বরিশালে চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্ব, নেপথ্যে সেই ৭৫-এর থিংকট্যাংক

বরিশাল সিটির গত নির্বাচনের সময়, ২০১৮ সালের জুলাই মাসে অন্তত দুই সপ্তাহ আমি একটানা বরিশালে ছিলাম। তবে নির্বাচন দেখার জন্য নয়, বাবার গুরুতর অসুস্থতার কারণে ছিলাম বরিশালে। তখন আমি মাইটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক এবং টক শো ও লেখালেখির সঙ্গে কিঞ্চিত সম্পৃক্ত। সেই সময় লেখালেখির ক্ষেত্রে মূল ভরসা ছিল ঢাকা টাইমস, এখন যেমন বাংলাদেশ প্রতিদিন ও কালবেলা।
২০১৮ সালে বিসিসি নির্বাচনে ভোটের দিনের দৃশ্যপট এবং আগের ঘটনাবলি-দুইই আমার কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। এদিকে নির্বাচনি প্রচারণার পালে জোর হাওয়া। তখন আমার মনে হয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে যেসব প্রচারণা চলছে তা আসলে যায় না। কিন্তু এর ভিত্তি ঠিক আঁচ করতে পারছিলাম না। এ অবস্থায় কথা বলি নজরুল বিশ্বাস, মাহমুদ চৌধুরী, স্বপন খন্দকার, ইসমাইল হোসেন নেগাবান এবং তপংকর চক্রবর্তীর সঙ্গে। তারা সবাই সাংবাদিক এবং আমার সঙ্গে আস্থার সম্পর্কে ঘনিষ্ঠজন।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের খুনিদের অন্তত দুই জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছি একাধিকবার। তারা হচ্ছেন কর্নেল ফারুক ও মেজর শাহরিয়ার। সাপ্তাহিক জনকথা এবং সাপ্তাহিক ঝরণায় কাজ করার কারণে এই খুনিদের একাধিক অনুষ্ঠান কাভার করেছি। আর এই দুই পত্রিকার সুবাদে সেই সময় গভীরতা না বুঝলেও এতটুকু অনুধাবন করতে পেরেছি, ৭৫-এর খুনির ভিত্তি কতটা দৃঢ় ও গভীরে। পরবর্তী সময়ে মাহফুজউল্লাহ ভাইয়ের পত্রিকা ও তাঁর এনজিওতে কাজ করার সূত্রে জেনেছি, এই চক্রের পিছনে কত বড় থিংকট্যাংক কাজ করে। যে বিষয়ে আরো ধারণা হয়েছে, সাপ্তাহিক জনকথায় কাজ করার সময় খন্দকার মোশতাকের সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং আমেনা বেগমের বাসায় ‘বিশেষ দাওয়াত’ খাবার মধ্য দিয়ে। উল্লেখিত দুজনই দৃশ্যত বঙ্গবন্ধুর কাছের লোক ছিলেন। অথচ বাস্তবে মোশতাক ছিলেন বঙ্গবন্ধু খুনের নাটের গুরু। আর আমেনা বেগমকে ভিন্ন রূপে দেখা গেল ১৫ আগস্টের পর। সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণের ফান্ড ছিল তাঁর কাছে। অথচ পাকিস্তান দুঃশাসনের শিকার হয়ে বঙ্গবন্ধু যখন কারারুদ্ধ এবং এই অঞ্চল যখন নেতাশূন্য তখন একমাত্র নেত্রী আমেনা বেগম পুরো পূর্ব পাকিস্তান চষে বেড়িয়েছেন। সেই সময় মুক্তিকামী মানুষের স্লোগান ছিল, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। আর বিরুদ্ধবাদীদের অশ্লীল স্লোগানের কেন্দ্রে ছিলেন আমেনা বেগম। মোশতাক ও আমেনা বেগমের বিষয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ছিল পেশাগত জীবনের শুরুর দিকে, ১৯৭৯-৮০ সালে। পরে এই ধারণার সঙ্গে আরো কিছু যোগ হয়েছে। যে ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হয়েছে ১৯৮৭ সালে শেখ রেহানার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ, যা ১৬ মার্চ প্রকাশিত হয়েছে সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা সন্দ্বীপে।
বরিশাল সিটিতে গত নির্বাচনি প্রচারণায় অস্বাভাবিক দৃশ্যপটের বিষয়ে তপংকর চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলার পর মনে হলো, আরে সাদিক তো নিজে কারণ নয়, সে তো ‘ইউর সঙ্গে কিউ’ মাত্র। নেপথ্য কারণ তাঁর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। আরো গভীরে রয়েছেন আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং মূলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মনে হলো, সাদিকের বিরুদ্ধে যা কিছু বলা হচ্ছে তার পিছনে ৭৫-এর থিংকট্যাংক আদাজল খেয়ে কাজ করছে। অনেক চেষ্টার পর এই চক্র অপেক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিল। ধারণা করেছিল, আবুল হাসানাতের মৃত্যুর মধ্যদিয়ে বরিশালে আওয়ামী লীগের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নড়বড়ে হয়ে যাবে। কিন্তু মেয়র প্রার্থী হিসেবে সাদিক আবদুল্লাহ সামনে চলে আসায় ভিন্ন প্রেক্ষাপটের আলামত স্পষ্ট হয়ে যায়।
পূর্বাপর এই ধারণা থেকে প্রভাবিত হয়ে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে বরিশাল সিটি নির্বাচন চলাকালে ঢাকা টাইমসে একাধিক লেখা লিখেছি এবং কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেছেন, যা ছিল সেই সময় আলোচিত। যাকে এখন বলা হয় ভাইরাল। তবে একটি অংশের কাছে হয়েছি সমালোচিত। এখনো আমাকে ‘থিংকট্যাংক’ বলে বিদ্রুপ করা হয় কোনো কোনো মহল থেকে। এমনকি বছরখানেক আগে ক্ষমতাসীন দলের বরিশালের এক নেতা এই কথা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানককে বলেছেন তার বরিশালের বাসায় ভরা মজলিসে। এর একটু আগে আমি সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। অবশ্য আমার ইজ্জত রক্ষা করেছেন রাজনীতির দীর্ঘপথ অতিক্রমকারী নানক ভাই। তিনি বলেছেন, ‘সে পুরোনো সাংবাদিক, আমি তাকে চিনি।’ আমার প্রতি স্নেহশীল এই নেতা নিশ্চয়ই জানেন না, তাঁর প্রতিও আমার রয়েছে গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা। কারণ ১৯৯৬ সালে দুই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তোফায়েল আহমদ ও সেই সময়ের ডিএমপির মহা গুণধর ডিসি (ডিবি) সৈয়দ বজলুল করিমের রোষানলে পড়ে আমার ১৮ দিনের কারাভোগের ঘটনায় জাহাঙ্গীর কবির নানক বিক্ষুব্ধ ছিলেন, যা তিনি রেগে গিয়ে প্রকাশ করেছেন আমির হোসেন আমুর কাছে। তখন সেখানেও অনেক লোক ছিলেন, ছিলাম আমিও। যাক সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।
প্রথমে বরিশাল নগরীর তৃণমূলের সংগঠনের নতুন কান্ডারি এবং পরে সাদিক আবদুল্লাহ সিটিতে মেয়র প্রার্থী হওয়ায় পরিষ্কার হলো, আবুল হাসানাতের মৃত্যু মানেই বরিশালে আওয়ামী লীগ অধ্যায়ের অবসান নয়। তিনি ১৫ আগস্টের ঘাতকের বুলেট থেকে বেঁচেছেন ঘটনাচক্রে। সবাই জানে, সেই রাতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচেছেন ভাগ্যক্রমে বিদেশে থাকার কারণে। এই ভাই-বোনের মধ্যে অন্যমিলও আছে। ৭৫-এর পরও তাদেরকে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে এবং বেঁচে গেছেন অলৌকিকভাবে।
বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বাস্তবতায় শেখ হাসিনা যেমন টার্গেট তেমনই বরিশালের প্রেক্ষাপটে চক্ষুশূল আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ। এ ব্যাপারে ইসমাইল হোসেন নেগাবানের সঙ্গে কথা হয় ৮ জুলাই বরিশাল প্রেসক্লাবে। মন্টু ভাই বললেন, “সাদিক তো বিষয় না, উছিলা মাত্র। তাকে টার্গেট করা এবং চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্বে বাতাস দেওয়ার উদ্দেশ্য বরিশালে হাসানাত যুগের অবসান ঘটানো। গোটা দেশের বাস্তবতায় যেমন শেখ হাসিনা।” এ সময় সাবেক এক ফুল মন্ত্রী এবং বর্তমান এক হাফ মন্ত্রীর অস্বাভাবিক সখ্যের কখা জানালেন ইসমাইল হোসেন নেগাবান মন্টু। এদিকে অন্য এক ঘনিষ্ঠজন বললেন, চাচা-ভাতিজার দ্বন্দ্বে বরিশাল ‘আগাছা নেতাদের’ ভাবসাব বেড়েছে এবং রমরমা হয়েছে চাঁদাবাজি ও দখল বাণিজ্য!
লেখক: আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মন্তব্য করুন