প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার কবজায় নিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুত্রের বহুমুখী পাঁয়তারা!

বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৬:১৬| আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:০৯
অ- অ+

রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এবার চোখ পড়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুত্র রাহাত মালেক শুভ্রের। সুপ্রতিষ্ঠিত এই ডায়াগনস্টিক সেন্টার দখলে নিতে মন্ত্রীপুত্রের বহুমুখী তৎপরতা সত্যিই বিস্ময়কর। মন্ত্রীপুত্রের ইচ্ছা মেটাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একের পর এক পদক্ষেপও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।

গুলশান-বনানী এলাকায় শতাধিক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থাকলেও কেবল প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট পরিদর্শন করে তিন ধরনের অসঙ্গতি দেখিয়ে একই দিনে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ও লাইসেন্স স্থগিত করার অফিস আদেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, যা সম্পূর্ণ একতরফা, ফরমায়েশি ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

একাধিক সূত্রে ঢাকা টাইমসের কাছে তথ্য আছে, খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ছেলে রাহাত মালেক প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে চলতি বছরের শুরুর দিকে জানান, যে স্থানে ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি ভাড়ায় স্থাপিত সেটি তিনি কিনে নিতে বায়না করেছেন। তাই জায়গাটি ছেড়ে দেওয়া উত্তম হবে। আর সেটি না হলে তাকে (রাহাত মালেক) যেন উপর্যুক্ত শেয়ার দিয়ে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট লিমিটেডের মালিকানায় যুক্ত করা হয়।

সূত্রে জানা যায়, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করে জানান যে, বনানীর এই স্থানে ভাড়াসহ কয়েকটি বিষয়ে আদালতে মোকদ্দমা চলছে। এমতাবস্থায় মন্ত্রীপুত্রের ত্রুটিযুক্ত জমি কেনার সঙ্গে জড়িত না হওয়াই শ্রেয়। কিন্তু এই পরামর্শই সম্ভবত কাল হয় প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট মালিক কর্তৃপক্ষের জন্য।

সূত্রগুলো ঢাকা টাইমসকে জানায়, গত ১৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি পরিদর্শন দল বনানীর প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক পরিদর্শন করে। নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন অমান্য; অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের মাধ্যমে জনগণের হয়রানি; মেয়াদ উত্তীর্ণ রি-এজেন্ট এবং অদক্ষ জনবলের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করা এই তিনটি কারণ দেখিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ ও লাইসেন্স স্থগিত করার আদেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই আদেশের বিরুদ্ধে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট কর্তৃপক্ষ আপিল করলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়।

সূত্রে জানা যায়, এরপর প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক কর্তৃপক্ষ নিয়মানুযায়ী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আপিল করলে তারা অদ্যাবধি রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে।

বিস্ময়কর হচ্ছে, বনানীর ১২ নম্বর রোডে একাধিক বাণিজ্যিক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থাকলেও শুধু প্রেসক্রিপশন সেন্টার লিমিটেডের কার্যক্রম বন্ধ করতে একে একে তৎপর হয় রাজউক, ডেসকোও। গত ২৭ আগস্ট ডেসকোর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শাহ সুলতান এক চিঠি দিয়ে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট কর্তৃপক্ষকে আবাসিক ভবনে বিধিবহির্ভূতভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রমে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার নির্দেশ দেয়। অথচ ডেসকো প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে গত ১৬ বছর ধরে বাণিজ্যিকভাবে বিল আদায় করে আসছে।

এর আগে গত ১৯ জুন রাজউকের পক্ষ থেকেও প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট কর্তৃপক্ষকে বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধের চিঠি দেওয়া হয়। ঢাকা টাইমস রাজউক ও ডেসকোতে গত কয়েক দিন টানা খোঁজ নিয়েছে। বনানীর ১২ নম্বর রোডে শতাধিক বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যাদের আর কেউই এ ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নোটিশ পায়নি।

প্রশ্ন উঠেছে, যদি রাজউক, ডেসকো ইতিবাচক উদ্দেশ্যেই আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করতে চাইবে তাহলে বেছে বেছে শুধু প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারকেই লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা কেন?

তথ্যানুসন্ধানে ঢাকা টাইমস জানতে পেরেছে, ভাড়া বাড়িতে পরিচালিত প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি এ বছরের ১৮ জানুয়ারি ৬ কোটি টাকা দলিলমূল্যে কিনে নেন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের পক্ষে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ইমরান মুস্তাফিজ। যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। রেন্টাল কোর্টের মাধ্যমে ১৭ হাজার ৪৫৯ বর্গফুট বাড়ির ভাড়াও নিচ্ছেন ইমরান মুস্তাফিজ।

ঢাকা টাইমসের কাছে এ সংক্রান্ত সকল দলিল-দস্তাবেজ এবং আনুষঙ্গিক সকল কাগজপত্র সংরক্ষিত আছে। তবে এই প্রশ্নও আসছে, বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় মাত্র ৬ কোটি টাকা দিয়ে এই সেন্টারটি কিভাবে কিনে নেওয়া হলো, যেখানে প্রতি বর্গফুট স্পেসের মূল্য ১৮ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ সেখানে কর ফাঁকির ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইমরান মুস্তাফিজের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে ঢাকা টাইমস। তিনি দেশের বাইরে থাকায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো মানুষকে প্রতিদিন স্বাস্থ্যসেবা দেয় প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট। যাত্রা শুরুর পর প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে গত ১৬ বছরেও কোনো অভিযোগ ওঠেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যেমন নিয়মের ব্যত্যয় পায়নি তেমনি কোনো অনিয়ম-অসঙ্গতি দেখেনি রাজউক, ডেসকো। আবাসিক এলাকা হলেও ট্রেড লাইসেন্স পেতেও এতকাল কোনো অসুবিধা হয়নি।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী পুত্র রাহাত মালেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহ দেখানোর পরই শুরু হয়েছে একের পর এক সরকারি দপ্তরের অতি-তৎপরতা। বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা পাইয়ে দিতে এভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, রাজউক, ডেসকোর এই তৎপরতাকে কি বলে আখ্যা দেওয়া যায়?

আরও পড়ুন>> ভূমি অধিগ্রহণে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ভূমিমন্ত্রীকে আহ্বান

একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপর্যুপরি তৎপরতার মূল উদ্দেশ্য কি? বিশেষ ব্যক্তির উদ্দেশ্য সাধনের জন্য খোদ সরকারের একাধিক প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা আসলে কিসের লক্ষণ?

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নিয়মের, আইনের ব্যত্যয় ঘটলে নিশ্চয়ই জনকল্যাণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। কিন্তু একই এলাকায় আর কোনো প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন না করে একটি প্রতিষ্ঠিত ও স্বনামধন্য ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যখন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রাতারাতি ফরমায়েশি অসঙ্গতি খুঁজে পায় তখনই হাজারো প্রশ্ন ওঠে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. আহমেদুল কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

সূত্রে ঢাকা টাইমস জানতে পেরেছে, গত ১০ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এক চিঠিতে আগামী ৭ দিনের মধ্যে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট বন্ধ করার লক্ষ্যে সকল মালামাল সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক ডা. আহমেদুল কবির ঢাকা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট ইরতিজা হাসানসহ বিপুলসংখ্যক পুলিশ নিয়ে এদিন হাজির হন প্রেসক্রিপশন পয়েন্টে। যার ছবির ফুটেজ ঢাকা টাইমসের হাতে আছে। কোন কর্তৃত্ববলে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ নিয়ে এভাবে মালামাল সরানোর চাপ? এমন পাল্টা প্রশ্নে তারা তড়িঘড়ি করে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ত্যাগ করে।

সরকারের স্পর্শকাতর দুটি সংস্থার কর্তৃপক্ষ তথা জনপ্রশাসন ও পুলিশ চাইলেই কি আইনি পথের বাইরে গিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে? বিপুলসংখ্যক পুলিশ কিভাবে গেল? কে রিকুইজিশন দিলো? কোথায় সেই রিকুইজিশনের কাগজপত্র? যে ম্যাজিস্ট্রেট গেলেন তিনি যদি ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট হন, তাহলে তার যথাযথ অনুমতিপত্রই বা কোথায়? ঢাকা টাইমস অনুসন্ধান করে দেখেছে, এর কিছুই এক্ষেত্রে অনুসরণ করা হয়নি।

জানতে চাইলে প্রেসক্রিপশন পয়েন্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারের চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন ঢাকা টাইমসকে বলেন, পরিদর্শন করে কোনো কারণ না দর্শিয়ে রাতারাতি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার আদেশ আসলে উদ্দেশ্যমূলক ও বৈষম্যমূলক।

তিনি বলেন, ‘নিয়মের ব্যত্যয় দেখিয়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কার্যক্রম বন্ধ করার সঙ্গে মালামাল সরিয়ে নেওয়ার আদেশের মধ্যেই বোঝা যায় কারো স্বার্থেই এসব করা হচ্ছে।’ একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব কর্মকাণ্ড বন্ধের অনুরোধ করেন তিনি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ছেলে রাহাত মালেকের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি তিনি।

(ঢাকাটাইমস/১৬সেপ্টেম্বর/এআরডি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
দায়িত্ব নিয়েই হেভিওয়েট আ.লীগ নেত্রী গ্রেপ্তার, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজির প্রশংসায় জুলকারনাইন সায়ের
ফের একাধিক প্রদেশে ড্রোন হামলা চালিয়েছে পাকিস্তান, বিস্ফোরণ-গোলাগুলি
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের বাড়িতে আ.লীগ নেতার হামলা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে আতঙ্ক
পুশ ইন ঠেকাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার বিজিবির
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা