রিজেন্সি হোটেলের দুর্নীতি অনুসন্ধানে ধীরগতি দুদকের

প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের প্রায় ১০ বছর গড়িয়েছে। মিলছে না সমাধান। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণে ধীরগতি শঙ্কা জাগাচ্ছে অভিযোগকারীদের মনে।
রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডে বিলাসবহুল হোটেল ‘ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট’-এর বিরুদ্ধে যেমন অভিযোগের শেষ নেই, তেমনি মিলছে না বিচার। উল্টো অভিযোগ তুলে মিথ্যা মামলা এবং পুলিশি হয়রানিরও শিকার হয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
বিচারের প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা। অবশেষে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত শুরু করলেও ধীরগতি লক্ষণীয়। দুদক সূত্র জানায়, সহসাই আসছে না প্রতিবেদন, রয়েছে জটিলতা।
মূলত কোম্পানির টাকায় নিজেদের নামে কক্সবাজারে জমি ক্রয় করে আবার কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের কাছে বিক্রি করার মাধ্যমে ৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন রিজেন্সি হোটেলের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান পরিচালক মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবির রেজা এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আরিফ মোতাহার। পরিচালক বোর্ডে থাকা এই ৩ মালিকের স্ত্রী ও সন্তানরাসহ মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে প্রতারণা-জালিয়াতি ও অনিয়মের বহু অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও থমকে আছে আইনি কার্যক্রম।
প্রবাসীদের ৪৮ কোটি টাকা বিনিয়োগের পর তাদেরকে বঞ্চিত করে অবৈধ উপায়ে মাসিক ৬ লাখ টাকা বেতন তোলার অভিযোগের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্স থেকে সাড়ে ৭ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণের মাধ্যমেও দুর্নীতি এবং মানিলন্ডারিংয়ের অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারী মোহিদ আলী মিঠু বলেন, ‘২০০৫ সালে চুক্তির সময় তারা বলছিল (অভিযুক্ত ৩ মালিক) আমরা ৫২ কোটি টাকা দিয়েছি, আমাদের ৫৪ পারসেন্ট শেয়ার। তাদের তো কোনো আয় ছিল না। আর আমরা ১২০ জন লন্ডন প্রবাসী আয় করি, তারপরেও ৪৮ কোটি টাকা দিতে হিমশিম খাইছি। এত বছরে চুরির শেষ নাই, যেভাবে যা পারছে, তাই করছে। লন্ডনে যারা আছে তারা তো দেশে গিয়ে সেভাবে খোঁজ নিতে পারতেন না। আমাদেরকে কোনো বোর্ডেই রাখা হয়নি, মিটিংয়েও ডাকা হয়নি।’
উল্লেখ্য, রাজধানীতে পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণে লন্ডনজুড়ে প্রচারণা চালায় ঢাকা রিজেন্সি হোটেলের পরিচালনা পর্ষদ। বিনিয়োগে সুরক্ষার পাশাপাশি অর্থের শতভাগ মালিকানা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয় প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের। সে বিশ্বাস রেখেই ২০০৫ সালে ঢাকা রিজেন্সি লিমিটেড নামে কোম্পানি গঠনে বিনিয়োগ করেন লন্ডনে বসবাসরত ১২০ জন প্রবাসী। ১০০ কোটি টাকার এ প্রকল্পে অভিযুক্ত ৩ মালিকের ৫২ কোটি টাকা এবং প্রবাসীদের শেয়ার হোল্ডার হিসাবে ৪৮ কোটি টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তবে প্রবাসীদের অভিযোগ সেই ৩ জনের ৫২ কোটি টাকা বিনিয়োগের কোনো প্রমাণ তারা পাননি। অবশেষে নানান ধরনের প্রতারণার কৌশলে প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা খুইয়েছেন সব। রিজেন্সি হোটেলের অভিযুক্ত মালিকদের বিরুদ্ধে দুবাই ও লন্ডনে বিপুল পরিমাণে অর্থ পাচারেরও অভিযোগ রয়েছে। সূত্র জানায়, এসব তথ্যের প্রমাণ দুদকের কাছে রয়েছে।
উচ্চ আদালতের কার্যক্রম:
টাকা আত্মসাতের অভিযোগে উচ্চ আদালতে প্রথম মামলা দায়ের করা হয় ২০১৪ সালে। এরপর প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের পক্ষে ২০১৮ সালে পৃথক ২টি মামলা করেছেন মোহিদ আলী মিঠু। এছাড়া আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন অন্য ২৭ জন বিনিয়োগকারী। আদালতের নির্দেশনায় কোম্পানি অডিট হলে সে রিপোর্টেও প্রতারণার তথ্য উঠে আসে। উচ্চ আদালত থেকে বিচারপতি ও হোটেলের কর্মকর্তাদের নিয়ে বিভিন্ন সময় বোর্ড গঠন করা হলেও কোনো সুরাহা হয়নি। বর্তমানে ৩টি মামলা উচ্চ আদালতের কোম্পানি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
এছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্তেও অভিযোগের সত্যতা উঠে এসেছে।
এই অভিযোগকারী ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘আমরা আদালতে গেলাম বিচার চাইতে, তারা বোর্ড বানায় দিল। সেখানেও বোর্ড চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সব তারা-তারাই, তাদের নিয়ম-কানুন। আমরা কথা বললে শুনতেই রাজি না। তাহলে আমাদের কী লাভ হলো? কোনো প্রতিকার নাই।’
এদিকে আদালতে দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর থেকেই যুক্তরাজ্যে পলাতক আছেন মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ। লন্ডন ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিসিসিআইয়ের পরিচালক হিসেবেও কাজ করছেন তিনি। এছাড়া জামিনে আছেন কবির রেজা এবং আরিফ মোতাহার।
দুদকের কার্যক্রম:
২০১৮ সালে প্রথমবার দুদকে অভিযোগ আনেন ভুক্তভোগীরা। সেসময় দুর্নীতির এসব অভিযোগের সত্যতা মিললেও বেসরকারি মালিকানার অজুহাতে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি দুদক। অবশেষে নানা ঘাট পেরিয়ে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এসব অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদুক। তবে এর আগে অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক মো. মোশারফ হোসেইন মৃধা অনুসন্ধানের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে এই অনুসন্ধানী কর্মকর্তা উল্লেখ করেছিলেন, ‘মুসলেহ উদ্দিন আহমেদ, কবির রেজা এবং আরিফ মোতাহার কোম্পানির টাকায় কক্সবাজারে জমি কিনেছেন। আবার সেই জমি হোটেলের কাছে বিক্রি করে ৮,৮৫,০০,০০০ টাকা বায়না বাবদ অগ্রিম নেওয়ার মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন, যা ফৌজদারি অপরাধ। অন্যদিকে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে পাবলিক সার্ভেন্ট না হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা সমীচীন হবে না।’
গড়িমসির পর অবশেষে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে অর্থ আত্মসাতের পাশাপাশি ঋণ গ্রহণে অনিয়ম এবং যুক্তরাজ্য থেকে টাকা বিনিয়োগে কোনো মানিলন্ডারিং অপরাধ হয়েছে কি না এসব বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ঢাকা রিজেন্সি হোটেল জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে নিবন্ধিত কোম্পানি এবং বিভিন্ন সরকারি ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নেওয়ার যৌক্তিকতায় এই অভিযোগ আমলে নিতে বাধ্য হয় দুদক। দুদকের উপপরিচালক মো. মশিউর রহমান এবং সহকারী পরিচালক মো. রাকিবুল হায়াতের সমন্বয়ে চলছে অনুসন্ধান। পুনরায় আরও এক বছর গড়ালেও এখনো অনুসন্ধান শেষ হয়নি। অন্যদিকে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই মামলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা দুদকের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা ঢাকা টাইমসকে জানান, ‘শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, যা দিয়ে হোটেলের উন্নয়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এখান থেকে একটি বড় অঙ্কের টাকা পরিচালকদের অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। ফলে পরিচালকরা অনেক টাকার মালিক, কিন্তু হোটেলটা ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছে।’
এই প্রসঙ্গে ভুক্তভোগী বিনিয়োগকারীরা প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা যদি শেয়ারহোল্ডার হই, তাহলে আমাদেরকে না জানিয়ে ব্যাংক সেই ৩ জনকে কীভাবে ঋণ দেয়?’।
দুদক সূত্র জানায়, তদন্তে অগ্রগতি রয়েছে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভিন্ন মেয়াদে সর্বোচ্চ ২০ বছর সাজার বিধান রয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ সচিব থেকে শুরু করে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্রসচিব বরাবরও বিস্তারিত অভিযোগ তুলে চিঠি পাঠিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তবে এসব জায়গা থেকে কোনো পাল্টা জবাব আসেনি।
পুলিশি হয়রানি:
২০১৮ সালে দুদকের পক্ষ থেকে মামলা করার এখতিয়ার নেই উল্লেখ করে পুলিশের মাধ্যমে মামলা করার সুপারিশ রেখেছিলেন দুদকের তৎকালীন অনুসন্ধানী কর্মকর্তা। সে অনুযায়ী পুলিশের মহাপরিদর্শক এবং কমিশনার বরাবর ঘটনা তুলে ধরে মামলার আবেদন জানায় দুদক। এর ধারাবাহিকতায় খিলক্ষেত থানা এই দায়িত্ব পেলেও সেখানে আসে আরেক বিপত্তি।
মোহিদ আলী মিঠুর সঙ্গে ই-মেইলে কথোপকথনের একটি চিঠি সংযুক্ত করে পুলিশ দুদককে জানায়, ‘ভুক্তভোগী বাদী হয়ে মামলা করতে আগ্রহী নন। তিনি জানিয়েছেন এটি তাদের পুরোনো ভুল বোঝাবুঝি।’ সেই নোটিশে মিঠুর ই-মেইল হিসেবে [email protected] এই আইডিটি উল্লেখ করে পুলিশ। যা মূলত [email protected] হওয়ার কথা। পরে অবশ্য পুলিশ দাবি করেছে দুদককে প্রতিবেদন লেখার সময় ই-মেইল আইডিটি অসতর্কতাবশত ভুল হয়েছে।
তবে পুলিশের এসব বক্তব্য সম্পূর্ণ নাকচ করে মোহিদ আলী মিঠু জানান, ‘যোগাযোগ না করে উল্টো তার নামে একটি ভুয়া ই-মেইল আইডি খুলে পুলিশ। পরে নিজেরাই তথ্য আদান-প্রদান করে তার নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
রিজেন্সি হোটেলের বর্তমান পরিচালনা কমিটির কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়েই পুলিশ এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন প্রবাসী বিনিয়োগকারী মিঠু। অভিযোগকারী লন্ডন প্রবাসী মোহিদ আলী মিঠুর সঙ্গে পুলিশের এই প্রতারণার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে দুদক সূত্র।
এছাড়া বিভিন্ন সময়ে মুসলেহ আহমেদের প্রতারণা ও মিথ্যা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন বলেও জানিয়েছেন ভুক্তভোগী প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা। তারা আরও জানান, রিজেন্সি হোটেলের ১২০ জন প্রবাসী বিনিয়োগকারীর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ৭টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। রাজধানীর রামপুরা থেকে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় ৫০ দিন জেলও খেটেছেন এই প্রবাসী। পরে পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বিভাগীয় তদন্তে প্রমাণিত হয় যে, ঢাকা রিজেন্সির সেই ৩ মালিকের যোগসাজশে সেসব মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সেসময় রামপুরা থানা পুলিশ হেফাজত থেকে হাতের সোনার ঘড়ি ও মোবাইলসহ লাখ লাখ টাকার জিনিস খুইয়েছেন ব্রিটিশ নাগরিক মোহিদ আলী মিঠু। ফোন থেকে ব্যক্তিগত ছবি বের করে পুলিশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার মানহানি ঘটিয়েছেন বলেও অভিযোগ তার।
এই ঘটনায় সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ভুক্তভোগী প্রবাসী মিঠু। এই মামলার তদন্ত করছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
প্রবাসী বিনিয়োগকারীরা বলেন, কোম্পানির কাছে হিসাব-নিকাশ চাওয়ার পর থেকেই শুরু হয় নানা ষড়যন্ত্র। কোম্পানির কাছে লভ্যাংশের শেয়ার চাইলেই শুরু হয় মিথ্যা মামলা ও নানা হয়রানি। ফলে অনেকেই কোম্পানি থেকে হিসাব চুকিয়ে সরে গেছেন।
মোহিদ আলী মিঠুসহ শুরু থেকেই অভিযোগকারীদের মধ্যে ছিলেন ১২০ জন যুক্তরাজ্য প্রবাসী। দেশে প্রবাসী ভুক্তভোগীদের সব মামলা বর্তমানে মোহিদ আলী মিঠু একাই চালিয়ে নিচ্ছেন।
এই প্রবাসী আক্ষেপ করে বলেন, ‘এসব দুর্নীতি কী হতেই থাকবে? কারও বিচার হবে না? অভিযোগ করলে উল্টো জেল খাটতে হবে? ভয় দেখাতে থাকবেন? এ কেমন বাংলাদেশ, কোনো ন্যায়বিচার মানুষ পায় না? এমন বাংলাদেশ তো আমরা চাই না, এমন দুর্নীতি চলতে থাকলে দেশে কোনো প্রবাসী আর বিনিয়োগ করবেন না।’
(ঢাকাটাইমস/১৬জানুয়ারি/এসআরপি/আরআর)

মন্তব্য করুন