প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্যের নাম কাশ্মীর, যুদ্ধের কারণ এই রূপসী কাশ্মীর!

ফিচার ডেস্ক, ঢাকাটাইমস
  প্রকাশিত : ০৮ মে ২০২৫, ১০:৫৩| আপডেট : ০৮ মে ২০২৫, ১১:৩৮
অ- অ+

পৃথিবীর ভূ-স্বর্গ কাশ্মীর। বরফ ঢাকা পাহাড়, কলকলিয়ে বয়ে চলা ঝরনা, শাল গাছের সারি আর লেকের শান্ত জলে প্রতিফলিত সূর্যাস্তের ছবি যেন স্বর্গের মতো। পৃথিবীর সব রূপ-সৌন্দর্য যেন ভিড় করেছে এখানে। ছুটে এসেছে প্রকৃতির রূপের সব অনুষঙ্গ। প্রকৃতির প্রতিটি বিচিত্র স্বাদের অলঙ্কার দিয়ে সাজানো এ ভূস্বর্গ। একটা সময় কাশ্মীর শব্দটি ভৌগোলিকভাবে শুধু বিশাল হিমালয় এবং পিরপাঞ্জাল পর্বতমালার উপত্যকাকে নির্দেশনা করা হতো। আজ কাশ্মীর বলতে বোঝায় একটি বিশাল অঞ্চল যা ভারতীয়-শাসিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর, পাকিস্তানশাসিত গিলগিট-বালতিস্তান এবং আজাদ কাশ্মীর প্রদেশ এবং চীন-শাসিত আকসাই চীন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম ট্রাক্ট অঞ্চলসমূহ নিয়ে গঠিত। তাই বলা চলে কাশ্মীরের দুটি অংশ। একটি ভারতশাসিত জম্মু কাশ্মীর এবং অন্যটি পাকিস্তান অধিভুক্ত আজাদ কাশ্মীর।

পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরবর্তীতে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর অর্জনসমূহ হারিয়ে যায় নি, বরং নবাগত ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মিরি সুফিবাদের। ১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ সাল থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৭৪৭ সাল থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ—শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের নিকট শিখরা পরাজিত হয়। এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে ক্রয় করেন।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পর, কাশ্মীর সংকটের সূচনা ঘটে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান—দুই স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু জম্মু ও কাশ্মীর নামের এই সুপ্রাচীন রাজ্যের ভাগ্য রয়ে যায় ঝুলে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু রাজা হরি সিং স্বাধীনতার পথ খুঁজছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান-সমর্থিত উপজাতীয়দের হামলার মুখে তিনি ভারতের কাছে সহায়তা চান এবং একটি অধিগ্রহণ চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

ভারতের সেনারা কাশ্মীরে প্রবেশ করে এবং উপত্যকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশের দখল নেয়। অপরদিকে, আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চল থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করে তার উপস্থিতি। এর ঠিক কয়েক বছর পর পূর্ব অংশ আকসাই চীনের দখল নেয় চীন। সেই থেকে তিন দেশের দাবির কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায় ভূখণ্ড কাশ্মীর।

জম্মু-কাশ্মীর ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পাহাড়ি জনপদ। যার আয়তন ২,২২,২৩৬ বর্গ কি.মি. এবং জনসংখ্যা ১,০১,৪৩,০০০ জন প্রায়। শতকরা ৭৭ ভাগ লোক শিক্ষিত।

কাশ্মীরি, ডুগরি ও লাদাখি এদের প্রধান ভাষা। জাফরান, গম, আপেল, ধান ও বার্লি কৃষিজ ফসল। কার্পেট, শাল ও ওলেন কাপড়ের জন্য স্থানটি বিখ্যাত।

জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর। শ্রীনগরে শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস ০ ডিগ্রির নিচে নেমে আসে। কাশ্মীরে ডাল লেক, চরচিনার, শংকর চূড়া, ভিসনোদেবী মন্দির, লাদাখ, হযরত বাল মসজিদ, শালিমারবাগ, লেহ, শোনমার্গ, গুলমার্গ, পহেলাগাঁও, নিশাতবাগ, চশমাশাহী, নাগীনলেক, লালচক, অমরনাথ মন্দির, জিলাম নদী প্রভৃতি পর্যটক আকৃষ্ট স্থান। কাশ্মীর বেড়ানোর উপযুক্ত সময় ডিসেম্বর-জানুয়ারি, এপ্রিল-জুলাই এবং সেপ্টেম্বর- অক্টোবর।

কাশ্মীরে পর্যটকদের চোখ জুড়ায় শ্রীনগর, পহেলগাঁও, গুলমার্গ, সোনমার্গ ও কাটরা। তারপরই বলা যায় ডালহৌসি, অমৃতসর, মানালী, কুলু, হিমাচল ও পাঞ্জাব। বানিহাল টানেল কাশ্মীরের সঙ্গে আশ্চর্য যোগসেতু রয়েছে। প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার এই টানেল। টানেলের আগে রয়েছে বেশ কিছু অ্যাভালেঞ্চ জোন। এখান থেকে পাড়ি দিলেই আশ্চর্য এক সবুজে ঢাকা কাশ্মীরের দেখা মিলবে। বনগুলো সেজে আছে পপলার, উইলো গাছ আর সবুজ শস্যক্ষেত। সবুজ গাছের ফাঁকে নীল আকাশ। দূরে রুক্ষ পাহাড়, নিশ্চুপ উপত্যাকা। আর মাইলের পর মাইল পাহাড় টপকেই কাশ্মীর।

রোমান্টিক স্বপ্নের ভূস্বর্গ। স্বপ্নরাজ্য। কাশ্মীরের রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। স্বচ্ছজলের নদী, উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়, বনভূমি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মানুষজন সব মিলিয়ে অনন্য সংযোজন এখানে। রয়েছে পিরপাঞ্জাল গিরিশৃঙ্গ তার অন্যদিকেই কারাকোরাম নাঙ্গা পর্যন্ত। আর তার আড়ালে কাশ্মীর। গোলাপি, সাদা রঙের সরষে আর পপি ফুলে সারা গ্রীষ্ম ঝলমল প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা নিশাত, শালিমার, হারওয়ান, মুঘল গার্ডেন এবং চশমাশাহি দেখতে ভিড় করেন কাশ্মীরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তুষারপাতের কারণে পর্যটকদের কাছে আলাদা কদর আছে কাশ্মীরের।

কাশ্মীরের পহেলগাম উপত্যকার সৌন্দর্য সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্যকে হার মানায়৷ শ্রীনগর শহর থেকে প্রায় ৯৬ কি. মি. দূরে এবং সমতল ভূমি থেকে ২১৯৬ মিটার উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় পহেলগাঁও বা পহেল গ্রাম অবিস্থত। শ্রীনগর থেকে পহেলগাঁও যাওয়ার পথের প্রাকৃতিক দ‍ৃশ্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। বিশাল বিশাল পাইনগাছ, চিনারগাছ, বরফে ঢাকা জাফরান খেত, ফসলের জমি আর রাস্তা ঘাট বরফের চাদরে মোড়া। দূরের পাহাড়গুলো ধবধবে সাদা। পাহাড়ি ঝর্না ধারা পাথর বেয়ে বেয়ে ঐতিহাসিক জিলাম নদীতে আছড়ে পড়ে। কখনও বা পাহাড়। কখনও বা নদী। কখনও বা বড় বড় পাথর। পাহাড়ি বন। বৃক্ষ রাজিতে ঝুলে থাকা বরফ। আঁকা আঁকা পাহাড়ি পথ। কখনও বা গাড়ি পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা। আবার সমতল ভূমিতে দূরের পথ পাড়ি দেওয়া। যেতে যেতে একটু পরেই দেখা মিলবে একটি গ্রাম-নাম তার পহেলগাঁও। এই অপরূপ উপত্যকাই আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকৃত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। হাজারো সৈন্যের ছায়া, আধা সামরিক বাহিনীর টহল আর কাঁটাতারে ঘেরা জনপদই এখন কাশ্মীরের বাস্তব চিত্র। পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের কারণে এসব এলাকা এখন অনিরাপদ।

১৯৪৭ সালের পর আরও দুটি বড় যুদ্ধ হয়েছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। ১৯৬৫ সালে কাশ্মীর সীমান্তকে কেন্দ্র করে ঘটে ভয়াবহ সংঘর্ষ। অনেক প্রাণহানির পর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় কাশ্মীর পরিস্থিতিও উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তিতে নিয়ন্ত্রণরেখা নির্ধারিত হলেও উত্তেজনার অবসান হয়নি। ১৯৯৯ সালে কারগিল সীমান্তে আবারও রক্তপাত হয়। শুধু পাকিস্তান নয়, চীনের সাথেও কাশ্মীর সীমান্তে একাধিকবার বিবাদে জড়িয়েছে ভারত। ফলে ভূ-রাজনৈতিকভাবে প্রকৃতির স্বপ্নরাজ্য কাশ্মীর হয়ে ওঠে এক অগ্নিগর্ভ অঞ্চল, যা আজও জ্বলছে।

(ঢাকাটাইমস/৮ মে/আরজেড)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
বিশ্ব গাধা দিবস যেভাবে এলো
মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা অ্যাম্বুলেন্সে বাসের ধাক্কা, নিহত ৪
টঙ্গীতে গলায় ফাঁস নিয়ে যুবকের আত্মহত্যা 
নৌপথে আইনশৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ, চোরাচালান দমনে কাজ করছে কোস্ট গার্ড
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা