সচিবের দাপট: হাইকোর্টের রায় নিয়েও অফিসে ঢুকতে পারছেন না বিটিসিএল কর্মকর্তা

হাইকোর্টের রায়ে নিজের দায়িত্ব বুঝে পেয়েও চেয়ারে বসতে পারছেন না বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী। ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে অফিস করতে না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামানের বিরুদ্ধে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নিজের আধিপত্য বিস্তার ও নিজের লোকদের নিয়ে প্রকল্প পরিচালনা করতে হাইকোর্টের রায়ও মানছেন না সচিব। তিনি আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে বিটিসিএল কমপাউন্ডে ঢুকতে নিষেধ করেছেন।
বিটিসিএল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিজিটাল যুগে ডাটার চাহিদা মেটাতে ইকোসিস্টেম দাঁড় করাতে অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্ক জনগণের দৌড়গোড়ায় পৌঁছানোর জন্য অবকাঠামো নির্মাণসহ সব প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পঞ্চম প্রজন্মের (ফাইভ জি) উপযোগী অবকাঠামো তৈরির লক্ষ্যে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণে এক হাজার ৫৯ কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)।
বিটিসিএল জানুয়ারি-২০২২ থেকে ডিসেম্বর-২০২৪ মেয়াদে সারাদেশে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা থাকলেও এখনও ভেন্ডর নিয়োগ দিতে পারেনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অথচ প্রকল্পের শুরুতেই সরঞ্জামাদি ক্রয়ের প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা লাভবানের উদ্দেশ্যে কমদামী যন্ত্রপাতি কেনাসহ কারিগরি বিনির্দেশ সঠিকভাবে প্রস্তুত না করায় এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ব্যাহত হতে যাচ্ছে এবং বরাদ্দকৃত টাকা লুটপাট হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু এই প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক স্থাপন করা হবে তাই কাজের ব্যাপকতা বিবেচনায় কাজের মান রক্ষার্থে সার্ভে, ডিজাইন, সুপারভিশন ও মনিটরিং কাজের জন্য ডিপিপিতে পরামর্শকের প্রস্তাব করা হয়েছে। পাঁচজন অভিজ্ঞ পরামর্শক নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমেই প্রকল্পের নেটওয়ার্কের জন্য সার্ভে, নেটওয়ার্ক আর্কিটেকচার, কারিগরি বিনির্দেশ প্রস্তুতসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়ে কাজ করানোর কথা থাকলেও তা মানা হয়নি।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, বিটিসিএল কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন পঞ্চম প্রজন্মের উপযোগীকরণে বিটিসিএলের অপটিক্যাল ফাইবার ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক প্রকল্প নেওয়া হয়। সেখানে ইকুইপমেন্ট ক্রয়ের লক্ষ্যে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার দুর্নীতিতে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবের কাছের লোকজন জড়িত। সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় গত ১৮ অক্টোবর বিটিসিএলের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) রিভিউ প্যানেলের রায় এবং বিটিসিএলের ২১৫তম পর্ষদ সভায় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ’ প্রকল্প পরিচালক ও বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সেখানে মো. আনোয়ার হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সিপিটিইউর রিভিউ প্যানেলও কারিগরি বিনির্দেশ নিয়ে কথা না বলে একপক্ষীয় রায় দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে গত ২২ অক্টোবর রাতে হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিট পিটিশন করেন অ্যাডভোকেট সেলিম আশরাফ চৌধুরী। হাইকোর্ট সিপিটিইউর রায় স্থগিত করেন এবং কেন উক্ত প্রকল্পের ইকুইপমেন্টের তালিকা পরিবর্তন করে কাজটি পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হবে না; তা জানতে চেয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবকে রুল ইস্যু করেন।
পরবর্তীতে ২৫ অক্টোবর বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরীও সিপিটিইউর রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন। সেই রিটেও হাইকোর্ট সিপিটিইউর রায় স্থগিত করেন। হাইকোর্টের উক্ত রায় পাওয়ার পর ২৬ অক্টোবর উল্লেখিত দরপত্রের খোলার নির্ধারিত তারিখ থাকলেও তা বাতিল করা হয়। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি। উল্টো আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে বিটিসিএল কমপাউন্ডে ঢুকতে সচিব নিষেধ করেছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিটিসিএল কর্মকার্তারা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, এই বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না।
ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামানকে একাধিকবার ফোন ও ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
অ্যাডভোকেট শাখওয়াত হোসেন বলেন, গত ২৫ অক্টোবর সিপিটিইউর রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করেন বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী। সেই রিটেও হাইকোর্ট সিপিটিইউর রায় স্থগিত করেন এবং আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে সপদে বহাল রাখেন। রায়ের পরের দিন থেকেই আসাদুজ্জামান অফিস করার কথা। কিন্তু তাকে অফিস করতে দেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিসিএলের সাবেক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বিটিসিএলের কর্মকার্তাদের মাঝে ব্যাপক কোন্দল। এ কারণে কোনো কাজ ভালোভাবে হচ্ছে না।
সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, বুয়েট কর্তৃক বিটিসিএলে প্রদত্ত গত ২১ সালের ৯ অক্টোবর রিপোর্টের চতুর্থ পাতায় ২০২১ সাল পর্যন্ত বিটিসিএলের ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি ৭৭০ জিবিপিএস। তখন বিটিসিএল যে ডিডাব্লিউডিএম ক্রয় করে তা ছিল সিই ব্যান্ডের ও তা কেনা হয় ২০১৫ সালে এবং বিবেচনায় ছিল থ্রি জি। আবার বুয়েটের একই রিপোর্টে আছে ২০৩০ সালে বিটিসিএলের ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি লাগবে ৫৩৭০ জিবিপিএসের। যদিও বিটিআরসির গত ১ আগস্ট ২০২২ তারিখের প্রক্ষেপণপত্র মোতাবেক বিটিসিএল এর ট্রান্সমিশন ক্যাপাসিটি লাগবে ৯০০০ জিবিপিএসের। আর বর্তমানে বিবেচনায় নিতে হবে ফাইভ জি। তাহলে এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ব্যবহার করে সিই, সুপার সিউ। আমাদের ক্যাপাসিটি বৃদ্ধির কারণে ও বর্তমান ইকুইপমেন্ট সি ব্যাণ্ডের সে ক্যাপাসিটি সার্ভিস না দেওয়ার কারণেই নতুন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এখন আমরা পুনরায় আবার একই ব্যান্ডের ইকুইপমেন্ট ক্রয় করলে এখানে রাষ্ট্রের টাকার অপচয় হবে এবং প্রকল্প কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে নিম্নমানের পুরানো প্রযুক্তি দিয়ে ২০৩০ সালে দেশের ফাইভ জি অবকাঠামো ভেঙে পড়ার আশঙ্কা আছে।
(ঢাকাটাইমস/০৩নভেম্বর/জেএ/কেএম)

মন্তব্য করুন