ওরা ষড়যন্ত্রের ফাঁদ নিয়ে ওত পেতে বসে থাকে

গোলাম যাকারিয়া
 | প্রকাশিত : ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:৩৮

বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে উপজাতি-বাঙালি দ্বৈরথ দীর্ঘকাল থেকেই চলমান। স্বাধীনতা উত্তর সময়ে এটা প্রকট আকার ধারণ করেছে। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতা নিয়ে তৎপর হয়েছেন। বিদ্রোহীদের সাথে কয়েক দফা বৈঠকও করেছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই জিয়ার সময়কালে তিনি এ ইস্যুতে বেশ কৌশলী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে অস্থিরতা ঠেকানো যায়নি কিছুতেই। বরং দিনে দিনে আরও বেড়েছে। ৮০ পরবর্তী সময়ে বিদ্রোহীদের দ্বারা পাহাড়ে বাঙালি নিধন মিশনের নামে বেশ কয়েকটি গণহত্যাও পরিচালিত হয়। এসব গণহত্যায় সেসময় পাহাড়ে প্রায় ৩০ হাজার বাঙালি খুন হয়। তবে রাগ-ক্ষোভ ছেড়ে ১৯৯৭ সালে এসে তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহত্তর স্বার্থে 'শান্তিচুক্তি' করে কোনোমতে পাহাড়ের সমস্যার ইতি টানেন।

তবে সেখানেই শেষ হয়ে যায়নি। দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহলের উসকানিতে সম্প্রতি পাহাড়ে অস্থিরতা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। সন্তু লারমাদের ছাপিয়ে যে নামটি এখন পাহাড়ে আতংক সৃষ্টি করে রেখেছে তার প্রধান নাম কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ। গত বছরের শেষার্ধে এসে কুকি-চীনের তৎপরতা দৃশ্যমান হয়েছিলো বাংলাদেশে। সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করেছিল তখন। তবে সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় তখন দাবি করেছিল যে তারা বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। তাদের দাবি, ‘সুবিধা বঞ্চিত কুকি-চীন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য’ চাইলেও তারা কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।

কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বম এর নাম গণমাধ্যমে এসেছিল। তিনি ২০১২ সালে কুকি চীন ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনস বা কেএনডিও নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন যা পরে কেএনএফ এ রূপান্তরিত হয়। বিভিন্নরকম সামাজিক কাজ, ঢাকা ভার্সিটির চারুকলার ছাত্র ও পাহাড়ি ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের সুবাদে নিজ সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে বিশেষ পরিচিতি ছিল। এই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে নির্বাচনও করে। কিন্তু নির্বাচনে হেরে যায়। তারপরই তার মতিভ্রম ঘটে। আস্তে আস্তে গড়ে তোলে কেএনএফ। পাহাড়ের বাসিন্দারা সুবিধা বঞ্চিত বলে রব তোলার চেষ্টা করে আদতে নিজের স্বার্থ হাসিলের অপচেষ্টা চালাচ্ছে সে। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমের খবরে চোখে পড়ে তার সংগঠনের লোকজনের চাঁদা দাবি, হুমকি এরকম নানা অত্যাচারে নিজগৃহ ত্যাগ করে অন্যত্র মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে তারই জনজাতির বেশ কয়েকটি পরিবার। এখানেই তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

সম্প্রতি আরও একটি খবরে নজর দিলে নাথানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়টি সুরাহা করতে সহজ হবে। বাড়ি ছেড়ে কথিত হিজরত করতে যাওয়া ৫৫ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করে র‌্যাব, যারা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সাথে জড়িত। এদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কেএনএফ। শুধু পাহাড় না পুরো দেশেই অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য তার বড় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে।

পাহাড়ে বাঙালি ও উপজাতিদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির স্বার্থে বিভিন্ন সময় নানা উসকানি দিচ্ছে কেএনএফ এবং সম-মতালম্বীরা। পাহাড়ি জনপদে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অথবা দেশের অভ্যন্তরে বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে কি না এ বিষয়টিও আমলে নেওয়া জরুরি।

