যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরে বাংলাদেশ
*আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে: ব্রায়ান শিলার
* যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর, কিন্তু কিছু গোষ্ঠী তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা করছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতিতে বাড়ছে উত্তাপ। এর মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন বাধাগ্রস্তকারী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নীতি আরোপ করা হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় চলছে সব মহলে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে কড়া নজরে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র।
আর বাংলাদেশে নজরদারি বাড়ানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বক্তব্যে। আভাস মিলেছে আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা আসার।
তিনি একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাদানকারী বা জড়িত থাকা ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরদারিতে রয়েছে বাংলাদেশ। পরিস্থিতি অনুযায়ী ভবিষ্যতে আরও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।
ব্রায়ান শিলার বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আরও ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে বিবেচনা করছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যদি প্রয়োজন হয় তবে আরেক দফা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
পরবর্তীতে কারা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসতে পারেন- সে বিষয়ে তিনি বলেন, যাকেই দেখা যাবে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করছেন, তার বিরুদ্ধেই এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার কর্মকাণ্ডের মধ্যে যা আছে (ভোট জালিয়াতি, ভোটারদের ভীতিপ্রদর্শন, সমাবেশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার চর্চায় যারা সহিংসতা ব্যবহার করে বাধা দেয়)। এছাড়া রাজনৈতিক দল, ভোটার এবং নাগরিক সমাজকে বাধা দেওয়ার পদক্ষেপ, মিডিয়াকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নেওয়া এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশে বাধা দেওয়া হলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়। যারা ভিসা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আসবেন তাদের নাম ও ফোন নম্বর আমরা প্রকাশ করবো না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উল্লেখ করেছে তারা কার কার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেবে। এর আওতায় রয়েছে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো, ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা, বিচার বিভাগ, বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা।
এদিকে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সোমবার নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, যুক্তরাষ্ট্র শাখা আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর। কিন্তু কিছু গোষ্ঠী তিক্ততা সৃষ্টির চেষ্টা করছে এবং বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যাচার করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। আমরা যে নীতি ও মূল্যবোধে বিশ্বাস করি, যুক্তরাষ্ট্র সেই নীতি ও মূল্যবোধে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশ হচ্ছে সেই দেশ যেখানে গণতন্ত্রের জন্য আমরা লড়াই সংগ্রাম করেছি। আমরা জনগণের ভোটে জয়লাভ করলেও ১৯৭০ সালে আমাদের সরকার গঠন করতে দেওয়া হয়নি। বরং আমাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছিল আর তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। এজন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ৩০ লাখ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য এতো অল্প সময়ে এতো মানুষ আত্মত্যাগ করেনি। আমরা পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র জাতি যারা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য এতো বড় ত্যাগ স্বীকার করেছি।
ড. মোমেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রে ও মানবাধিকারে বিশ্বাস করে। তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের মতের, চিন্তার মিল আছে। নীতিগতভাবে আমাদের দুই দেশের মধ্যে মিল রয়েছে। তবে তাদের কোনও কোনও ব্যক্তি বিশেষ হয়তো আমাদের উন্নয়ন পছন্দ করছেন না, তাদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। কেউ বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যাচার করলে তাদের মিথ্যাচারকে চ্যালেঞ্জ করতে দলমত নির্বিশেষে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট সংশোধনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে যেসব ভালো পরামর্শ দেয় আমরা সেটা গ্রহণ করি। যুক্তরাষ্ট্র অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যাশা করে আর আমরাও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশের কিছু লোক আছে যারা নির্বাচন বয়কট করতে চায়, নির্বাচন ভয় পায়। নির্বাচন বানচাল করতে তারা সবরকমের চেষ্টা করে থাকেন বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ড. মোমেন বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে আমরা ২৬তম বড় অর্থনীতিতে পরিণত হবো। আমাদের রয়েছে ১৭ কোটি মানুষ, তাই আমাদের নিজস্ব বাজারও অনেক বড়। সেজন্য আমাদের দেশের প্রতি অনেকেরই আগ্রহ বেড়েছে, কারণ আমাদের মাথাপিছু আয় ৫ গুণ বেড়েছে। দারিদ্রের হার অর্ধেকের বেশি কমেছে। এসবই শেখ হাসিনার সরকারের লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ বাস্তবায়নের কারণে সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, আমরা বিজয়ীর জাতি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের একটি সুন্দর পররাষ্ট্রনীতি দিয়ে গেছেন। আর এই নীতি হচ্ছে ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।’ আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি। আমরা একটা ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করি।
বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্র শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের মিয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সভাপতি ড. মসিউর মালেক। অন্যান্যের মধ্যে কবি ও সাহিত্যিক ফকির ইলিয়াস, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি আব্দুল খালেক মিয়া, বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার নিউইয়র্ক প্রতিনিধি লাভলু আনসার, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতৃবৃন্দ এবং নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কমিউনিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
(ঢাকাটাইমস/২৭সেপ্টেম্বর/আরকেএইচ/কেএম)