তাজরীন অগ্নিকাণ্ড: ১১ বছরেও শেষ হয়নি বিচারকাজ, ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে মালিকপক্ষের গাফিলতি
ঢাকার অদূরে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড ঘটে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর। তাজরীন ট্র্যাজেডির ১১ বছর পূর্ণ হলেও এখনও বিচারকাজ শেষ হয়নি। এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মালিকপক্ষের চরম গাফিলতি ছিল। আগুন লাগার পরপরই কারখানার তৃতীয় তলার ফটকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় যাতে শ্রমিকরা বের হতে না পারেন। ফলে প্রাণ হারান ১১৯ জন পোশাক শ্রমিক, আহত হন অর্ধশতাধিক। পরবর্তীতে শারীরিক অসুস্থতা এবং দুঃখকষ্টে মৃত্যুবরণ করেন আহত শ্রমিকদের মধ্যে আরও চারজন।
অভিযুক্ত মূল আসামি তাজরীনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে জামিনে আছেন। গত বছর ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের সভাপতিও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এমন বাস্তবতায় শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) তাজরীন ফ্যাশানস অগ্নিকাণ্ডের ১১ বছর পূর্ণ হতে চললো।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই এর বিচারপ্রক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে ‘তাজরীনের জন্য ন্যায়বিচার’ প্ল্যাটফর্ম। বুধবার একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই প্ল্যাটফর্মটি ঢাকাটাইমসকে জানায়, রাষ্ট্রপক্ষের দায়সারা মনোভাবের কারণেই বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকশ্রেণি এবং অপরাধ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন মালিকশ্রেণি।
গবেষক এবং সাংবাদিক ড. সায়দিয়া গুলরুখ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের দেশে আইন-আদালত সাধারণত শ্রমিক স্বার্থবিরোধী। এখানে বড়লোক এবং মালিকের অপরাধ, অপরাধ নয়। এই অগ্নিকাণ্ডের মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের যে অবহেলা আমরা দেখছি, রাষ্ট্রের এই ব্যবস্থাগত উদাসীনতাই মালিকের রক্ষাকবচ’।
এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অনুসন্ধানে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রতিটি অনুসন্ধানেই মালিক-কর্তৃপক্ষের সার্বিক অবহেলার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়ে মালিকপক্ষের জবাবদিহিতা ও যথাযথ উদ্যোগের সুপারিশ করা হয়েছে।
এরমধ্যে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই প্রতিবেদনের সুপারিশমালায় সুস্পষ্টভাবে ‘অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অপরাধে তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের মালিককে দন্ড-বিধির ৩০৪ (ক) ধারায় আইনের আওতায় এনে বিচারে সোপর্দ করার’ সুপারিশ করা হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের প্রেক্ষিতে আশুলিয়া থানা পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলাটি করে। ৩২৩/৩২৫/৪৩৬/৩০৪-ক/৩৪ (দ) দণ্ডবিধিতে সিএমএম কোর্টে এই মামলাটি চলমান রয়েছে। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল করা হয় সিএমএম কোর্টে। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত মালিক দেলোয়ার হোসেনসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত হয়। সাক্ষী করা হয় ১০৪ জনকে। ২০১৫ সালের অক্টোবরে সাক্ষ্য গ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর সর্বমোট ৫৬টি তারিখ ধার্য ছিল। এই ৫৬ দিনের মধ্যে মাত্র ৮ দিন রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করেছে এবং অভিযোগপত্রে উল্লেখিত ১০৪ জনের মধ্যে মাত্র ১১ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের মামলাটি বর্তমানে ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। আগামী বছরের ২৫ মার্চ এই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেছে আদালত। আলোচিত এই মামলার বিচারিকপ্রক্রিয়ার একটি চিত্র তুলে ধরেছে ‘তাজরীনের জন্য ন্যায়বিচার’ প্ল্যাটফর্ম। যার কিছু অংশ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। যেখানে স্পষ্ট হয়েছে এই মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণ। মূলত রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণেই ঝুলে আছে বিচারপ্রক্রিয়া।
১ নভেম্বর ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
১৯ জুলাই ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
৩০ মে ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
১ জানুয়ারি ২০২৩: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
৪ অক্টোবর ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২৮ আগস্ট ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২১ জুন ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
১৬ মার্চ ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
১৮ জানুয়ারি ২০২২: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
১১ অগাস্ট ২০২১: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
সেদিন আদালতে উপস্থিত আহত শ্রমিকদের উদ্দেশ করে মালিক দেলোয়ার হোসেনকে বলতে শোনা যায়, ‘টাকা দিয়ে সাংবাদিক নিয়ে আসবো, প্রমাণ করবো যে উপস্থিত শ্রমিকরা কেউ আমার কারখানার না।’
১৩ জানুয়ারি ২০২১: প্রায় দেড় বছর রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে না পারার কারণ উল্লেখ করে আসামি পক্ষের আইনজীবী মামলা খারিজ করার মৌখিক আবেদন করলে আদালতে উপস্থিত শ্রমিকদের একজন বলেন, ‘মহামান্য আদালত আমরা সাক্ষী কি না জানি না, কিন্তু আমরা তাজরীনের আহত শ্রমিক, শুনানির খবর পেয়ে এসেছি, আমরা সাক্ষ্য দিতে চাই’।
৭ নভেম্বর ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
৪ অগাস্ট ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
২৬ জুন ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
৮ মে ২০১৯: রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করার জন্য সময় চেয়ে আবেদন করেন এবং তা গৃহীত হয়।
৭ এপ্রিল ২০১৯: পুনরায় রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি।
৭ মার্চ ২০১৯: প্রায় দুই বছর পর সাক্ষী হাজির করে রাষ্ট্রপক্ষ। সাক্ষ্য দেন সাভার থানার এস আই আবিদ হোসেন। তিনি ঘটনাস্থলে পাওয়া শ্রমিকদের লাশের সুরতহাল তৈরি করেছিলেন।
সাক্ষী হাজির করার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের স্বদিচ্ছা নেই উল্লেখ করে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্যফোরামের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল ইসলাম সবুজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই মামলায় বাদী সরকার। আদালতের কর্মকর্তাদের আমরা যখন জিজ্ঞেস করি আপনারা সাক্ষী হাজির করতে তাদেরকে চিঠি পাঠান না কেন? তারা উত্তরে বলেন পাঠাই, শ্রমিকরা আসেন না। এসকল শ্রমিকদের সাথে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। সাক্ষীদের তালিকাও আমাদের কাছে আছে। শ্রমিকদের যখন আমরা জিজ্ঞেস করি তারা বলেন কোনো নোটিশ পান না। অর্থাৎ এখানে মিল নাই। যদি সত্যিই রাষ্ট্রপক্ষ চিঠি পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে সঠিক জায়গায় চিঠি পাঠান না। অবহেলা পরিষ্কার।’
‘এই মামলার নির্ধারিত প্রতিটি তারিখেই আমরা হাজির থেকেছি। সাক্ষী হাজির না করার চিত্র আপনারা দেখেছেন। আদালত বারবার বলছে যে আপনারা যদি সাক্ষী হাজির করতে না পারেন তাহলে এই মামলা চালিয়ে নেয়া কঠিন হবে’ বলেও জানান এই শ্রম অধিকারকর্মী।
এই মামলার সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না বলে একই মত দেন ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আব্দুল্লাহ আবু। সাক্ষী না পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রম অধিকারকর্মীদের অভিযোগ তুলে ধরলে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরেজমিনে এসে তারা দেখুক। রাষ্ট্রপক্ষ এই ক্ষেত্রে ভূমিকা নেন, আবার সাক্ষীর কাছে সমন পাঠানোর দায়িত্ব পুলিশের। আমরা তো সাক্ষীর বাড়িতে গিয়ে সাক্ষী আনবো না। এটা তো পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্ব না।’
এই মামলার প্রধান আসামি এবং তাজরীন ফ্যাশানসের মালিক দেলোয়ার হোসেন এই বিচারিক প্রক্রিয়ার মাঝেই মৎস্যজীবী লীগের সভাপতি হয়েছেন। এরপর থেকেই আদালত প্রাঙ্গনে আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন তিনি। এমনকি আদালতে শুনানিকালে পত্রিকায় প্রকাশিত তার সভাপতি হওয়ার খবর জোর গলায় প্রচার করেছেন। এই মামলার আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ কর্মকর্তাদের টাকা চালাচালির দৃশ্যও আদালত প্রাঙ্গনে প্রকাশ্যে দেখা যায় বলেও অভিযোগ রয়েছে।
শ্রমিক অধিকার নেতা শহীদুল ইসলাম সবুজ বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আসামিপক্ষের কাছে টাকার জন্য হাত পেতে থাকে। এসব আমরা নিজের চোখে দেখেছি’।
টাকা চালাচালি অভিযোগের বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের পিপি জবাব দেন, ‘ আইন কর্মকর্তারা যদি এটা করে থাকেন, এই শ্রমিকের পক্ষের লোকজন কি কোথাও অফিশিয়ালি অভিযোগ করেছেন? পিপির কাছে কোনো অভিযোগ করছে কি না? আমি ঢাকা মহানগরের পাবলিক প্রসিকিউটর, আমাকে এসে বলুক ওমুক এই কাজ করছে, বা কে বা কারা গাফিলতি করছে। আমি সত্য-মিথ্যা যাচাই করে অবশ্যই ব্যবস্থা নিব।’
‘ক্ষমতার সান্নিধ্য এবং টাকার গরম মামলার গতিকে মন্থর করে, এই ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে বলে মত দিয়েছেন গবেষক এবং সাংবাদিক ড. সায়দিয়া গুলরুখ। তিনি ঢাকাটাইমসকে আরও বলেন, ‘এই বিচারের অপেক্ষায় রোগে-শোকে, অভাব অনটনে আরো ৪ জন শ্রমিক মারা গিয়েছেন। শ্রম আইন সংশোধনের মাধ্যমে নিহত ও আহত সকল শ্রমিকের সম্মানজনক ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি এবং আহত শ্রমিকদের যথাযথ পুর্নবাসন করা হয়নি। লক্ষ্য করুণ, বাঁচার জন্য মজুরি বাড়ানোর আন্দোলন করতে গিয়ে আনজুয়ারা, জসীমরা পুলিশের গুলিতে মৃত্যুবরণ করছেন’।
সবমিলিয়ে এই বাস্তবতায় মামলার নিষ্পত্তির আশঙ্কা প্রকাশ করে এই শ্রমিক অধিকার কর্মী বলেন, ‘শ্রমিকরা সুষ্ঠু বিচার না পেলে দেশের আইন-আদালত ও সরকারের ওপরেই এই দায় বর্তাবে’।
(ঢাকাটাইমস/২৩নভেম্বর/এসআরপি/কেএ)