সর্বজনীন পেনশন নিয়ে ফখরুলের প্রতিক্রিয়া এবং বাস্তবতা

মো. সাখাওয়াত হোসেন
 | প্রকাশিত : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:০৭

আওয়ামী লীগ সরকারের চালু করা সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাকে জনগণের অর্থ আত্মসাতের আরেকটি চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপি আয়োজিত গণমিছিলে বক্তৃতাকালে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সম্ভাব্য ভোট কেনাসহ নিজেদের উদ্দেশ্যে এই তহবিলের অপব্যবহার করতে চায়। মির্জা ফখরুল বলেন, এরা (সরকার) নাকি পেনশন ভাতা দিবে। এরা টাকা চুরি করার আরেকটা নতুন ফন্দি করছে। সেই টাকা চুরি করে ভোট করবে এরা।

অর্থাৎ মির্জা ফখরুলের বক্তব্যে খুবই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, নিয়মানুযায়ী সরকার ভোট করবে এবং ভোটে বিএনপিও অংশগ্রহণ করবে। বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসত তাহলে প্রতিপক্ষকে নিয়ে ভাবনা চিন্তার তেমন অবকাশ থাকার কথা নয়। প্রতিপক্ষের দিকে অভিযোগের তীর ছুঁড়ে দেওয়ার জন্যই টাকা দিয়ে ভোট করার প্রসঙ্গ তিনি তোলে নিয়ে এসেছেন।

অথচ সার্বজনীন পেনশন নিয়ে সংসদে পাশ হওয়া আইনে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এই সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে শুধুমাত্র সরকারি, আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন সুবিধা পেয়ে থাকেন। এই আইনের মাধ্যমে যেসব বেসরকারি চাকরিজীবী কোনরকম পেনশন সুবিধা পান না, তাদের পেনশনের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিরাও এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এজন্য এই তহবিলে স্বেচ্ছায় নিবন্ধন করে মাসিক বা ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে চাঁদা দিতে হবে। অন্তত ১০ বছর চাঁদা দিলে এবং বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে জমা ও মুনাফার বিপরীতে তিনি আজীবন পেনশন পাবেন।

আইনে বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান, নাগরিকদের চাঁদা, বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা, প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণের চাঁদা, ইত্যাদি নিয়ে পেনশন তহবিল গঠিত হবে। এক বা একাধিক ব্যাংক, পোস্ট অফিস সমূহ এই পেনশন তহবিলের চাঁদা আদায়ের সম্মুখ অফিস হিসাবে কাজ করবে।বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে সবার জন্য পেনশন চালু করার অঙ্গীকার ছিল। গত বছরের ১৭ই ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৬০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর তাগিদ দেন। এরপর গত বছরের ২৯শে আগস্ট এই বিষয়ে বিল সংসদে তোলে সরকার।

দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দেখা যায়, সরকার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বিরোধী পক্ষদের কোন না কোনভাবে সেটির সমালোচনা করতেই হবে। ইত্যবসরে আওয়ামী লীগ সরকার যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে যদি পদ্মা সেতুর বিষয়টি উল্লেখ করি সবকটিতে বিএনপি সমালোচনা করেছে অর্থাৎ বিএনপির চোখে সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপ অসংলগ্ন, দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন ইত্যাদি ইত্যাদি। আচ্ছা সম্মানিত পাঠক আপনারাই বলুন তো, সরকারের গৃহীত সকল পদক্ষেপ কি সমালোচনার যোগ্য?

বিএনপির প্রেস উইং কিংবা দায়িত্বশীল যারা সংবাদ মাধ্যমে কথা বলেন, তাদের নিকট হয়তবা দলের শীর্ষ পর্যায়ের একটি নির্দেশনা দেওয়াই রয়েছে সরকারের সকল কর্মকান্ডের গুরুতর সমালোচনা করতে হবে। নতুবা সব ব্যাপারেই কেন সমালোচনা করতে হবে, তাহলে কি ধরে নেওয়া যায় সরকারের কোন পদক্ষেপই প্রশংসার যোগ্য নয়? অথচ বিদেশীরা বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করছেন এবং বিশ্ব মিডিয়ায় এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে আট কোটি। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী রয়েছেন ১৪ লাখের কিছু বেশি। বিলটি আইনে পরিণত হওয়ায় অর্থাৎ সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু হওয়ায় প্রায় আট কোটি ৩৫ লাখ মানুষ এই ব্যবস্থার আওতায় আসবেন। খসড়া বিলে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান, বেকারত্ব, ব্যাধি, পঙ্গুত্ব বা বার্ধক্যজনিত কারণে নাগরিকদের সরকারি সাহায্য দেয়া, বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে একটি টেকসই নিরাপত্তা বলয়ে নিয়ে আসার উদ্দেশ্যে এই সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা তৈরি করা হচ্ছে।

বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। ২০৩১ সালের মধ্যে দেশে দুই কোটির বেশি মানুষের বয়স হবে ৬০ এর উপরে। বর্তমানে বাংলাদেশে ৬৫ বছরের উপরে দরিদ্র বয়স্কদের ৫০০ টাকা করে মাসিক ভাতা দেয় সরকার। তবে ৬৫ বছরের উপরে ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কোন ধরনের পেনশন ও বয়স্ক ভাতা কিছুই পান না।

যেসব শর্তে পেনশন ব্যবস্থা চালু হতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী নাগরিকরা এই স্কিমে অংশ নিতে পারবেন। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকরাও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন। এই পেনশন ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্তি হওয়ার পর কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা প্রদান করলে পেনশন সুবিধা পাওয়ার যোগ্যতা হবে। চাঁদা দাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে জমা ও মুনাফার বিপরীতে তিনি পেনশন পাবেন। প্রত্যেক চাঁদা দাতার জন্য আলাদা আলাদা পেনশন হিসাব থাকবে। পেনশন কর্তৃপক্ষ সর্বনিম্ন চাঁদার হার নির্ধারণ করে দেবে। এই চাঁদা মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে, অগ্রিম বা কিস্তি আকারে জমা দেয়া যাবে। পেনশনারগন আজীবন, অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পেনশনের সুবিধা পাবেন। পেনশনে থাকাকালে ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মৃত্যু হলে, তার নমিনি অবশিষ্ট সময় (মূল পেনশনারের ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত) মাসিক পেনশন পাবেন। পেনশন তহবিলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে চাঁদা দেয়া শুরু করে ১০ বছর পার হওয়ার আগেই কেউ মারা গেলে, তার সব জমা টাকা মুনাফাসহ তার নমিনিকে ফেরত দেয়া হবে। পেনশন তহবিলে জমা দেয়া টাকার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত চাঁদা দাতা ঋণ আকারে উত্তোলন করতে পারবেন। তবে সেজন্য ফি দিতে হবে। পরবর্তীতে ফিসহ মূল টাকা আবার পেনশন তহবিলে ফেরত দিতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য পেনশন তহবিলে চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসাবে দেবে।

প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, সরকারি অনুদান, নাগরিকদের চাঁদা, বিনিয়োগকৃত অর্থের মুনাফা, প্রতিষ্ঠানসমুহের অংশগ্রহণের চাঁদা, ইত্যাদি নিয়ে পেনশন তহবিল গঠিত হবে। এক বা একাধিক ব্যাংক, পোস্ট অফিস সমূহ এই পেনশন তহবিলের চাঁদা আদায়ের সম্মুখ অফিস হিসাবে কাজ করবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, যেভাবে সরকার বিশেষ কর্তৃপক্ষ গঠন, তহবিল ব্যবস্থাপনা এবং পেনশন ব্যবস্থার শর্তগুলো দিয়েছে, তা খুব ভালো উদ্যোগ। তবে এটা সব শ্রেণির মানুষের কাছে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হবে।

তিনি বলছেন, প্রথমত পুরো পেনশন ব্যবস্থার সুবিধার ব্যাপারে সবাইকে সুস্পষ্টভাবে জানাতে হবে যে কত চাঁদা দিলে কত টাকা পাওয়া যাবে। অনেকে হয়তো এখন অংশ নিলেন, পরবর্তীতে হয়তো কর্মহীন হয়ে গেলেন। সেজন্য সরকারের একটা ভালো ডাটাবেজ থাকতে হবে।

আরেকটি বড় বিষয় হলো, এখানে তো বড় আকারের একটা ফান্ড হবে। সেটা কীভাবে ব্যবহার করা হবে, কীভাবে বিনিয়োগ করা হবে, সেটার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। পেনশন তহবিলের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে বলে তিনি মনে করেন - প্রথমত, পুরো ব্যবস্থাকে ডিজিটাল প্লাটফর্মের মাধ্যমে নজরদারি করা। দ্বিতীয়ত, যে কর্তৃপক্ষ থাকবে, তারা যাতে বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত ঠিকভাবে নিতে পারেন সেটা দেখা এবং তৃতীয়ত, স্বচ্ছতা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কারণ এটা খুব বড় একটা তহবিল হবে, সেটাকে নিরাপদ ও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।

মির্জা ফখরুল যাই বলুক না কেন, দেশের মানুষ সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাকে সাদরে গ্রহণ করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের পরেই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সার্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন করেছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগও তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন ঘটালো।

কাজেই, সরকারের ঘোষিত কিংবা গৃহীত যে কোন ব্যাপারে যাচাই বাছাইয়ের সক্ষমতা এ দেশের জনগণের রয়েছে। কারো নেতিবাচক আলোচনায় এ দেশের মানুষ বিভ্রান্ত না হয়ে সত্য ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বরাবরেই মতই পারঙ্গম হবে আশা রাখি। সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার মহৎ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হওয়ার প্রত্যাশা রাখে এ দেশের জনগণ।

লেখক: চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :