আলঝেইমার রোগের ঝুঁকি কমায় ঘুম ও কম খাওয়া
আলঝেইমার শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নই। ১৯০৬ সালে জার্মান মনোচিকিৎসক অ্যালয়েস আলঝেইমার প্রথম এ রোগটির বর্ণনা দেন। আর সে কারণে তার নাম অনুসারে এ রোগটির নাম রাখা হয় আলঝেইমার। সাধারণত ৬৫ বছর বয়সের বেশি লোকেরা এই রোগে আক্রান্ত হন। যদিও আলঝেইমারের সূত্রপাত অনেক আগেও হতে পারে। স্মৃতিভ্রংশ বা ভুলে যাওয়া রোগের নামই হলো- আলঝেইমার।
সহজ করে বলতে গেলে এক ধরনের ডিমেনশিয়া হচ্ছে এই আলঝেইমারস রোগ। এটি মস্তিষ্কের এক ধরনের রোগ, যার ফলে রোগী কিছু মনে রাখতে পারেন না। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই আলঝেইমারস রোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি অনেক কিছু ভুলে যায়। এটি একটি নিউরোডিজেনেরেটিভ রোগ যা ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং পরে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কেসেই এটা ডিমেনশিয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আলঝেইমার রোগের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া উচিত। লক্ষণ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের শরণাপন্ন নেওয়া জরুরি। অনেকেই বাড়ির ঠিকানা ভুলে যান, ফলে ঐ ব্যক্তি হারিয়ে যান। অনেক বৃদ্ধকে অভিযোগ করতে শোনা যায়, ‘তাকে খেতে দেওয়া হয়নি’—আসলে তিনি খাবার বিষয়টির মতো আরো অনেক বিষয় ভুলে যান। এই ভুলে যাওয়া বা স্মৃতিভ্রষ্ট রোগটিকে বলে ডিমেনশিয়া। আর ডিমেনশিয়াই আলঝেইমারের কারণ।
চিকিৎসকের মতে, আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধব প্রায়ই আলঝেইমার রোগকে উপেক্ষা করেন এবং ভুলক্রমে এটাকে বার্ধক্যজনিত অথবা বয়োবৃদ্ধির একটি স্বাভাবিক অংশ হিসেবে উল্লেখ করতে চান। ডিমেনশিয়া আক্রান্তরা পাগল বা মানসিক রোগী নয়। ডিমেনশিয়া বয়োবৃদ্ধির স্বাভাবিক কোনো অংশ নয়, ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের অসুখ।
আলঝেইমার রোগের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ এখনও অজানা। তবে ধারণা করা হয়, আক্রান্ত ব্যক্তিদের এক ধরনের প্রোটিনের উৎপন্নের কারণে মস্তিষ্কের কোষ বা সেলের মৃত্যু হয় যার ফলে এই রোগ দেখা দেয়। পারিবারিক ইতিহাস অর্থাৎ অনেক সময় পরিবারের কেউ যদি এই রোগ হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে আলঝেইমার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। জেনেটিক কারণেও আলঝেইমার হয় অর্থাৎ কিছু জিন আলঝেইমার রোগের সাথে যুক্ত রয়েছে। পূর্বে মস্তিষ্কে কোন আঘাত পেয়ে থাকলে এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এ ছাড়া বিষণ্ণতা, ধূমপান, হৃদরোগের কারণেও অনেকে আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত হন।
আলঝেইমার রোগের লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। আলঝেইমারের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে ভুলে যাওয়া। স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া। যেকোন সমস্যা সমাধানে অসুবিধা হওয়া বা সহজ সমস্যা সমাধান করতে না পারা। সময় বা স্থান সম্পর্কে দিশেহারা হয়ে পড়া। আক্রান্ত রোগীর দিন দিন স্বাস্থ্য কমে যাওয়া, এ ছাড়া মেজাজ এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন। বন্ধু, পরিবার এবং প্রতিবেশিদের কাছে থেকে দূরে দূরে থাকা, একা থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করা।
সম্প্রতি, একটি জার্নালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে গবেষকরা বলছেন, নিয়মতান্ত্রিক নিরবচ্ছিন্ন আট ঘণ্টা ঘুম বৃদ্ধ বয়সে আলঝেইমার এড়াতে সহায়ক হতে পারে। বিশেষত, তরুণ এবং মধ্যবয়সীদের ক্ষেত্রে ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, ঘুম স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি এবং নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
গবেষকদের মতে, শিশুকাল অথবা তরুণ বয়স থেকেই নিয়মতান্ত্রিক ঘুম বৃদ্ধ বয়সে স্মৃতি শক্তি লোপ পাওয়া থেকে রক্ষা করতে পারে। মধ্য বয়স থেকে নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন করলে এর ফল পাওয়া যাবে ২৮ বছর পরে। কেবল স্মৃতিশক্তিই নয়, সুস্বাস্থ্যের জন্যও ঘুম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজন এমনকী ডায়াবেটিসের (টাইপ-২) কারণেও স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে পারে। বিশেষত ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সে নিয়মতান্ত্রিক ঘুম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একইসঙ্গে বিকেলের ঘুমও গুরুত্বপূর্ণ। প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে কোনো ব্যক্তির বয়স ৮৫ বছর হলে তিনি ১০,০০০ দিনের বেশি সময়ে ২৫০,০০০ ঘণ্টা ঘুমাবেন।
এছাড়া আলঝেইমার রোগ থেকে মুক্তি পেতে খাওয়াদাওয়া কমাতে হবে। অর্থাৎ অল্প করে খাবার খেতে হবে। খাবার খাওয়ার ব্যাপারে একটি বিশেষ নিয়ম মেনে চলতে হবে। তাহলেই বয়সকালে ভুলে যাওয়া রোগের আশঙ্কা কমবে। এই বিশেষ নিয়ম বা ডায়েটের নাম ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। দীর্ঘ সময় উপোস থেকে মাঝে মাঝে খাবার খাওয়ার নাম ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। এই ফাস্টিং করতে গেলে দিনে সব মিলিয়ে তিন থেকে চার বার খাওয়া যাবে। ৫-৬ ঘণ্টা অন্তর খাবার খাওয়া যাবে। এই সময়ের মধ্যে মুখে কিছু তোলা যাবে না। এভাবে উপোস করে ডায়েট করতে পারলেই ডিমেনশিয়ার আশঙ্কা কমবে। তবে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
আলঝেইমার রোগের জন্য কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা ওষুধ নেই। উপসর্গের উপর নির্ভর করে এই চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। ঔষধ ছাড়াও জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে আলঝেইমারের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেয়া। শান্ত পরিবেশে থাকা ও পর্যাপ্ত ব্যায়াম করা। সুষম, পুষ্টিকর খাদ্যাভাস বজায় রাখা। যেমন পূর্ণ শস্যযুক্ত খাবার, শাকসবজি, সামুদ্রিক মাছ, শিম ও শিমের বিচি, সালাদ, বাদাম, অলিভ অয়েল, চিজ, পনির, দুগ্ধজাত খাবার আলঝেইমারের ঝুঁকি কমায়। এছাড়া মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি খেয়াল রাখা। অতিরিক্ত স্ট্রেস বা বিষণ্ণতা দূর করা। পরিবার, মানুষ, প্রতিবেশি সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।