হারিয়ে যাচ্ছে উপকূলের বনভূমি, রক্ষায় দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি

আব্দুল কাইয়ুম, কুয়াকাটা (পটুয়াখালী)
| আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:১৫ | প্রকাশিত : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০৯

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত লাগোয়া কয়েক কিলোমিটারজুড়ে এক যুগ আগেও ছিলো ঘন বনাঞ্চল। যেকোনো মানুষ বনের মধ্যের সরু রাস্তায় চলাচল করতে আতঙ্কে থাকতো। বন্যপ্রাণির ডাকে শিহরিত হয়ে উঠতেন যে কেউ। বঙ্গোপসাগরের তীব্র ঢেউয়ের ঝাপটায় সৈকতে বালুক্ষয়ে কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রসহ উপকূলকে বিপন্ন করে তুলেছে।

পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ৩০ কিলোমিটারজুরে একের পর এক হাজার হাজার হেক্টর বনভূমি তিন দশকের ব্যবধানে সাগরগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এসকল বনমিভূমি বিলীন হলেও তা রক্ষায় নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ।

কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের সর্বশেষ বনভূমি সম্প্রতি কয়েক বছরে সমুদ্রগর্ভে চলে যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে মাস্টারপ্লান প্রকল্পের আওতাধীন থাকলেও কবে নাগাদ সেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন হবে তা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত দেশের একটি বিশেষ পর্যটন জোন। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটা ঘিরে দক্ষিণ জনপদে রয়েছে অর্থনৈতিক মহাসম্ভাবনার দ্বার।

উপকূলের বনভূমি রক্ষিত থাকার কথা থাকলেও এগুলো সুরক্ষা দেওয়ার কাজটি এখনো প্রকল্পভিত্তিক রয়ে গেছে। পাউবো, বন বিভাগ কিংবা সরকারের অন্য সংস্থাগুলো বনভূমি ও সমুদ্র সৈকত রক্ষায় স্থায়ী কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে পারেনি আজও। বিভিন্ন সময়ে সরকারের প্রতিনিধিরা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে মাস্টারপ্লান বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়ে আসলেও তা আর আলোর মুখ দেখেনি। বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, পর্যটকসহ স্থানীয়রা বর্তমান সমুদ্র সৈকতসহ বনভূমির ধ্বংসলীলা দেখে হতাশ হয়ে পড়ছেন।

তারা বলছেন, পরিবেশের ভারসাম্য এবং পর্যটন শিল্প টিকিয়ে রাখতে দ্রুত সরকারের মাস্টারপ্লান বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

সরেজমিনে কুয়াকাটা পর্যটন কেন্দ্রটির মূল আকর্ষণ সি-বিচের পূর্বে রাবনাবাদ ও পশ্চিম প্রান্তে আন্ধারমানিক নদীর মোহনার শ্রোত গতি পরিবর্তনের কারণে তীব্র ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৯৮ সাল থেকে প্রতিবছর এক মিটার করে সি-বিচ বিলীন হয় বলে পাউবো সূত্রে জানা যায়। তবে ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডর পরবর্তী মহিপুর রেঞ্জের আওতাধীন কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের ৩০ কিলোমিটারজুরে বনভূমির ধ্বংসলীলা আরো তীব্রতর হয়। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ড বা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের তরফের দায়িত্বশীল কোনো ভূমিকা না থাকায় ভয়াবহ ভাঙনের ক্ষিপ্রতায় উদ্বিগ্ন সকলেই।

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বিগত কয়েক দশকে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতসহ বনভূমি সংকীর্ণ হয়ে আসলেও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগিয়ে আসেনি কোনো মহল। ২০০৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কুয়াকাটা এসে পর্যটন মন্ত্রণালয়ের এক মূল্যায়ন সভায় সমুদ্র সৈকতের সংস্কার ও আধুনিকায়নে অর্থ বরাদ্দসহ পর্যটন কেন্দ্রটিকে ‘একান্ত পর্যটন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন। এরপর ২০১০ সালে ভাঙন রোধে উদ্যোগ গ্রহণ করে পাউবো। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের শেষের দিকে সমুদ্রের তীব্র ঢেউয়ের ছোবল থেকে বালুক্ষয় ঠেকাতে, পর্যটন নগরীর সৌন্দর্য বর্ধনে, তরিঘরি করে অপরিকল্পিত ভাবে দফায় দফায় কুয়াকাটা জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র দের কিলোমিটার এলাকায় সৈকত সুরক্ষা বাঁধ স্থাপন করেন পাউবো।

কুয়াকাটা ভাঙন রোধ ও আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র করে গড়ে তুলতে উপকূলীয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থেকে সি-বিচ পর্যন্ত ২০২২ সালের এক প্রস্তাবনায় রাবনাবাদ ও আন্দারমানিক নদীর মোহনা পর্যন্ত ভাঙন রোধ হবে বলে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পেশ করে পাউবো। কয়েক ধাপে নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এ লক্ষ্যে ব্যাপক সমীক্ষা সম্পাদনের মাধ্যমে নকশা প্রনয়ন করা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

বঙ্গোপসাগরের আঘাতে বিপর্যস্ত পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা রক্ষায় ২০২০ সালের আগস্টে ও ২০২১ সালের সেপ্টম্বরে দফায় দফায় কুয়াকাটা ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শনকালে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম (এমপি) বলেন, কুয়াকাটায় ভাঙন রোধসহ একটি নিরাপদ ও আদর্শ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে সরকার খুবই আন্তরিক। তিনি সবশেষ গত আগস্টে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে ১২'শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় রয়েছে। যার সমিক্ষাও শেষ হয়ে গিয়েছে। যেকোনো সময় একনেক ভিত্তিক এই প্রকল্পটি অনুমোদন হতে পারে। নতুন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলেই সমুদ্র ভাঙন রোধ হবে। সৌন্দর্য ফিরে পাবে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে। তবে সেই প্রকল্পটিও আলোর মুখ দেখেনি।

এদিকে ভাঙনের কবলে সমুদ্র সৈকতের আন্ধারমানিক নদীর মোহনা থেকে শুরু করে কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের প্রধান ফটক পর্যন্ত প্রায় ৫ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোনো বনভূমি অবশিষ্ট নেই।

স্থানীয় বয়োবৃদ্ধ একাধিক বাসিন্দারা বলছেন, তিন দশক পূর্বে এই এলাকাগুলোতে ছিলো কয়েক কিলোমিটার বনভূমি। যা সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়ে এখন বেরীবাঁধ ছুঁইছুঁই। পাঁচ কিলোমিটার সৈকত তীব্র ভাঙনপ্রবণ এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। এসব এলাকায় জোয়ারের সময় মূল সৈকত থাকছে না। জোয়ারে উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডব সরাসরি বন্যানিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধে আঘাত করছে।

পাউবোর উদ্যেগে বেরীবাঁধ রক্ষায় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও বনভূমি রয়েছে শেষ ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে। কুয়াকাটা জাতীয় উদ্যানের গঙ্গামতি বিট, চর গঙ্গামতি বিট (কাউয়ার চর) রামনাবাদ মোহনা পর্যন্ত সমুদ্র কেন্দ্রীক হাজার হাজার বাসিন্দারা রয়েছে সমুদ্র থাবার নানা দুর্যোগ ঝুঁকিতে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই এই উপকূল অঞ্চলগুলোয় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে। সমুদ্রের নানা দূর্যোগের কারনে প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার গাছপালা। জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে গত তিন দশক ধরে সবচেয়ে বেশি বনভূমি উজার হয়েছে বলে জানান মহিপুর রেঞ্জের বন কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ। অবশিষ্ট বনভূমি রক্ষায় সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন এই কর্মকর্তা।

কুয়াকাটা উপকূলের বাসিন্দা মো. বেলাল বলেন, দক্ষিণের জনপদে বর্তমান সরকারে নানা উন্নয়ন অবকাঠামো মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ও বনভূমি রক্ষায় সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে এমন কোনো দৃশ্য বিগত কয়েক দশকে আমাদের চোখে পড়েনি। সেই দীর্ঘ কয়েক কিলোমিটার ডিঙিয়ে আমাদের বসতি পর্যন্ত এখন সমুদ্রের পানি এসে প্লাবিত হয়। বর্তমানে আমাদের বসবাসের যোগ্য কোনো উপায় নেই।

কুয়াকাটায় বিনিয়োগকারী হাসনাইন ইকবাল বলেন, সাম্প্রতিক কয়েক দশক থেকে ঘূর্ণিঝড় সিডর পরবর্তী কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের বনভূমি তীব্র ভাঙনের মুখে পরে অতি দ্রুত সমুদ্রেগর্ভে বিলীন হলেও তা রক্ষায় কোনো দায়িত্বশীল মহল ভূমিকা নিয়েছেন তা আমরা দেখিনি।

কুয়াকাটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও কুয়াকাটা পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, কুয়াকাটা উন্নয়নে স্থায়ী মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে অচিরেই কুয়াকাটা সৈকতসহ বনভূমি সমুদ্রগর্ভে হাড়িয়ে যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে মহা পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে সরকার প্রধানের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।

পাউবোর কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন অলীদ জানান, বর্তমানে ৭৫০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এটি অনুমোদন পেলে কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত রক্ষা করা সম্ভব হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

(ঢাকাটাইমস/০২ সেপ্টেম্বর/ইএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :