তিন দিনের ছুটিতে কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকের ঢল
ঈদে মিলাদুন্নবী ও সাপ্তাহিক দুই দিন মিলে টানা তিন দিনের ছুটিতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে এসেছেন কয়েক লাখ পর্যটক। শহরের হোটেল-মোটেল, গেস্ট হাউস ও রিসোর্টে শনিবার পর্যন্ত কোনো কক্ষ খালি নেই। শহরের পর্যটন জোনের লাবণী থেকে কলাতলী পয়েন্টের তিন কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত এলাকা রীতিমতো জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। পর্যটকদের এই ঢল শনিবার পর্যন্ত থাকবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে চলমান ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বীচ কার্নিভালে আরো কিছু পর্যটক থাকবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে পর্যটন দিবস ও বীচ কার্নিভাল উপলক্ষে আয়োজক জেলা প্রশাসন ও হোটেল মালিকদের পক্ষ থেকে যে ছাড়ের কথা বলা হয়েছিল তা কিছুইতে বাস্তবায়ন নেই বলে অভিযোগ করছেন আগত পর্যটকরা।
জানা গেছে, গত বুধবার (২৭ সেপ্টেম্বর) ছিল বিশ্ব পর্যটন দিবস। দিবসটি সামনে রেখে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সৈকতের লাবণি পয়েন্টে সপ্তাহব্যাপী পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভ্যালের আয়োজন করেছে। পর্যটন মৌসুমের শুরুতে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে মেলা চলাকালীন থাকা-খাওয়া, যাতায়াত ও বিনোদনসহ অন্তত ১৫টি খাতে সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও হোটেল মালিক সমিতি। তবে অধিকাংশ হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউসে এই তিন দিন কোনো ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। উল্টো পর্যটকেরা অভিযোগ করেছেন, তাঁদের কাছ থকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে শহরের তারকামানের হোটেলগুলো ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়েছে বলে জানা গেছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন দিনে অন্তত ৫ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে আসবেন। সী-হলিডে ট্যুরস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসির উদ্দিন বলেন, এখনো কক্সবাজারে পর্যটক আসার সময় মূলত হয়নি। তবে অক্টোবরের মাঝখান থেকে শীতের আবহে পর্যটকরা আসবেন। এখন টানা তিনদিন ছুটি হওয়ায় প্রচুর পর্যটক আসছে। তারা ছুটি ও মেলার আয়োজন থাকায় বাড়তি আনন্দ পাচ্ছেন পর্যটকেরা। আর তারকা শিল্পীদের গানও উপভোগ করতে পারছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শুক্রবার সমুদ্র সৈকতের তিন কিলোমিটার এলাকায় সাজ সাজ রব। লাবণী পয়েন্ট সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। এখানে সৈকতে যাওয়ার ফটকে মেলা ও বিচ কার্নিভাল উপলক্ষে তৈরি করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। মঞ্চের সামনে সড়কের দু-পাশে সারি সারি স্টল। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত মেলায় ঘোরাঘুরি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ রয়েছে।এ ছাড়া পর্যটকেরা কক্সবাজার শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক ধরে যাচ্ছেন দরিয়া নগর, হিমছড়ি, ইনানী, পাটুয়ারটেক, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিনের দিকে। কেউ কেউ ছুটছেন মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির, রামুর বৌদ্ধপল্লি, ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ও নিভৃতে নিসর্গসহ বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে। এছাড়া পরীক্ষামূলক টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে এমভি বারো আউলিয়া নামে একটি জাহাজ চলাচল করছে। তাতেই প্রতিদিন ৬০০/৭০০ করে পর্যটক আসা যাওয়া করছে।
শহরের লাবনী, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে বৃহস্পতিবার থেকে শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত অন্তত ১ লাখ পর্যটক নেমেছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসনের বিচ পুলিশের ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, কোথাও ঠাঁই নেই। পর্যটকেরা নীল জলরাশিতে গোসলে নেমে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছেন। আমরাও সবসময় নিরাপত্তায় নিয়োজিত আছি। শুক্রবার হালকা বৃষ্টি হওয়ায় পর্যটকরা হোটেলে সময় কাটাচ্ছে।
দুপুর ৩ টার দিকে সৈকতের সুগন্ধ্যা পয়েন্টে গিয়ে দেখা যায়, কেউ টায়ার টিউব নিয়ে সমুদ্রে গা ভাসাচ্ছেন, কেউ আবার ওয়াটার বাইকে দূর সাগর দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার অনেকে ঘোড়া ও বিচ বাইকে চড়ে সমুদ্র সৈকত উপভোগ করছেন। পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় লাইফ গার্ড, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও বিচ কর্মীদের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে।
ঢাকার উত্তরা থেকে স্ব-পরিবারে এসেছেন ফারুক। তিনি শহরের সুগন্ধা মোড়ের একটি হোটেলে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘গণমাধ্যমে দেখেছি, মেলা উপলক্ষে বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়েছে। অথচ গত বছর যে হোটেল ২ হাজার টাকা নিয়েছে, এ বছর একই মানের হোটেল রুম ৩ হাজার টাকা নিয়েছে।’ এটা তো পর্যটকদের সাথে এক প্রকার প্রতারণা।
ঢাকার সাভার-আশুলিয়া থেকে আসা পর্যটক খোকা, বাচ্চু ও নিপু বলেন, ‘মেলা উপলক্ষে ফেসবুকে বিশেষ ছাড়ের কথা শুনে ছুটে এসেছিলাম। কিন্তু থাকা-খাওয়ায় ছাড় দিচ্ছে বলে মনে হলো না।’
তারা আরো বলেন, ‘থাকা-খাওয়াসহ ১৫টি খাতে ছাড়ের খবর পেয়ে আমরা কয়েকটি পরিবার একসঙ্গে এসেছি। হোটেলে ছাড় তো পাইনি, রুম পেতেও অনেক কষ্ট পেতে হয়েছে।’ এভাবে হলে সামনে আর কক্সবাজার আসব না।
কক্সবাজার জেলা রেঁস্তোরা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ডালিম বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতেও আমরা সূলভ মূল্যে খাবারের দাম রাখছি। তালিকার বাইরে খাবারের অতিরিক্ত মূল্য রাখা যাবে না। যদি কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অতিরিক্ত মূল্য রাখার অভিযোগ পাই, তাহলে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার বলেন, ‘শনিবার পর্যন্ত শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট-গেস্ট হাউসের সব কক্ষ ভাড়া হয়েছে। আগেভাগে যাঁরা কক্ষ ভাড়া নিয়েছেন, তাঁরা ঠিকই ছাড় পেয়েছেন। হয়তো আজকাল যাঁরা এসেছেন, তাঁরা ছাড় পাননি। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের পুলিশ সুপার জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পুরো সমুদ্র সৈকত সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তা ও সেবা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সপ্তাহব্যাপী পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভালকে ঘিরে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের ভিড় সামাল দিতে আমরা সতর্কে রয়েছি।
জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, বাংলাদেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র কক্সবাজারকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে মৌসুমের শুরুতেই পর্যটন মেলা ও বিচ কার্নিভালের আয়োজন করা হয়েছে। এ জন্য পর্যটনসেবা-সংশ্লিষ্ট খাতগুলোতে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কক্সবাজারের মেলা উপলক্ষে প্রচারণাও চালানো হয়েছে।
হোটেল, গেস্ট হাউস ও রিসোর্টগুলোতে ছাড় না পাওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, পর্যটকদের হয়রানি রোধ ও সেবা নিশ্চিত করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একাধিক ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে কাজ করছেন।
সবশেষ কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. ইয়ামিন হোসেনের নেতৃত্বে হোটেল মোটেল ও রেস্টুরেন্টে মনিটরিংয়ে নেমেছেন। তিনি জানান, পর্যটকদের সাথে এরকম কেউ প্রতারণা বা হয়রানি করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
(ঢাকাটাইমস/২৯সেপ্টেম্বর/এআর)