শিক্ষা অর্জনে চাই মূল্যবোধের ভিত্তিতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক

মোঃ বাবুল আকতার
| আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:০০ | প্রকাশিত : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৪:১২

মানব সভ্যতার শুরু থেকে অদ্যাবধি জ্ঞানচর্চা যদি মানুষের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হয় তবে এই জ্ঞানচর্চার সঙ্গে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্কও অবিচ্ছেদ্য এবং অপরিহার্য। সমাজবদ্ধতার প্রারম্ভিককাল হতে মানুষের জ্ঞানচর্চার সেই দৃষ্টান্ত ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে এক মধুরতম সম্পর্কের সূচনা করেছে। বিদ্যা দান ও বিদ্যা গ্রহণের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে ছাত্র-শিক্ষকের এই নিবিড়তম সম্পর্ক। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চেতনায় যিনি জ্ঞানপ্রদীপ জ্বালিয়ে দেন তারই আলোতে শিক্ষার্থীরা খুঁজে পায় জীবনের প্রত্যাশিত গন্তব্য।

শিক্ষকের অকৃত্রিম ভালোবাসা, নিবিড় পরিচর্যা আর শিক্ষার্থীর অপরিসীম শ্রদ্ধা ও মনোযোগ-নিষ্ঠায় এ পবিত্র সম্পর্ক অপার বন্ধনে ও অনাবিল সৌন্দর্যে বিকশিত হয়ে থাকে। পিতা-মাতার ঔরস্যজাত সন্তানটিকে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে শিক্ষক প্রতিটি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই দ্বিতীয় জন্মদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন । দেশ-কাল ও পরিস্থিতি ভেদে এর কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় না কখনোই। নিবেদিতপ্রাণ প্রতিটি শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানদানের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীর জীবনের বিকাশ সাধন করার পাশাপাশি তার ব্যক্তিত্বের জাগরণও ঘটিয়ে থাকেন। অন্যদিকে পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল ও অধ্যাবসায়ী শিক্ষার্থী তার প্রচণ্ড কৌতূহল মেটাতে শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়ে থাকে মনের খোরাক- ছাত্র শিক্ষকের এই সম্পর্ক আবহমানকাল ধরেই চলে আসছে। অতীতে শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশে শিষ্যরা গুরুগৃহে অবস্থান করে বিদ্যা অর্জনের পাঠ গ্রহণ করতো এবং পাঠ শেষে গুরুদক্ষিণা দিয়ে নিজ গৃহে ফিরে আসতো; অতঃপর কর্মজীবনের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়তো। বর্তমানে বাউল ও সুফি সাধনার ক্ষেত্রে সেরকম গুরু-শিষ্যের সম্পর্কটি অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে এখনও বজায় থাকতে দেখা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শিক্ষাবিষয়ক বহু রচনার মধ্যে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ককে পরস্পর নির্ভর ও সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

ছাত্র এবং শিক্ষক দুটি পৃথক শব্দ, দুটি পৃথক সত্তা বটে কিন্তু দুটি শব্দ একত্র করলে হয় ছাত্র-শিক্ষক; দুই শব্দের গভীর ব্যঞ্জনায় ও তাৎপর্যে তৈরি হয় এক অধরা আত্মিক বন্ধন, যা বলা বা লেখার মধ্য দিয়ে কোনোভাবেই পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর সম্পর্ক- এ সম্পর্ক আর কারও মধ্যেই স্থাপিত হয় না।

