দিনাজপুরে বট-পাকুড়ের বিয়ে, পাঁচ হাজার অতিথি আপ্যায়ন
চারদিকে ঢাক-ঢোল আর সানাইয়ের সুর, উলুধ্বনিও দিচ্ছেন নারীরা, মন্ত্র পাঠ করছেন পুরোহিত। এভাবেই আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলো ব্যতিক্রমী বট-পাকুড়ের বিয়ে অনুষ্ঠানের।
বিয়ে উপলক্ষে পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে ছাঁদনাতলা, রং বেরঙের আলোকসজ্জা, আলপনা ও সুসজ্জিত গেট সবই ছিল। আপ্যায়ন করানো হয়েছে পাঁচ হাজার অতিথিকে। আমন্ত্রিত অতিথি, স্থানীয় এলাকাবাসী আর সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্তদের উপস্থিতিতে জাকজমকপূর্ণভাবে বিয়ে দেওয়া হয় বট ও পাকুড় গাছের।
বিয়ের আয়োজক দিলীপ ঘোষ বলেন, প্রকৃতি ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অমঙ্গল থেকে রক্ষায় পৌরাণিক বিশ্বাস থেকে বট আর পাকুড় গাছের বিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এর মূল উদ্দেশ্য অশ্বত্থাদি বৃক্ষ বটেশ্বরি ও পাকুড়েশ্বর প্রতিষ্ঠা করা।
ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সনাতন ধর্মালম্বীদের যেভাবে বিয়ে হয়, সেভাবে বট-পাকুড়ের বিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
আজ বুধবার (১৭ জানুয়ারি) দিনাজপুর শহরের বাসুনিয়াপট্টি শ্রী শ্রী দুর্গা মন্দির প্রাঙ্গণে ব্যতিক্রমী এ বিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিয়ে পড়ানোর জন্য নিয়োজিত ছিলেন ৫ জন পুরোহিত।
অনুষ্ঠানের শুরুতে সকাল ৬টায় অধিবাস, ১০টায় নারায়ণ পূজা, দুপুর দেড়টায় মধ্যাহ্ন প্রসাদ বিতরণ এবং দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিয়ে ও যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সন্ধ্যা ৬টার পর শুরু হয় কবি গানের অনুষ্ঠান।
এর আগে মঙ্গলবার গায়ে হলুদের মাধ্যমে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুর করা হয়।
বর হলো পাকুড়গাছ, পিতা দিলীপ ঘোষ, মাতা দীপ্তি ঘোষ, ঠিকানা চকবাজার, সদর, দিনাজপুর। আর কনে কুমারী বটগাছ, পিতা মুন্না সাহা, মাতা পুর্নিমা সাহা, ঠিকানা চকবাজার, সদর, দিনাজপুর। অতিথিদের দেওয়া নিমন্ত্রণপত্রে এভাবেই বর কনের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে।
কনে পিতা মুন্না সাহা ও মাতা পুর্নিমা সাহা, বিয়ে ঘিরে আমরা বেশ আনন্দ-উল্লাস করছি। ধর্মীয় গুরু সঙ্গীত কুমার সাহা বলেন, 'শাস্ত্র মতে ধর্ম বৃক্ষ বট ও পাকুড়ের বিবাহ দর্শন মাত্রই মঙ্গল।' এই বিয়ের অনুষ্ঠানে গায়ে হলুদসহ শাস্ত্র মতে সকল আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
গাছের বিয়ের বিষয়ে দিনাজপুর নাট্য সমিতির সভাপতি চিত্ত ঘোষ বলেন, প্রকৃতি ও ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় বট-পাকুড়ের বিয়ে দেওয়া হয়।
এদিকে ব্যতিক্রমী এই বিয়ের অনুষ্ঠানটি এলাকায় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। ভক্তরা পূজা-অর্চনা ও আনন্দ- উৎসবে মেতে ছিলেন সারাদিন।
সরজমিনে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, মুখোশ, ধূতি ও পাঞ্জাবি পরিয়ে পাকুড় গাছকে বরের সাজ দেওয়া হয়েছে। আর পাশের বটগাছটিকে মুখোশ এবং শাড়ি পরিয়ে কনের সাজে সাজানো হয়েছে। মন্দির প্রাঙ্গণে বরযাত্রীদের জন্য তৈরি করে হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল। বিয়ের অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ খেতে এসেছিলেন কয়েক হাজার অতিথি। সবজি-পোলাও, আলুভাজি, ডাল ও পায়েস খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয় তাদের।
বিয়েতে প্রায় ৫ হাজার অতিথিকে আপ্যায়ন করানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন, রান্নার কাজে নিয়োজিত বাবর্চিদের প্রধান নারায়ণ চন্দ্র অধিকারী।
তিনি বলেন, 'ভোর থেকে ১৪ জন বাবর্চি ও আমাদের সহকর্মীরা এই রান্নার কাজ করেছে।'
বিরল উপজেলার তেঘেরা থেকে আসা সতিশ চন্দ্র বর্মণ বলেন, 'আমি এ যাবত শুধু শুনেই আসছি যে বট আর পাকুড় গাছের বিয়ের কথা। আজকে দেখলাম। সনাতন রীতিনীতি মেনেই এই বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি। ’
রাণীগঞ্জ ঝাঞ্জিরা থেকে আসা মানিক চন্দ্র বলেন, ‘মুই ছোট থাকিতে একবার বট-পাকুড়ের বিয়া দেখিছুনু কিন্তু আগের কথা খেয়াল নাই। আবার আইজকা দেখুনু।’
বিয়েতে আসা সবিতা রানী বলেন, ‘বট-পাকুড়ের বিয়ে দিলে আমাদের ধর্মীয়ভাবেই একটা পুণ্য লাভ হয়। অনেকেই আবার ছেলে বা মেয়ে সন্তান লাভের আশায় এই বিয়ে দেয়। অনেক আগে থেকে এই বিয়ের প্রথা চলে আসছে। ’
ঘোড়াঘাট উপজেলা থেকে আসা হরিতোষ কুমার বলেন, ‘বট-পাকুড়ের বিয়ে হবে এটা শোনার পর থেকেই অনেক কৌতূহল ছিল মনের মধ্যে। আগে অনেকবার শুনেছি বট-পাকুড়ের বিয়ের কথা। কিন্তু এই প্রথমবার নিজ চোখে বিয়ে দেখলাম।’
(ঢাকাটাইমস/১৭জানুয়ারি/প্রতিনিধি/পিএস)।