েন। যিনি দোয়া পড়ছেন তার কণ্ঠস্বর, উচ্চারণ অনেক মনোহর ও শ্রুতিমধুর। সবাই সেই দোয়ার সাথে মিলিয়ে দোয়া পড়েন। এক অনাবিল চমকপ্রদ পরিবেশ। কিন্তু এই পরিবেশের মধ্যে দূরে দাঁড়িয়ে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ির এক বাঙালি ভদ্রলোক নিবিড়ভাবে দেখছেন সবার নামাজ। তিনি আমাদেরই সাথে নামাজ আদায় করতে যাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থী শেখ মুস্তাফিজুর রহমান। পরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এ বিষয়ে। তার উত্তর ছিল, ‘আরে ভাই, এরা শিয়া। এদের সাথে মিশে নামাজ পড়তে আমার মন চায়নি। আমি হলে গিয়ে নিজের মতো করে পড়ে নিয়েছি।’

সালাম ফিরানোর পর এরা নিজের ডান ও বামের জনকে সালাম দেয় ও হ্যান্ডশেক করে। গালের সাথে গাল মেলায়। অতঃপর আমেরিকা, ব্রিটিশ আর ইসরায়েলের ওপর অভিসম্পাত করে। নামাজ শেষে ঈদের খুতবা। খুতবায়ও এরা ইসরায়েল-আমেরিকার ধ্বংস কামনা করে। একটা বিষয় খেয়াল করলাম যে, নামাজের মাঝে মাঝে যে বড় বড় দোয়া পড়ল, তা কিন্তু সবার মুখস্থ নেই। পাশেই দোয়া লেখা সম্বলিত কাগজ রেখে দেয়। দোয়ার সময় তা হাতে নিয়ে পড়ে। অতঃপর রেখে দিয়ে রুকু বা সিজদা করে।

মুনাজাত শেষে মসজিদ থেকে বের হচ্ছি। চক্ষু চড়কগাছ। পুরুষদের থেকে নারীর সংখ্যা কয়েকগুণ। সবার পরনেই কালো বোরখা। শার্ট-প্যান্ট পরা লোকজনের ভিতর অষ্টম আশ্চর্য যেন এই বাঙালি পল্টন। শিশুদের চোখগুলো দেখে স্পষ্ট উপলব্ধি হচ্ছে যে, আমরা তাদের কাছে মহাআকর্ষণের বস্তু।

মসজিদের মূল ফটকে একদল সংবাদকর্মী। ইরানি কয়েকজনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন। আমাদের দেখেই যেন হামলিয়ে পড়লেন৷ আর প্রশ্ন করা শুরু করলেন অনর্গল। যা পেরেছি বলেছি। অতঃপর শেষ বাক্য ছিল ‘ঈদুকুম মুবারক!’, ‘ঈদে সাইদে ফেতের মুবারকবাদ!’

যতই মুবারকবাদ জানাই না কেন, মিষ্টি কিন্তু আর আমাদের জন্য অবশিষ্ট ছিল না। ছিল না মায়ের হাতের রান্না করা মজাদার সেমাই। বিরানির ঘ্রাণও পাইনি এক ঝলক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :