‘আমাদের বাঁচার দাবি’-৬ দফা ও বঙ্গবন্ধু উপাধি

বাঙালির "প্রাণের দাবি" ও "বাঁচা-মরার দাবি" আর বঙ্গবন্ধুর ভাষায় "আমাদের বাঁচার দাবি" হাজার হাজার বছরের ইতিহাসের পথ চলায় বাঙালি জাতির চাওয়া-পাওয়ার ধারাপাতে অগণিত আশা-আকাঙ্ক্ষার সারসংক্ষেপ তৈরি করেছিলেন মাত্র ৬ টি দাবির মধ্যে। যা বাঙালি জাতির ইতিহাসে ম্যাগনাকার্টা বা মুক্তির দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মাত্র ৬ টি চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে একটি জাতিসত্তার সমস্ত আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটানো যায়, এত সংক্ষিপ্ত দলিল প্রণয়ন করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ব্যতীত পৃথিবীর আর কোন জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতার দর্শনে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। অনন্য অন্তর্দৃষ্টির স্বচ্ছ আলোয় স্ক্যানিং করে এমন কীর্তি রচনায় বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করা যায় তৎপূর্ব, তৎকালীন এমনকি সমসাময়িক বিশ্ব ইতিহাসে আর কোন বিশ্বনেতার নাম অনায়াসে উচ্চারণ করা সত্যিই স্পর্ধার।
যুক্তিতর্ক এবং প্রকাশে তা স্বায়ত্তশাসনের নিমিত্তে প্রণয়ন করে কৌশলগতভাবে প্রকাশ করার বাস্তবতা সত্য। অন্যথায় তা সেসময় প্রকাশের ক্ষেত্রে অনিবার্যভাবে বিছিন্নবাদিতা, রাষ্ট্রদ্রোহিতা নানা খরগে গলা কাটা যেতো। রাজনৈতিকভাবে প্রাজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার সবটুকু প্রয়োগ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন চেয়ে সে দাবি তুললেও বঙ্গবন্ধু জানতেন, তাঁর মনের কথা জানেন গোবিন্দ। এটি উত্থাপন করলে নিশ্চিতভাবে প্রত্যাখ্যত হবেন এবং সে প্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যানই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে অনেক বেশি গতিশক্তি ও প্রাণের সঞ্চার করবে। বাঙালি জাতির বাঁচা-মরার এ দাবিকে প্রত্যাখ্যান করলে সমস্ত বাঙালি জাতির আবেগকে একই সূতোয় গাঁথা অনেক বেশি সহজ হয়ে যাবে। সেটি বঙ্গবন্ধু তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করেছেন এবং পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে সে পথ পরিকল্পনা তিনি করেই রেখেছিলেন। এমনকি এ প্রস্তাব উত্থাপন করলে তার ব্যক্তিগত পরিণতি কী হবে সেটাও তিনি জানতেন। কারণ জেল জীবন সম্পর্কে তিনি এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন যে, আবার কখন তিনি জেলখানায় যাবেন তা তিনি সহজে বুঝতে পারতেন। জাতির মুক্তির সনদে যা দাবি করা হয়েছিলঃ
এক- যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাধীনের সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হবে। সার্বজনীন ভোটাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান।
দুই - কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দুইটি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
তিন - সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক অথচ অবাধে বিনিয়োগ যোগ্য মুদ্রা, না হয় বিশেষ শর্তসাপেক্ষে একই ধরনের মুদ্রা প্রচলন।
চার- ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর কর বা শুল্ক ধার্য এর ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। তবে, প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে।
পাচ- অঙ্গরাষ্ট্রগুলো নিজেদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার মালিক হবে, এর নির্ধারিত অংশ তারা কেন্দ্র কে দেবে।
ছয়- আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধাসামরিক বা সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
একটি কেন্দ্রীয় দুর্বল সরকারের অধীনে পরিচালিত পাকিস্তানি ফেডারেশনে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পূর্ব চিত্রিত কল্পনা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর দেওয়া প্রস্তাব, সম্মেলনের উদ্যোক্তারা প্রত্যাখ্যান করেন এবং শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। শেখ মুজিব এই দাবিকে "আমাদের বাঁচার দাবি" শিরোনামে ১৯৬৬' র ৫ ই ফেব্রুয়ারি লাহোর প্রস্তাবে উত্থাপন করেন। প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হলে বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য পরবর্তীতে কি করবেন তার রোডম্যাপ করা ছিল বলে বাংলার আনাচে কানাচে ছয়দফার ঢেউ ছড়িয়ে দেয়ার বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আওয়ামী লীগ পহেলা মার্চ ১৯৬৬ শেখ মুজিবকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করলেন। ছয় দফা কে সামনে রেখে স্বাধীনতার লক্ষ্যে মুক্তিকামী মানুষকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা-সিলেট-চট্টগ্রাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পথসভা, জনসভা করতে শুরু করলেন। সে সকল সভায় লাখো লাখো মানুষের উপস্থিতির স্বতস্ফূর্ততা এবং বৈপ্লবিক মানসিকতার প্রতিফলন দেখে পাকিস্তানি শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত্র হওয়া শুরু করল। বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিণতি বুঝতে পেরে খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাঙালি জাতির চেতনায় এ বিপ্লবী তরঙ্গ ছড়িয়ে দিলেন। পথিমধ্যে কয়েকবার আটক হলেন ছাড়া পেলেন আবার শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধুর অব্যক্ত মতিগতি সামরিক শাসকরা বুঝতে পেরে সে সময় তাকে দুই বছরের জন্য আটকে রাখলেন জেলখানায়। মুক্তির মহানায়ক কে দমাতে পারলেই কেবল অখন্ড পাকিস্তানকে সামরিক শাসকেরা রক্ষা করতে পারবেন। এমন ভাবনায় বঙ্গবন্ধুকে জেলে রেখে উত্তম উপায়ন্তর না পেয়ে তার গতিপথ পরিবর্তনের চেষ্টায় ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতিকে সক্রিয় করার লক্ষ্যে রাজাকার শ্রেনীর মানুষ কে বেছে নেন প্রতিপক্ষ হিসেবে। এ লক্ষ্যে কিছু বিড়ম্বনা তৈরি করবার ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে পারলেও বঙ্গবন্ধুর দেয়া ছয়দফার বিদ্যুতায়িত তরঙ্গ সমস্ত বাঙালি জাতির মধ্যে যে আবেগ, অনুভূতি, বিপ্লবী মানসিকতা সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল সে তুলনায় তাদের এ প্রচেষ্টা ছিল অতি তুচ্ছ। যে কারণে যুদ্ধের আগে কিংবা ছয় দফার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে এ দাবির বিরুদ্ধে বেছে নেওয়া রাজাকার গোষ্ঠীদের কে ব্যবহার করে মাঠে কোনো সক্রিয় প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে সক্ষম হন হয়নি তৎকালীন সামরিক শাসকেরা।
বাংলা নতুন রূপে তার নিজের অস্তিত্বকে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বকীয়তা অর্জন করবে বলেই বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগসহ ছাত্রজনতা এবং বাংলার আপামর মানুষের চেতনায় তাড়িত অনুপ্রেরণা আন্দোলনের রূপরেখাকে আরো শক্তিশালী করতে থাকলো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল। ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানিরা তাদের সর্বশেষ ভুলের অবতারণা করলেন। সেটি ছিল ১৯৬৮ সালে সামরিক-বেসামরিক রাষ্ট্রীয় উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদেরকে অভিযুক্ত বিবেচনায় নিলেন যারা বঙ্গবন্ধুর চিন্তা-চেতনাকে সমর্থন করে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রগঠনে এবং তা টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবেন। ভারতের ত্রিপুরা অঙ্গরাজ্যের আগরতলায় ভারতীয় সরকারের সাথে শলা পরামর্শ করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে পাকিস্তানকে বিভক্ত করতে চায় এরকম একটি বিষয় বস্তুকে ধারণ করে পাকিস্তানি শাসকরা শেখ মুজিবকে অভিযুক্তের তালিকায় ১ নম্বরে রেখে সর্বমোট ৩৫ জনকে অভিযুক্ত করে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা করলেন১৯৬৮' র ০৩ জানুয়ারি। ইতিহাসে যা 'মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে অধিক পরিচিত। ১৯৬৮'র ১৮ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করলেন। আওয়ামী লীগের চেতনায় ভর করে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি চলাকালীন সময়ে শেখ মুজিবের ছয় দফাসহ আরো পাঁচ দফা সংযোজন করে ১১ দফা আন্দোলন শুরু হয়। জেলের তালা ভেঙে শেখ মুজিবকে মুক্ত করার একটি বাস্তবমুখী স্বপ্ন আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্রে অনুরণিত হতে থাকে। চলমান এ আন্দোলন পর্যায়ক্রমে সকল স্তরের মানুষের সম্পৃক্ততায় বিস্ফোরণমুখ আকার ধারণ করতে করতে ১৯৬৯' র গণঅভ্যুত্থানের জন্মদিলে ১৪৪ ধারাসহ সকল প্রকার বিধি নিষেধ উপেক্ষা করে ছাত্রজনতার আত্নত্যাগ ও রক্তমূল্যের চাপের মুখে পাকিস্তানি সামরিক শাসকেরা আতঙ্কিত হয়ে শেখ মুজিব ও অন্যান্য অভিযুক্তদেরকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অতঃপর তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান তথা আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে বাংঙালির প্রাণের নেতা শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেয়ার আয়োজন করা হয়। বাঁধভাঙ্গা জনতার উপস্থিতিতে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে শেখ মুজিবকে 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত করলেন তুখোড় ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সকল প্রেক্ষাপটকে ছাড়িয়ে গিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির একমাত্র মুক্তির দূত। রাজনীতির প্রাজ্ঞতা অনুভবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১ দফা কে সমর্থন করে দল মত নির্বিশেষে সকল দলের আশা আকাঙ্খার প্রতীক হিসাবে সকলের নেতা হয়ে উঠলেন। বাঙালি জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সকলকে একসাথে এক সুতোয় বেঁধে বাংলাদেশ নামক একটি মাল্য তৈরিতে সফল হলেন বঙ্গবন্ধু। একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম দেয়ার পূর্বেই দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেনিপেশা ও সাধারণ মানুষের ভালবাসার জারক রসের সিক্ত সুতোয় নির্মিত 'বঙ্গবন্ধু' সম্মান অর্জনের মতো স্বতঃস্ফূর্ত উপহার পৃথিবীর আর কোনো রাজনৈতিক নেতার জীবনে এমন উপাধি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রাপ্তির এদিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুই একমাত্র বিশ্ব জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি এমন সম্মান অর্জন করেন।
সাধারণ মানুষের ভালবাসার জারক রসের সিক্ত সুতোয় নির্মিত 'বঙ্গবন্ধু' সম্মান অর্জনের মতো স্বতঃস্ফূর্ত উপহার পৃথিবীর আর কোনো রাজনৈতিক নেতার জীবনে এমন উপাধি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। প্রাপ্তির এদিক বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুই একমাত্র বিশ্ব জাতীয়তাবাদী নেতা, যিনি এমন সম্মান অর্জন করেন।
লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

মন্তব্য করুন