মাতা-পিতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক জন্মগত, যেখানে স্নেহের আতিশয্যই মূল; সন্তান সেখানে পিতা-মাতার অপার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠে। অর্থাৎ পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক কেবল ঘরের মধ্যেই পরিব্যাপ্ত; বহির্জগতের বিশাল-বিস্তৃত জীবন উপলব্ধি সম্পর্কে তারা সেখানে সামান্যই জ্ঞান অর্জন করতে পারে। জ্ঞানের জগতের সঙ্গে শিক্ষার্থীকে পরিচিত করান তার শিক্ষক। শিক্ষা জীবনের পরতে পরতে শিক্ষার্থীকে জীবন ও জগতের গভীরতম জ্ঞানের উপলব্ধি ও অনুভবকে আবিষ্কার করাতে থাকেন শিক্ষক। এক সময় ছাত্রদের একাডেমিক পড়ালেখা শেষ হয়ে যায়, তখন ছাত্ররা সাংসারিক ও কর্মজীবনে প্রবেশ করে। সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে এ সময় দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধের সৃষ্টি হয় তাদের মধ্যে। তখন তারা দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধের চেতনা দ্বারা পরিচালিত হয়; অবশ্য যদি তারা মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষার কার্যক্রম দ্বারা নিজের জীবনকে সঠিকভাবে গঠন করতে সক্ষম হয়ে থাকে তাহলেই। মূলত নবীন শিক্ষার্থীর এই মূল্যবোধের মাধ্যমেই আশপাশের কর্মজগৎ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাগরিকদের যুক্ত করে সমাজ হতে পারে শান্তির আবাস। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এক সময় এই মূল্যবোধের খুবই উচ্চমূল্য ছিল আমাদের সমাজে। সবাই নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতো, ক্লাসরুমে বা স্কুল-কলেজের বাইরেও তাদের মধ্যে মান্যতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় ছিল। শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেরকম গভীর মূল্যবোধের দৃষ্টান্ত এখন আর খুব একটা সুলভ নয়; পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনেক পাল্টেছে। শিক্ষার্থী এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্য সকলের মনস্তাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয়ও বদলে গেছে। এ কারণে ছাত্র-শিক্ষকের মধুরতম সম্পর্কটি এখন অনেকটাই প্রশ্নের মুখে। এজন্য অবশ্য এককভাবে শিক্ষার্থীদের দায়ী করা কোনোভাবেই যৌক্তিক কাজ নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, এদের মধুর সম্পর্ক ও শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতির যাবতীয় পাঠ্যসূচিমূলক জ্ঞান-অর্জনের যে কারিকুলাম রয়েছে তা সংরক্ষণ ও সমৃদ্ধির জন্য সমাজের আরও আরও মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্যের কমতিকেও অস্বীকার করা যায় না।

শিক্ষক একটি আদর্শ পেশাদারিত্বের নাম। 'শিক্ষক', এই শব্দটি শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে ওঠে আদর্শ ও মূল্যবোধ ধারণ করা একজন অত্যন্ত সম্মানিত ও পবিত্র মানবমূর্তি। এজন্য বলতেই হয় যে, একজন শিক্ষক শুধু ক্লাসরুমেরই শিক্ষক নন- তিনি সমাজের ও রাষ্ট্রেরও একজন অন্যতম অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার অনুসরণের মূল্যবোধসম্পন্ন আস্থার পথ ধরেই শিক্ষার্থীকে এগিয়ে যেতে হয়। প্রাচীনকাল থেকেই আমরা দেখে আসছি যে, শিক্ষকগণ ছাত্রদের ক্লাসরুমে শুধু পাঠদানই করেন না, তাদের ভদ্রতা ও শিষ্টাচার শেখান, নীতি-নৈতিকতার দীক্ষা দেন, প্রয়োজনে শাসনও করেন।

আমরা জানি, পিতা-মাতা সন্তানদের শিশুকাল থেকে লালন পালন করেন, সঙ্গ দেন, ভরণপোষণ করেন, বেড়ে উঠতে সহায়তা করেন। কিন্তু শিশু সন্তান বয়োঃপ্রাপ্ত হলে পিতা-মাতার আর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তারা নিজেদের মতো করে চলতে চায়, আশপাশের পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী এগিয়ে যেতে চায় এবং নিজের জীবনকে প্রত্যাশার মাপকাঠিতে গঠন করতে চায়। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, আশপাশের পরিবেশের ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই প্রভাবই পড়ে তাদের উপর, তা সত্ত্বেও পারস্পরিক সম্মানবোধ শান্তি-সহনশীলতার অনুকূল পরিবেশ লালন করতে হয় তাদের। এসব মহৎ অনুভবের সবচেয়ে বড়ো জায়গাই হলো ঘনিষ্ঠ ও নিবিড়তম ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক। শিক্ষকই তার মধ্যে মৌলিক মূল্যবোধ ধারণে সব রকম চেষ্টা চালিয়ে তাকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করেন।

সাধারণ অর্থে যিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি অবশ্যই ছাত্র এবং যিনি শিক্ষাদান করেন তিনি নিঃসন্দেহে শিক্ষক। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষকের সংযোগ-সম্পর্কের আসল সমীকরণটি আরও গভীর মর্মার্থের ভেতর প্রোথিত। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক অতি পবিত্র, আত্মিক, মধুর ও অবিচ্ছেদ্য- যার মূল ভিত্তিটাই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মূল্যবোধে গড়া।

অপ্রিয় হলেও এটা সত্যি কথা যে, এখন শিক্ষাঙ্গন আর আগের শিক্ষাঙ্গন নেই; নোংরা, বেয়ারা ও ঘৃণিত পরিবেশ প্রবেশ করেছে শিক্ষাঙ্গনে। এখন শিক্ষাঙ্গন হয়ে উঠেছে কলুষতাপূর্ণ ছাত্ররাজনীতির এক নিরাপদ বিচরণ ক্ষেত্র। রাজনীতির নামে অপরাজনীতির এক গভীর কালোছায়া শিক্ষা-ক্যাম্পাসের সর্বত্র ঢেকে ফেলেছে। মফস্বলের যেকোনো একটি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পর্যন্ত এই অপরাজনীতির কালোছায়া বিদ্যমান। পারস্পরিক বিবদমান দলগুলো ছাড়াও নিজেদের মধ্যে সব সময় অন্তর্দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি, অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি ও কলহে লিপ্ত থেকে এরা শিক্ষাঙ্গনকে একটি ভয়াবহ রণক্ষেত্রে পরিণত করে ফেলে মাঝেমধ্যেই। সংবাদমাধ্যমে সেসব খবর দেখে শিউরে ওঠে দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ সাধারণ মানুষ। শিক্ষার্থী নামধারী এ সকল দুর্বৃত্তের হাতে শিক্ষকদের শারীরিক লাঞ্ছনাসহ মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। এ সকলকিছুর মূলে যে দেশের অপরাজনীতি এটা সমাজের যে কেউই সম্পূর্ণরূপে অনুধাবন করতে সক্ষম কিন্তু এর কোনো প্রতিকার সহসাই আমাদের সামনে ঘটার দৃষ্টান্ত চোখে পড়ে না। সংগত কারণেই দেখা যায়, শিক্ষকগণ আর আগের মতো শিক্ষার্থীদের আপন করে নিতে পারে না এবং সুশৃঙ্খল ও নিয়মপদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষাদানও বাস্তবায়ন করতে পারে না। যৌক্তিক কারণেই শিক্ষকগণ আর ছাত্রদের আগের মতো বাধ্যতামূলক শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে শাসনও করতে পারেন না। বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দেখা যায়, ছাত্ররা মাত্রাতিরিক্ত অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে সন্ত্রাস করে, শাস্তির কোনো ভয় তারা করে না, আগের মতো শিক্ষককে তো মানেই না; বরং উল্টো যেটা দেখা যায়- শিক্ষকই ছাত্রকে দেখে ভয় পান, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে শিক্ষাঙ্গনে অবস্থান করেন। বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রীয় অপরাজনীতি চর্চার বাস্তবতায় এখন শাসন আর শাস্তি থেকে স্বাধীন হয়ে ছাত্ররা শুধু অবাধ্য ও উগ্রই নয় রীতিমতো মারমুখী অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীও হয়ে উঠছে। তারা শিক্ষকদের নানাভাবে নাজেহাল ও অপদস্ত করেই কেবল শান্ত হচ্ছে না- শিক্ষকদের প্রাণনাশেরও কারণ হচ্ছে তারা; সংবাদপত্র ও টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমে আমরা এসব খবর হরহামেশাই দেখি এবং আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তাই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে পর্যবেক্ষণ করলে এই সত্য প্রতিভাত হয় যে, আজ ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক অনেক অবর্ণনীয় তিক্ততায় পর্যবসিত। তাহলে ছাত্র-শিক্ষকের সেই মধুর সম্পর্কে চিড় ধরেছে কেন? এর উত্তরে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়- অপরাজনীতির থাবা এবং সময়ের পালাবদলে নানা ধরনের অসংখ্য ও অগণিত ডিভাইস বা প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহারে মানুষের মন-মানসিকতায় ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে- বিশেষ করে উঠতি ছাত্র-ছাত্রীসহ তরুণ প্রজন্মের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের নেতিবাচক দিক এতটাই প্রকট আকারে প্রসার লাভ করেছে যে, আগামী প্রজন্ম কোন পথে ধাবিত হচ্ছে তা নির্ণয় করা রীতিমত অসাধ্য হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তি যেখানে শিক্ষার্থীকে জ্ঞান ও মেধাবিকাশে এবং আনন্দ বিনোদনের অংশ হিসেবে সহায়ক হওয়ার কথা সেখানে প্রযুক্তির নিদারুণ মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি শিক্ষার্থীদের এক গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত করে ফেলছে ক্রমাগত। এটা রাজধানী শহর থেকে শুরু করে জেলা-উপজেলা, গ্রাম-গঞ্জ; কোথাওই কমতি দেখা যায় না। ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ অসংখ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে তারা এতটাই মাত্রাতিরিক্ত ভার্চুয়াল জগতে আসক্ত হয়ে পড়েছে যে- সময়মতো খাওয়া, ঘুমানো, হোম ওয়ার্ক, অন্যান্য শিক্ষা অর্জন- কোনোকিছুই রুটিন অনুযায়ী হচ্ছে না। ভার্চুয়াল জগতে আসক্তি হয়ে তারা বাস্তবিক জগতকেই একবারে গৌণ করে ফেলছে। পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট স্বজনদের সঙ্গে এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের তর্ক-বিতর্ক, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রমাগত ঘটেই চলেছে। পিতা-মাতার এ সংক্রান্ত তিরস্কারে কোনো কোনো শিক্ষার্থী আত্মহত্যারও পথ বেছে নিচ্ছে- জীবনের শুরুতেই জীবন প্রদীপ নিভে গিয়ে বিনষ্ট হচ্ছে তার অবারিত সম্ভাবনাময় এক জীবনের। এ থেকে মুক্তির উপায় কী- তা ভেবে অভিভাবক, শিক্ষক এবং সমাজের শিক্ষিত-সুধীজনরা আতঙ্কগ্রস্থ না হয়ে পারে কি?

