ইডিসিএল বগুড়া শাখায় স্ক্র্যাপের মালামাল নিতে অস্বাভাবিক দর!

অস্বাভাবিক দর প্রদান করে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল) বগুড়া শাখার স্ক্র্যাপের মালামাল ক্রয়ের টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। টেন্ডার পেতে প্রতিষ্ঠানটি যে দর দিয়েছে তা দেখলে যে কারো চোখ কপালে উঠে যাবে। প্রতিষ্ঠানটি নষ্ট টিউবলাইটের দর দিয়েছে প্রতি পিস ৪২০০ টাকা, পোড়া মবিল প্রতি কেজি ২৬০০ টাকা, নষ্ট লোহা ৬০০ টাকা কেজি। পুরাতন খবরের কাগজ ৩০০ টাকা কেজি। এমন অস্বাভাবিক দর প্রসঙ্গে ইডিসিএল বগুড়া কর্তৃপক্ষ বলছেন, কেউ যদি অস্বাভাবিক দরে মালামাল কিনতে চায় সেখানে আমাদের করার কী আছে!
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতি দুই বছর পরপর এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের কারখানায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের মালামাল বিক্রয়ের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এবার ২০২৩-২০২৪ বছরের জন্য বগুড়া শাখায় প্রথম টেন্ডার নোটিশ প্রকাশ হয় চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি। টেন্ডার দাখিল হয় চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ওই টেন্ডারে দাখিলকৃত দরপত্রগুলো বাজারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল উল্লেখ করে বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। পরে পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হয়। সেটির দরপত্র দাখিল হয় চলতি বছরের ১২ এপ্রিল। সেখানে বগুড়ার ফাতেমা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠান অস্বাভাবিক দর দিয়ে প্রথম হয়েছেন। ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক বিপ্লব। তার দাখিলকৃত দরপত্রে পোড়া মবিল ২৬০০ টাকা কেজি। নষ্ট টিউবলাইট ৪২০০ টাকা প্রতি পিস। নষ্ট লোহা ৬০০ টাকা কেজি। পুরাতন খবরের কাগজ ৩০০ টাকা কেজি। ছেড়া কাগজ ৪৮ টাকা কেজি। কাপড়ের পুরাতন ব্যাগ ৬০০ টাকা প্রতি পিস। রাবারের নষ্ট সেন্ডেল ৩৮৫ টাকা কেজি। বাতিল এসএস নেট ৭১০০ টাকা কেজি। এসির পুরাতন পাইপ ৫৮০৩ টাকা কেজি। প্লাস্টিকের জারকিন ৫-১০ লিটার সাইজ প্রতিপিস ৭১৭ টাকা। প্লাস্টিকের জারকিন ২০-৩০ লিটার সাইজ প্রতি পিস ৫০৩ টাকা। প্লাস্টিকের কন্টেইনার ১-৫ লিটার সাইজ ৭১৬ টাকা প্রতি পিস। পিপি পলিথিন প্রতিকেজি ৭০০ টাকা। উল্লেখিত টাকার পরিমাণের সঙ্গে ভ্যাট এবং ট্যাক্স যোগ হয়েছে আরো সাড়ে ১৭ শতাংশ টাকা। এমন অস্বাভাবিক দরে ৪২টি পুরাতন পণ্য ক্রয়ের জন্য বিপ্লব দরপত্র দিয়ে প্রথম হয়েছেন।
এদিকে আগের (২০২০-২০২১) টেন্ডারের মূল্য তালিকায় পোড়া মবিলের দাম ছিল ৩৫ টাকা লিটার। এবার সেটি বিপ্লব কিনছেন ২৬০০ টাকা লিটার। ছেঁড়া কাগজের কেজি ছিল ৬ টাকা। এবার বিপ্লব কিনছেন ৪৮ টাকা কেজি। নষ্ট টিউবলাইটের দাম ছিল ১০ টাকা এবার সেটি বিপ্লব দাম দিয়েছেন ৪২০০ টাকা প্রতিপিস। পুরাতর খবরের কাগজের দাম ছিল ৩৫ টাকা কেজি। এবার ৩০০ টাকা কেজি কিনছেন বিপ্লব।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির মালিক বিপ্লবের সঙ্গে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড বগুড়া শাখার একজন সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং প্রধান কার্যালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। তাদের পরামর্শে এবং যোগ সাজসে বিপ্লব অস্বাভাবিক দর প্রদান করেন। পরে মালামাল বের করার সময় পরিমাণের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি মাল বের করে পুষিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা হয়। সেই অনুযায়ী বিপ্লব তার প্রথম চালানে অফিসিয়াল হিসাব অনুযায়ী মালামাল বের করেন ২৩২৩ কেজি এবং ৫৫৫ পিস ফাইবার ড্রাম। এই পরিমাণ মালামাল বের করতে একটি ট্রাক যথেষ্ট হলেও তার পছন্দের কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় তিনি চার ট্রাক মালামাল বের করেন। যদিও অফিসিয়ালি ৩ ট্রাক মালামাল বের হওয়ার কথা স্বীকার করা হয়েছে।
হিসাব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বিপ্লব প্রথম চালানে কার্টন ১৮৯৩ কেজি, ছেঁড়া কাগজ ৪৩০ কেজি, ফাইবার ড্রাম ৫৫৫ পিস নিয়েছেন। যার মূল্য ৯১ হাজার ৬০০ টাকা। ক্রয়কৃত মালামালের ওজন ২৩২৩ কেজি এবং ফাইবার ড্রাম ৫৫৫ পিস যা একটি ট্রাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ঠিকাদার ২৫ ও ২৬ জুন-২০২৩ তারিখে ২ দিনে মোট ৪ গাড়ি বোঝাই করে স্ক্র্যাপের মালামাল নিয়ে যান। অর্থ্যাৎ ২৫ জুন তারিখ অফিস সময় বিকাল ৪ ঘটিকার পর এক গাড়ি, পরের দিন ২৬ জুন তারিখ দুপুর ১২ ঘটিকায় এক গাড়ি এবং একই দিনে অফিস ছুটির পর সবাই চলে গেলে বিকাল ৫:১০ মিনিটে এক সঙ্গে আরও ২ গাড়ি বোঝাই করে স্ক্র্যাপের মালামাল গেট দিয়ে বের করে নিয়ে যায় (বিকাল ৫:১০ মিনিটে গেট দিয়ে বের হওয়া গাড়ি ২টির ড্রাইভারের নাম মো. নজরুল ইসলাম ও মো. রুহুল আমিন)। এসব গাড়িতে মূলত কত পরিমাণ এবং কতটাকার স্ক্র্যাপের মালামাল পার করা হয়েছে তার হিসাব বোঝা মুশকিল। তবে সিসিফুটেজ, গেট পাশের তথ্য এবং বিপ্লবের অধীনে মোস্তাক নামের এক লেবার স্ক্র্যাপে কাজ করছেন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে।
এ বিষয়ে জানতে বগুড়ার ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী বিপ্লবে সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বেশি দামে পণ্য ক্রয়ের জন্য মাথা ব্যথা আমার হওয়ার কথা, এ বিষয়ে আপনার মাথা ব্যথা কেন? তিনি পোড়া মবিল রিফাইন করেন। কিন্তু সেই রিফাইন মবিল দিয়ে কী করেন, কতটাকা বিক্রি করেন কতটাকা লাভ করেন সে বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি। ২৩২৩ কেজি মালামাল বের করতে চারটি ট্রাক লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছেড়া কাগজ কার্টন ড্রাম এগুলো জায়গা বেশি লাগে এজন্য এতোগুলো গাড়ি লাগতেই পারে।
অস্বাভাবিক দরের টেন্ডার প্রসঙ্গে এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের বগুড়া শাখার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মনিরুল ইসলাম বলেন, কেউ যদি অস্বাভাবিক দরে মালামাল কিনতে চায় সেখানে আমাদের করার কী আছে? অফিসের চোখ ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত মালামাল কেউ বের করতে পারবে না বলে তিনি জানান। ঠিকাদার বিপ্লবের প্রথম চালানের মালামাল কীভাবে কয়টা ট্রাকে বের হয়েছে জানতে চাইলে তিনি ম্যানেজার অ্যাডমিন আহাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের বগুড়া শাখার ম্যানেজার অ্যাডমিন আহাদুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ঠিকাদার বিপ্লবের প্রথম চালানের মালামাল বের হয় ২৩২৩ কেজি। টাকার অংকে ৯১ হাজার ৬০০ টাকা। দুই দিনে ৪টি নয় ৩টি ট্রাক বের হয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেন। ওই পরিমাণ মালামালের জন্য ৩টি ট্রাকের প্রয়োজন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্ক্র্যাপের যে মালামালের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলোতে জায়গা বেশি লাগে। এ জন্য ৩টি ট্রাকেই ওসব মালামাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অস্বাভাবিক দর সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে আমাদের তো করার কিছু নেই। কেউ যদি বেশি দাম দিয়ে মাল ক্রয় করে তাহলে তো আমাদের প্রতিষ্ঠানের লাভ। আর সেটা তিনি বুঝবেন। কেউ যদি দর কম দিতো সেক্ষেত্রে আমরা ধরে বসতাম। তবে আমি এরকম অস্বাভাবিক দর দেখে তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি এরকম দামেই কিনতে আগ্রহী তাই তাকে দেয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু প্রতিষ্ঠানটি বেশি দামে টেন্ডার দিয়েছে সেহেতু তাকে ওই দামেই দুই বছর মালামাল কিনতে হবে। তবে এখানে নয় ছয় করার সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন।
(ঢাকাটাইমস/৩১জুলাই/এআর)

মন্তব্য করুন