গত ১১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের রাউজান থেকে অপহৃত শিবলি সাদিক আল সাদিক ওরফে হৃদয় নামে এক কলেজছাত্রের খণ্ড খণ্ড কংকাল ও কাপড়-চোপড় উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর আগে অপহরণের একটি মামলা দায়ের করেছিল ছেলেটির পরিবার। মামলার ১নং এজাহারীয় আসামি উমংচিং মারমা (২৬) নিয়ে ঘটনাস্থল রঙ্গি পাহাড়ে যায় পুলিশ। সেখানে দুর্গম পাহাড়ের চূড়ায় কলাগাছ দিয়ে ঢাকা অবস্থায় মাথার খুলি, পায়ের দুটি হাড়, হাতের একটি হাড়, মুখ ও হাত বাধার রশি উদ্ধার করা হয়েছে। তবে পুরো দেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধারকৃত আলমতসহ আসামিকে নিয়ে থানায় ফেরার পথে গাছের গুঁড়ি দিয়ে ব্যারিকেট তৈরি করে পুলিশের গাড়িতে হামলা চালায় উত্তেজিত জনতা। হাজারো উত্তেজিত জনতা লাটিসোটা দিয়ে পুলিশকে আঘাত করতে করতে সকাল ১০টা ৫১ মনিটের সময় পুলিশের গাড়ির দরজা ভেঙে আসামি উমংচিং মারমাকে বের করে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা হয়। উত্তেজিত জনতার হামলায় পুলিশের দুটি গাড়ি ভাংচুর করা হয়েছে এবং ওসিসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হোন।

সংবাদমাধ্যমের সূত্রমতে, গত ২৮ আগস্ট রাত ১০টায় রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নের হযরত আশরাফাশাহ (রা.) মাজার গেইটের পূর্ব পাশের পাহাড়ি জনপদে নিজ বাড়ির অদূরে ইলিয়াছ পোল্ট্রি ফার্ম থেকে ওই কলেজ ছাত্র নিখোঁজ হন। সে কলেজের শিক্ষার্থী হলেও ওই পোল্ট্রি ফার্মের ম্যানেজারের দায়িত্বে ছিল। সেখানে আরও কয়েকজন উপজাতি কাজ করতেন। তাদের মধ্যে মনোমানিল্য হওয়ায় অপহরণ করতে পারে বলে ধারণা।

এখানে দুটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। এক. একজন কলেজছাত্রকে অপহরণপূর্বক হত্যা করে তার লাশ ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছে। দুই. প্রধান আসামিকে পুলিশের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

মানবিক আবেদনের জায়গায় ১ম ঘটনাটি তুলনামূলক বেশি হৃদয়গ্রাহী ও কষ্টদায়ক। তবে ২য় ঘটনাটিও বিচারবহির্ভূত। অপরাধ মেনে নেওয়ার পরও একজন মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকারের বিষয়টি অস্বীকার করা যায় না। তাই দুটি ঘটনাকেই দুঃখজনক বলা যেতে পারে।

স্বার্থান্বেষী মহলের অপতৎপরতা এমন বেদনাব্যঞ্জক ঘটনার পরও থেমে নেই। এখানেও তারা বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। এই ঘটনার দুটি পক্ষ- পাহাড়ি বাঙালি ও উপজাতি। প্রথম ঘটনার ভুক্তভোগী বাঙালি এবং ঘটনার ভিলেন উপজাতি কোনো গোষ্ঠীর। এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের আসল কারণ আমাদের অজানা। তবে ধারণা, একই জায়গায় কাজ করার সুবাদে 'মনমালিন্য'। এরকম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দেশে একটি-দুটি নয়। প্রায় নিয়মিত কোনো না কোনো সংবাদপত্রে এরকম খবরে আমাদের চোখ আটকে যায়। আমাদের প্রতিনিয়তই হতাশ করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঙালি বনাম বাঙালি ঘটছে। তাই এত আলোচনা নেই। এই ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ছন্দ ঘুরে বেড়াচ্ছে- ‘হাড্ডি কখনও দোস্ত হয় না, উপজাতি কখনও দোস্ত হয় না।’

অর্থাৎ ঘটনার একটা 'সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল' চলছে। মূল বিষয় থেকে সরে ভিন্ন পথে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জাতিগত বিভেদ চাঙা করা হচ্ছে। দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির এক গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ এখানে পাওয়া যায়। এই অপকর্মের সঙ্গে লিপ্ত কিছু লোক সবসময় ওত পেতে থাকে, সুযোগ বুঝেই মানুষের আবেগের জায়গায় আঘাত করে নিজেদের উদ্দেশ্য আদায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সাধারণ নাগরিকদের এদের পেতে দেওয়া ফাঁদ থেকে দূরে থাকতে হবে এবং প্রশাসনকেও বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে এমন ঘটনা রহিতকরণে সজাগ ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক অধিকার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :