চোখে ছানি পড়েছে কি না বুঝবেন যেভাবে

স্বাস্থ্য ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৭ মে ২০২৩, ১০:৫২

চোখকে বলা হয় মনের আয়নাস্বরূপ। মনের কথা বলে দেয় আমাদের দৃষ্টি। আমাদের চোখের গঠন এতটাই জটিল যে, সেটা মাঝে মাঝে কল্পনাকে হার মানায়। চোখের কার্যপদ্ধতি অনেকটা ক্যামেরার পদ্ধতির মতোই। চোখের পাতা কাজ করে ক্যামেরার শাটারের মতো, চোখের ভেতরে আছে স্থিতিস্থাপক লেন্স যা দর্শনীয় বস্তুকে ফোকাস করে এবং তারপর প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে একসময় তা আমরা দেখতে পাই। এই প্রক্রিয়াকরণ চলে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই।

মানুষের চোখের ভেতর ক্রিস্টালের মতো পরিষ্কার লেন্স থাকে। এটি দিয়ে আমরা দূরে-কাছের দৃশ্য সমন্বয় করি। এটিতে কোনো অস্বচ্ছতা তৈরি হলে একে আমরা ছানি বলি। এটি সাধারণত ঘোলাটে ও সাদা রঙের হয়।

"ছানি" শব্দটি গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভূত কাটরাকটেস যা শিথিলভাবে জলপ্রপাতকে অনুবাদ করে। এটি বিশ্বাস করা হয়েছিল যে মস্তিষ্ক থেকে একটি জমাট তরল চোখের লেন্সের সামনে প্রবাহিত হয়েছিল। চোখের ছানি চোখের লেন্সের মেঘলা হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞান থেকে জানা যায় ছানির সমস্যা সাধারণত ৪০ বছরের পর দেখা গেলেও আদতে এই রোগ আসার কোনও বয়স হয় না। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় সদ্যজাত শিশুরও এই সমস্যা রয়েছে। অপারেশনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা হয়ে থাকে।

ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সহজেই এই রোগ বাসা বাধে। এছাড়াও হাই মায়োপিয়া কিংবা বংশগত ফান্ডাস ডিস্ট্রোফি-এর মতো অসুখেও ছানির সমস্যা দেখা দেয়।

আমাদের চোখে স্বচ্ছ একটি লেন্স বা দর্পণ রয়েছে। যার ভেতর দিয়ে আলো গিয়ে চোখের পেছনের রেটিনায় বা দৃষ্টি সংবেদনশীল অংশে গিয়ে পড়ে এবং দৃষ্টির অনুভূতি তৈরি হয়।

কাঁচ যেমন অস্বচ্ছ হয়ে গেলে আর কাঁচের ভেতর দিয়ে কোনো কিছু দেখা যায় না, তেমনি চোখের লেন্স যদি অস্বচ্ছ হয়ে যায়, চোখের দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। চোখে ছানি পড়লে স্বাভাবিক দৃষ্টির সমস্যা হয়। সব কিছুই আস্তে আস্তে ঘোলা বা অস্বচ্ছ দেখা যায়।

যখন চোখের মধ্যে উপস্থিত প্রোটিনগুলো জমাট বাঁধে, তখন এটি একটি মেঘলা, অস্পষ্ট রূপরেখার সাথে দৃষ্টিকে বিভ্রান্ত করে। এটি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে এবং আপনার দৃষ্টিতে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করে এবং যদি চিকিত্সা না করা হয় তাহলে সম্পূর্ণ অন্ধত্ব হতে পারে।

চোখের ছানি রোগের কিছু লক্ষণের মধ্যে রয়েছে:

মেঘলা/দুগ্ধ/কুয়াশা/অস্পষ্ট দৃষ্টি, দুর্বল রাতের দৃষ্টি, আলোর চারপাশে একটি হ্যালো (একদৃষ্টি) দেখা বিশেষ করে রাতে হেডলাইটের দিকে তাকালে, আক্রান্ত চোখে কিছু ক্ষেত্রে দ্বিগুণ দৃষ্টি, রং বিবর্ণ দেখতে, উজ্জ্বল পড়ার আলো প্রয়োজন, সূর্যালোক এবং উজ্জ্বল আলোর প্রতি ক্রমবর্ধমান সংবেদনশীলতা, চশমার জন্য ঘন ঘন প্রেসক্রিপশন পরিবর্তন।

চোখে ছানি পড়ার প্রধান কারণ বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লেন্সের উপাদান প্রোটিনের গঠন নষ্ট হয়ে যাওয়া। এছাড়া আরও যেসব কারণে সমস্যা হতে পারে ১. দীর্ঘমেয়াদি কিছু রোগ যেমন ডায়াবেটিস, চোখের ইনফেকশন ইত্যাদি ২. বংশগত ৩. দীর্ঘদিন স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ সেবন ৪. ধূমপান ও অ্যালকোহলে আসক্তি ৫. সূর্যের অতিরিক্ত তাপ কিংবা অতিবেগুনি রশ্মিতে কাজ করা ৬. চোখে আঘাত পাওয়া ৭. ভিটামিনের ঘাটতি।

এছাড়া চোখের ছানি নানা কারণে হতে পারে। যেমন ধরুন একটি শিশু খেলা করছে, তার চোখে আঘাত লাগল, আঘাতের কিছুদিন পরেই তার চোখে ছানি পড়ে যেতে পারে। একটু বয়স্ক লোক খেলা করছেন, টেনিস খেলছেন। বলটা হয়তো চোখে লেগে গেল। ওনার কিছুদিন পরে চোখে ছানি পড়ে গেল বা হয়তো মারামারি করছে বন্ধুবান্ধবের মধ্যে। চোখে ব্যথা লাগল। কিছুদিন পরে ছানি পড়ে যাচ্ছে। এগুলো আঘাতজনিত ছানি, এটা কিন্তু আমাদের দেশে প্রায়ই হয়।

গর্ভকালীন মায়ের হাম (জার্মান মিজেলস বা রুবেলা) হলে, মা অপুষ্টিতে ভুগলে বা ডায়াবেটিস হলে, টোক্সোপ্লাজমা জাতীয় ভাইরাস আক্রমণ করলে বা শিশুর গঠনপ্রক্রিয়ায় কোনো ত্রুটি থাকলে কনজেনিটাল ক্যাটার‌্যাক্ট বা জন্মগত ছানি হতে পারে।

আঘাতজনিত কারণ, হাই মায়োপিয়া বা অতিমাত্রায় নিকট দৃষ্টিজনিত সমস্যা, চর্মরোগ, হরমোনাল কারণ, মেটাবলিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে চোখে ছানি পড়ে। চোখের প্রদাহ, অ্যালার্জি, হাঁপানি কিংবা যেকোনো কারণে ব্যথানাশক স্টেরয়েড জাতীয় কিছু ওষুধ, ড্রপ ব্যবহার, রেডিয়েশন, কেমোথেরাপি ইত্যাদির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছানি হয়।

আরেকটি ছানি রয়েছে, যাকে বলা হয় জটিল ছানি। কমপ্লিকেটেড ক্যাটারেক্ট। চোখের ভেতরে যদি কোনো কারণে ইউভিআইটিস হয় বা কোনো সংক্রমণ হয়। তাহলে কিন্তু চোখের লেন্স ঘোলা হয়ে যায়। আমরা বলছি জটিল ছানি।

আরেকটি ছানি রয়েছে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আমাদের দেশে। এটা হলো ডায়াবেটিক ছানি। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, বিশেষ করে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, তাদের এ সমস্যা হয়। তাদের কিন্তু এই লেন্সে ঘোলা হওয়ার বিষয়টি দ্রুত হয়। আমরা বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখেছি, যাদের ডায়াবেটিস নেই, তাদের থেকে যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের ছানির সংখ্যা ছয় গুণ বেশি। তাদের যেকোনো বয়সে ছানি হতে পারে। এমনকি যাদের অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হয়, তাদের কিন্তু ছানি দ্রুত পড়ে যেতে পারে। ডায়াবেটিস হলে, আবার থাইরয়েড হরমোন, প্যারাথাইরয়েড হরমোনের অভাবেও কিন্তু ছানি পড়তে পারে।

চোখে ছানি হলে তার একমাত্র চিকিৎসা হলো অপারেশন করে চোখের ছানি অপসারণ করা। অনেকেই মনে করেন ছানি বেশি বড় হলে তবে অপারেশন করা উচিত। এটা খুবই ভয়াবহ একটি ভুল ধারণা। কখন অস্ত্রোপচার করা নিরাপদ, সেটি চক্ষু বিশেষজ্ঞ ছানির অবস্থা দেখে বলে দেবেন। বেশি দেরি হয়ে গেলে ছানিজনিত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- গ্লুকোমা ও লেন্স ডিজলোকেশন বা চোখের লেন্স নির্দিষ্ট স্থান থেকে সরে যাওয়া, দৃষ্টি হারানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আজকাল অতি উন্নতমানের চোখের ছানির অপারেশন যেমন ফ্যাকো, এসআইসিএস, ইসিসিই ইত্যাদি হয়ে থাকে। অনেক সময় অপারেশনের পরে চশমা পরার প্রয়োজন হতে পারে।

ওষুধ সেবনে ছানি রোগের প্রতিকার হয় না। অপারেশনের মাধ্যমে ছানি অপসারণ করতে হয়।

ছানি পড়া ছাড়া চোখে যদি আর কোনো সমস্যা না থাকে (বিশেষ করে রেটিনা ও ভিট্রিয়াসে) তা হলে অপারেশনের মাধ্যমে আবার আগের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ছানি অপসারণের পর কৃত্রিম লেন্স সংযোজন করা হয়; যা আগের স্বচ্ছ লেন্সের মতোই কার্যকর।

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির কারণে ছানি অপারেশন এখন অনেক কম সময়ে এবং সেলাইবিহীন উপায়ে করা সম্ভব। এর একটি হলো স্মল ইনসিশন ছানি অপারেশন যা (এসআইসিএস) নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে মাত্র পাঁচ-ছয় মিলিমিটার কেটে, তার ভেতর দিয়ে ছানি অপসারণ এবং কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করা হয়।

আরেকটি হলো ফ্যাকো ইমালসিফিকেশন টেকনিক। এটি আরো আধুনিক প্রক্রিয়া, যাতে আরো অল্প কেটে তার মাধ্যমে ফ্যাকো মেশিন ব্যবহার করে ছানি অপসারণ ও কৃত্রিম লেন্স প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। ফ্যাকো সার্জারিতে ছানিকে গলিয়ে বের করে চোখে কৃত্রিম লেন্স বসানো হয়। ফ্যাকো সার্জারির সুবিধা হলো, রোগী অনেক তাড়াতাড়ি অপারেশন, পরে তার স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে পারে এবং অপারেশনের পর চশমার পাওয়ার পরিবর্তন অনেক কম হয়। মাল্টি ফোকাল লেন্স ফ্যাকো সার্জারিতে ব্যবহার করলে দূরে কাছে কোথাও চশমা লাগে না।

চোখের ছানির সর্বাধুনিক সার্জারি লেজার ফ্যাকো সার্জারি । অত্যন্ত ব্যয়বহুল ফেমটো লেজারের সাহায্যে এই সার্জারি করা হয়। চোখকে ফেমটো লেজার মেশিনে সংযোগ করে লেজার রশ্মি দিয়ে ছানির ওপরের অংশ গোল করে নিখুঁতভাবে কেটে ছানিকে ৮ বা ১৬ টুকরা করা হয়। এ চিকিৎসা প্রচলিত ফ্যাকো সাজারির চেয়েও সঠিক, যার গুণগত মানও অনেক ভালো।

সঠিক যত্ন নিলে ছানি প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাদের মধ্যে কিছু অন্তর্ভুক্ত। নিয়মিত চোখের পরীক্ষা করান।

ধূমপান ত্যাগ করুন। স্বাস্থ্যকর খাদ্য বজায় রাখা। অ্যান্টিঅক্সিডেন্টযুক্ত ফল এবং শাকসবজি খাওয়া। সূর্যের আলোতে বাইরে যাওয়ার সময় ইউভি ব্লকিং সানগ্লাস পরা।

চোখের জন্য উপকার সেই সব খাবার খাওয়া উচিত। ভিটামিন-এ (ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাবার), ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, ফাইটো নিউট্রেয়ান্ট রয়েছে এমন খাওয়ার খান। গাজর যেমন চোখের জন্য খুব উপকারী।

শরীরের অন্যান্য অঙ্গের চেয়ে চোখের লেন্স ভিটামিন সি বেশি ধারণ করে। যদি আপনার চোখে ছানি (প্রাথমিক পর্যায়ে) হয়ে থাকে তাহলে চক্ষু বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে সম্পূরক ভিটামিন সি গ্রহণ করুন।

চোখে ছানি আছে এমন অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে তাদের প্রোটিন জাতীয় খাবার হজম করতে সমস্যা হয়। এই অতিরিক্ত প্রোটিন চোখের লেন্স-এ গিয়ে জমা হয়ে ছানি তৈরি করতে পারে। তাই ছানি প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত পেঁপে খাওয়া উচিত।

ছানি পড়া চোখের জন্য রসুন খুবই উপকারী। আপনার চোখ পানি দিয়ে ধুয়ে নিলে দৃষ্টি যে রকম পরিষ্কার মনে হবে, রসুনও ঠিক সেই কাজটি করে থাকে। তাই প্রতিদিন ২-৩ কোয়া রসুন খেতে পারলে উপকার পাওয়া যাবে।

চোখে ছানি হলে চোখ জ্বালা করে এবং লাল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দুধের মধ্যে সারারাত কাজুবাদাম ভিজিয়ে রেখে সেই দুধ যদি চোখের পাতায় লাগানো যায় তাহলে চোখ জ্বালা করা এবং লাল হয়ে যাওয়া অনেকটাই কমে যায়।

গম ঘাস ( গমের কচি চারা ) যা আপনার চোখের ছানি দূর করতে সক্ষম। এজন্য আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গম ঘাসের জুস রাখুন বা সম্পূরক হিসেবে গ্রহণ করুন।

পেঁপের মধ্যে যে এনজাইম থাকে তা প্রোটিন জাতীয় খাবার হজমে সহায়তা করে। চোখে ছানি আছে এমন অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যে তাদের প্রোটিন জাতীয় খাবার হজম করতে সমস্যা হয়। এই অতিরিক্ত প্রোটিন চোখের লেন্স-এ গিয়ে জমা হয়ে ছানি তৈরি করতে পারে। তাই ছানি প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত পেঁপে খাওয়া উচিত।

মেডিকেল জার্নাল অনুযায়ী শাক বিটা ক্যারোটিন ও এন্টিওক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা চোখের ছানি প্রতিরোধ করে। তাই প্রতিদিনই শাক খান।

জাম জাতীয় ফল বিশেষ করে বিল বেরি এন্থোসায়ানসাইড সমৃদ্ধ , এর ফ্লাভনয়েড চোখের রেটিনা ও লেন্স কে জারণ এর হাত থেকে রক্ষা করে।

একাধিক মেডিকেল জার্নাল অনুযায়ী, কাঁচা শাক-সবজি ভিটামিন এ এর উৎস। তাছাড়া এগুলো বিটা ক্যারোটিন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ যা চোখের ছানি প্রতিরোধে সাহায্য করে।

(ঢাকাটাইমস/২৭ মে /আরজেড)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ফিচার বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :