বস্তির আগুনের আড়ালে কী?

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস
  প্রকাশিত : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৩| আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫৫
অ- অ+

রাজধানীর বস্তিগুলোতে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারানোর পাশাপাশি নিঃস্ব হন অনেক মানুষ। প্রথম কয়েকদিন তৎপরতা দেখা যায় আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর। গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে আলোর মুখ দেখে না প্রতিবেদন।

অভিযোগ আছে, বস্তিতে অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে দখল আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। যার পেছনে রয়েছেন প্রভাবশালীরা। ফলে ঘটনাগুলো তদন্ত কমিটিতেই আটকা পড়ে যায়। এরই মধ্যে বস্তির নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হয়।

ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগসহ বস্তিবাসীর অসতর্কতার কারণে বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড বেশি ঘটে থাকে। তবে, বস্তিবাসীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, এর পেছনে প্রভাবশালীদের হাত রয়েছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই বস্তিবাসীরা অভিযোগ করে থাকেন, বস্তির জায়গা দখল নিতে এবং আধিপত্য বিস্তার করতে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়।

গত শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজার মোল্লাবাড়ি বস্তিতে (বিএফডিসি পাশে) আগুনের ঘটনায় শিশুসহ দুইজনের মৃত্যু হয়। পুড়ে যায় তিনশ ঘরবাড়ি। এঘটনায় নিহত দুইজন হলেন শারমিন আক্তার (২৩) তার দুই বছরের ছেলে রাফি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, মোল্লাবাড়ি বস্তিটির জায়গার মালিক ওয়াদুদ মোল্লা, আশরাফ মোল্লা ইলিয়াস মোল্লা নামে তিন ভাই। তারা তিন ভাই এই বস্তিতে ঘর বানিয়ে ভাড়া দেন। বস্তিটির বয়স ২০ বছরের বেশি। রেলওয়ের কিছু জায়গা বস্তিটির মধ্যে আছে।

সরেজমিনে জানা গেছে, বস্তির একজন মালিকের একটি বাড়ি রয়েছে বস্তিঘেঁষা। ফলে সেখান থেকে বের হওয়ার তেমন প্রশস্ত কোনো রাস্তা ছিল না। বাড়িটি থেকে বের হয়েই রেললাইনের ওপর দিয়ে যাতায়াত করতে হয়। সেখানে কোনো সড়কের সঙ্গে সংযোগ নেই।

বস্তিবাসীরা জানিয়েছেন, বস্তি ঘিরে গড়ে ওঠা সেই বাড়িটিতে বেশ সমস্যা ছিল। বস্তির পাশেই বাড়িটি হওয়ায় সেখানে প্রধান সড়কে বের হওয়ার মতো সংযোগ সড়ক নেই। কারণে ওই বাড়ির মালিক চাইতেন না বস্তিটি এখানে থাকুক। বস্তিবাসীরা আরও জানিয়েছেন, জায়গার মালিক বস্তি ভেঙে ভবন করার কথা আগুন লাগার আগে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন। তবে জমি নিয়ে তাদের ভাইদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে।

মোল্লাবাড়ির বস্তিতে আগুনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব নাজমা বেগম। এই ভুক্তভোগী ঢাকা টাইমসকে জানান, যখন আগুন লাগে তখন তিনি ঘরের মধ্যে দুই মাসের শিশুকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন। হঠাৎ শিশুটির কান্নায় তার ঘুম ভাঙে। ঘুম থেকে উঠেই দেখেন মাথার ওপর ঘরের চালে আগুন জ্বলছে। মুহূর্তের মধ্যেই শুধুমাত্র শিশুটিকে নিয়ে দৌড়ে বের হতে পেরেছেন তিনি। - মিনিটের মধ্যেই আগুন বস্তির চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।

ক্ষতিগ্রস্ত একাধিক বস্তিবাসী ঢাকা টাইমসকে জানিয়েছেন, প্রতিটি ঘর ফিট বাই ১০ ফিটের মতো ছিল। বস্তির প্রতিটি ঘর থেকে ভাড়া তোলা হতো সাড়ে হাজার টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্ত। তারা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে বস্তিবাসীকে উচ্ছেদের জন্য কেউ আগুন লাগিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বছরে সারাদেশে বস্তিগুলোতে ৪২৭টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ২০ জন। বস্তির আগুনে এই তিন বছরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ কোটি ৩৩ লাখ ৬৭ হাজার ৭৯৮ টাকা।

ঢাকা টাইমসের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীর বেশিরভাগ বস্তি ঘিরে মাদকের আস্তানা গড়ে ওঠে। বেশিরভাগ বস্তিতেই মাদকের একাধিক সিন্ডিকেট থাকে। তাদের মধ্যে প্রায়ই বিভিন্ন দ্বন্দ্বে হতাহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও বস্তি নিয়ন্ত্রণে থাকে স্থানীয় পর্যায়ের সন্ত্রাসীসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের। এদের নিয়ন্ত্রণে বস্তিতে গড়ে ওঠে মাদক, জুয়া আর রঙ্গলীলার আখড়া। রাতভর বস্তির কিছু অংশ থাকে বেশ জমজমাট। নগরীর যেসব বস্তিতে আগুন লাগে, তার কিছুদিন পরই ওইসব বস্তির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় অন্যের হাতে। সবকিছু দেখেও এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে পারেন না অসহায় বস্তিবাসীরা। কারণ কেউ মুখ খুললে তাদের ওপর শুরু হয় নির্যাতন। রাজধানীর বস্তিগুলো ঘিরে কোটি টাকার ছড়াছড়ি চলে। কারণ হিসেবে দেখা যায়, ঘন বসতি হওয়ায় মাদকের আস্তানা হয় বস্তিগুলোতে। বস্তি নিয়ন্ত্রণে সিন্ডিকেটের মধ্যে বিভিন্ন দ্বন্দ্বে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটে। আর এসব নিয়ে দ্বন্দ্বের পরপরই বস্তিগুলোতে আগুন লাগে। তবে এর সুরাহা হয় না কখনই।

গত বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে আগুনে লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিটের ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার কুনিপাড়া বস্তিতে গত বছর ১৩ মার্চ সন্ধ্যায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট আগুন পুরোপুরি নেভাতে কাজ করে। বস্তিতে সহস্রাধিক ঘর ছিল সেখানে। সেখানে পোশাককর্মী, রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রিসহ নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করেন। বস্তিটিতে প্রায় ২০ হাজার লোক বসবাস করতেন।

এছাড়া, গত বছর আরও কয়েকটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার পর আগুন লাগার কারণ হিসেবে তেমন কোনো তথ্য সংশ্লিষ্টদের তদন্তে বের হয়ে আসে না। এতে করে প্রতিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হন বস্তিতে বসবাস করা নিম্ন আয়ের মানুষরা। হয় না শুধুই প্রতিকার।

(ঢাকাটাইমস/১৭জানুয়ারি/এইচএম/বিবি)

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
কসবায় ৭০ লাখ টাকার ভারতীয় চশমা জব্দ
লিটারে ১ টাকা কমল সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম
নারী সংস্কার কমিশন মানি না, বাধ্য করলে আন্দোলন: জামায়াত আমির
এবার চিন্ময়ের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, শুনানি রবিবার
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা