টুয়েলভথ ফেল

দূষ্যন্ত সিং স্মার্ট ডিএসপি অফিসার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নকল-উৎসব চলে এমন এলাকায় সদ্য বদলি হওয়া এই ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ কলেজে এই নকল প্রথা বন্ধ করে দেন। সব সময় নকল করে পাশ করা এক কলেজের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেন। ফলে সে বছর দ্বাদশ শ্রেণীতে মনোজ প্রভাকর সহ সবাই ফেইল করে। পরবর্তীতে মনোজের ভাই একটি মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে এই ডিএসপি অফিসারের কল্যাণে মুক্তি পান।
মনোজ স্বপ্ন দেখতে থাকেন দূষ্যন্ত সিং এর মতো ডিএসপি অফিসার হওয়ার। পরের বছর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নকল ছাড়া তৃতীয় বিভাগে পাস করে সে। দূষ্যনত সিং এর পরামর্শে ডিএসপি হওয়ার জন্য ইতিহাস এবং হিন্দি সাহিত্যে স্নাতক পড়েন মনোজ। তার দাদি জমানো সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে তাকে গোয়ালিয়রের সরকারি কর্মকমিশনে পাঠান ডিএসপি হওয়ার জন্য। কিন্তু সেখানে গিয়ে মনোজ জানতে পারেন প্রশাসনিক এক জটিলতায় মধ্যপ্রদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে নিয়োগ তিন বছরের জন্য বন্ধ রয়েছে। এতে তার সরাসরি ডিএসপি হওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায়।
দাদির দেওয়া সকল টাকা পয়সা এক প্রতারকের পাল্লায় খুইয়ে পথে পথে ঘুরতে থাকেন। সেখানে মনোজের সাথে দেখা হয় প্রীতম পান্ডের। যিনি কিনা ইউপিএসসি পরীক্ষা দিতে দিল্লিতে যাচ্ছিলেন।ইউপিএসসি ভারতের সেন্ট্রাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন। এটির মাধ্যমেই ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস আইপিএস হওয়া যায়। ডিএসপি মূলত রাজ্য পুলিশের একজন অফিসার। অন্যদিকে তুমুল প্রতিযোগিতার ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশন (ইউপিএসসি) পরীক্ষা দিয়ে আইপিএস কর্মকর্তা হতে হয়। ভারতে কোটি কোটি তরুণদের কাছে ইউপিএসসির চাকরি যেন সোনার হরিণ।
মনোজ এবং প্রীতম দিল্লিতে গিয়ে গৌরীর সাথে কোচিং সেন্টারে যোগাযোগ করেন। গৌরী আইপিএস অফিসার হওয়ার জন্য ষষ্ঠবারের মতো পরীক্ষা দিতে যাচ্ছেন এবং এটি তার শেষ সুযোগ। গৌরী ভাইভাতে উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন এবং শেষে রিস্টার্ট নামে একটি কোচিং সেন্টার চালু করেন সেখানে মনোজকে চা সরবরাহের দায়িত্ব দেন।চা বিক্রির ফাঁকে ফাঁকে মনোজের আইপিএস হওয়ার প্রিপারেশন চলতে থাকে। সে বছর প্রিলিমিনারিতে মনোজ ব্যর্থ হন। গৌরীর পরামর্শে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় পাশ করেন। একটি কোচিং সেন্টারে শ্রদ্ধা জোশীর সাথে দেখা হয় যিনি পরবর্তীতে ইউকেপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ডেপুটি কালেক্টর হন।মনোজ তার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, সে বছরও তার মূল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি।
নায়িকা শ্রদ্ধা র পরামর্শে তারপরে সে আরও কঠোর পরিশ্রম করার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও এটি একই ফলাফল দেয়। মনোজ বাড়ি ফিরে দেখে যে, তার দাদি মারা গেছেন।গৌরী মনোজকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং তাকে বলে যে, লাইব্রেরীতে এবং আটার দোকানে কাজ করা ছেড়ে দিয়ে পড়াশোনায় পুরোপুরি মনোযোগ দিতে । বাড়ী থেকে ফেরার মুহুর্তে মা বলেন তোমার দাদীর শখ ছিল তুমি ডিএসপি হবে , পরেরবার তুমি যখন ফিরবে ইউনিফর্ম পরে আসবে! মার কথা দারুন রেখাপাত করে। মনোজ শুধু পড়াশোনা করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত মূল পরীক্ষাও পাশ করে।
ভারতের এক প্রত্যন্ত এলাকার নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে মনোজের নানা চড়াই-উতরাই, বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে কঠিন সংগ্রাম করে আইপিএস কর্মকর্তা হওয়ার গল্প নিয়ে এই সিনেমা।ভারতে ইউপিএসসি যেমন, বাংলাদেশে বিসিএস তেমন। পুলিশসহ বিসিএসের বিভিন্ন ক্যাডারে চাকরি পেতে বাংলাদেশের লাখো তরুণ এমনকি হাজার হাজার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার কৃষিবিদ দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় করে থাকেন।
মনোজের সংগ্রামের মতো আমাদের অনেকের হুবহু গল্প বাংলাদেশেও খুঁজে পাওয়া যায়। মনোজ যেমন ডিএসপি হতে গিয়ে আইপিএস হয়েছেন। তেমনি এসআই হতে গিয়ে বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে। ইউপিএসসির সঙ্গে বিসিএস পরীক্ষায় অভিজ্ঞতার এমন সব সংগ্রাম, অনুপ্রেরণার গল্প মিলে ‘টুয়েলভথ ফেল’ সিনেমাটিতে খুঁজে পেলাম বলে এক নিঃশ্বাসে মুভিটি দেখা শেষ করলাম।
সত্য ঘটনা অবলম্বনে মনোজ কুমার শর্মা ২০০৫ সালে ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ভারতীয় পুলিশ সার্ভিসে (আইপিএস) যোগ দেন। দৃঢ় সংকল্পের সাথে, তিনি তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছিলেন। চতুর্থ প্রচেষ্টায় তিনি সারা ভারতে ১২১ তম হয়ে আইপিএস হয়েছিলেন।
আমিও ২০০৫ সালে বিপিএসসিতে ১৪০ তম হয়েছিলাম। আমার বিসিএস পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে ওঠার গল্পের কিছুটা মনোজ প্রভাকরের মতই। চুড়ান্ত সাফল্যের খবরে মা র সাথে ফোনের কনভারসেশনের আবেগ, ভাই বোনের উল্লাস, সহযোদ্ধাদের উচ্ছাস, প্রিয়তমার আনন্দ অশ্রু! যেন আমার লাইফের একেবারে হুবহু কপি! আহ! হিন্দি কোন মুভি দেখে চোখে জল আসার ঘটনা আমার মনে হয় এবারই প্রথম।
পরিশেষ: পথ যতই বন্ধুর হোক, পরিস্থিতি যতই প্রতিকূল হোক, প্রবল ইচ্ছা,কঠোর পরিশ্রম, নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় থাকলে একদিন সাফল্য যে ধরা দেবেই, তা এই সিনেমার মূল শিক্ষণীয় বিষয়।
লেখক: পুলিশ কর্মকর্তা

মন্তব্য করুন