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আরেক মহাসংকট হলো শিক্ষার নামে শিক্ষা বাণিজ্য। বর্তমানে শিক্ষার বহুমুখী বিপণনে ব্যস্ত ছাত্র-শিক্ষক দুপক্ষই। শিক্ষা এখন রীতিমতো বাণিজ্য হয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিরাজ করে। কে কত উচ্চমূল্যে শিক্ষা ক্রয় করতে পারে, শিক্ষা অর্জনের দৌড়ে যেন সেই এগিয়ে থাকে- এই অসুস্থ মানসিকতা শিক্ষার সামগ্রিক পরিবেশকে রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এরূপ বাজার ব্যবস্থায় শিক্ষক বিক্রেতার ভূমিকায় আর ছাত্র আজ ক্রেতার ভূমিকায় পণ্যক্রয়ে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। নামিদামি শিক্ষকের কাছে শিক্ষা অর্জন করতে বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে যাদের আর্থিক সংগতি কম সে ধরনের অভিভাবকের সন্তানরা এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখন কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রীতিমতো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, নামে-বেনামে গড়ে উঠেছে নানা ধরনের কোচিং সেন্টার- বলা যায় শিক্ষার নামে শিক্ষা কোচিং-এর বাণিজ্য সেন্টার। এদের বাহারি বিজ্ঞাপনে শিক্ষকের প্রকৃত আদর্শ হারিয়ে কতিপয় শিক্ষক এখন শিক্ষক মূল্যবোধের পবিত্র পরিচয়ের ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ! বৈশ্বিক চাহিদায় কিছু কিছু শিক্ষক নামধারী বিবেকহীনের মতো পরীক্ষার হলে ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত বলে দিচ্ছে এবং দিচ্ছে অতিরিক্ত নম্বরসহ বাড়তি অনেক সুযোগ-সুবিধা। সংগত কারণেই অন্যদিকে কতিপয় ছাত্র শিক্ষককে কেনা গোলামের মতো ব্যবহার করার সুযোগ নিচ্ছে। কখনো কখনো পরীক্ষার হলে সুযোগ-সুবিধা না দিলে ছাত্রের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত পর্যন্ত হচ্ছে। রাজনীতির ছত্রছায়ায় কিছু ছাত্র নামধারী সন্ত্রাসী যেমন পবিত্র শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করছে, তেমনি পরম গুরুজন শিক্ষককে অপমান ও অপদস্থ করতেও দ্বিধা করছে না। জাতির জীবনে এই অমানিশার ঘোরতর বন্ধ্যত্ব চলছে এখন। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী কেউ জানে না। বছর বছর পাঠ্যসূচির বিভিন্ন সিলেবাস ও পরীক্ষার ধরন-পদ্ধতি পরিবর্তন হচ্ছে কিন্তু আদতে শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে কার্যকরভাবে শিক্ষাগ্রহণ মূল্যবোধসম্পন্ন হচ্ছে কী না- তা গুরুত্ব দিয়ে তলিয়ে দেখা হচ্ছে না।

ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ আয়োজনে শিক্ষাঙ্গনকে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের সত্যিকারের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনতে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে, রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ছাত্র শিক্ষকের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে নির্মিত হবে ভবিষ্যতের সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। দেশে আগামীর সুনাগরিক গঠন করতে বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যকর শিক্ষা গ্রহণের কোনোই বিকল্প থাকতে পারে না। বিশ্ব এখন তুমুল প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ক্ষেত্র- সেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত জায়গা দখল করে নিতে হলে অবশ্যই তাকে যুগোপযোগী শিক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফলাফলের মাধ্যমে জায়গা করে নিতে হবে।

এ ক্ষেত্রে শিক্ষকের দায়িত্ব শিক্ষককে নিতে হবে এবং শিক্ষক, অভিভাবক ও রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-কর্ণধারদের নিজ নিজ যথোপযুক্ত দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষককেই এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে। শিক্ষক হতে গেলে ব্যক্তিকে সর্বপ্রথম বিষয়গত জ্ঞানের আধার হওয়ার পাশাপাশি ছাত্রের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের কৌশলী ও কৌতূহলী ব্যক্তি হতে হবে। ছাত্রকে স্নেহের পাশাপাশি তার প্রতি ক্ষমাশীল ও মহানুভব হতে হবে। সন্তান পিতা-মাতার কাছ থেকে সম্পদের অধিকারী হন; আর শিক্ষকের কাছ থেকে হন জ্ঞানের অধিকারী। সুতরাং ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে যেখানে থাকবে শুধু পারস্পরিক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, আস্থা আর কল্যাণকামী চিন্তা।

মোঃ বাবুল আকতার: লেখক ও কলেজ শিক্ষক।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :