অধরা বাজার সিন্ডিকেট ধরার উপায় কী!

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
 | প্রকাশিত : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৫:৪৩

নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে তিনি বলেছেন যে, আগামী জুন-জুলাই মাস থেকে সিন্ডিকেট থাকবে না। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ বেশ জোরালো বলে মনে হয়েছে। তিনি দায়িত্ব নিয়েই এর আগে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন যে- ১৯শে জানুয়ারি শুক্রবার থেকে বাজারে এর প্রভাব দেখা যাবে। কিন্তু ঢাকার বাজারে তো নয়ই, দেশের কোথাও সিন্ডিকেটের প্রভাব কমার লক্ষণ কেউ দেখেনি। অধিকন্তু চালের দাম কেজি প্রতি মানভেদে কয়েক টাকা করে বেড়েছে। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন, চারদিনের মধ্যেই চালের দাম কমে আসবে। বাজার সংশ্লিষ্টরা তেমনটি খুব বেশি দেখেননি। এভাবে একটি দুটি করে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি নিয়ে দেশের বাজার সিন্ডিকেট সম্পর্কে ধারণার কোনো কুল কিনারা পাওয়া যেমন সম্ভব নয়, সেভাবে কিছু হওয়ারও আশা করা যায় না।

বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর সিন্ডিকেট সাম্প্রতিক কোনো প্রবণতা নয়। এটা বেশ পুরাতন বাজার রোগ- যার কোনো চিকিৎসা মোবাইল কোর্ট নামিয়ে কিংবা ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তাদের তদারকিতে নামিয়েও খুব একটা কিছু করতে পেরেছেন তেমন অভিজ্ঞতা আমাদের হয়নি। রমজান, কোরবান ও পালা-পার্বণকে সম্মুখে রেখে এদেশের ব্যবসায়ীরা বাজারে চাহিদা রয়েছে এমনসব পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বছরের বাড়তি আয় উপার্জন করে নেন বলে অভিযোগ আছে। অথচ দুনিয়ার বেশিরভাগ দেশেই উৎসব উপলক্ষ্যে বাজারে মূল্যছাড়ের রীতি বেশ জনপ্রিয় একটি নিয়ম হয়ে গেছে। যেহেতু চাহিদা বেশি থাকে তাই সরবরাহ বাড়িয়ে ব্যবসায়ীরা কম মুনাফাতেও ভালো ব্যবসা করে সন্তুষ্ট থাকেন। কিন্তু আমাদের এখানে বিষয়টি উল্টোভাবেই চলছে। এখন উৎসব পালা-পার্বণের বাইরেও সারা বছরই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নিয়ে এমন সব কাণ্ডকীর্তি চলে যা উন্নত দুনিয়ার ব্যবসায়ীদের কল্পনাতেও আসবে না। দুনিয়ার কোথাও কোনো কিছুর দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বাজারে সেই পণ্যের দাম ব্যবসায়ীরা বাড়িয়ে দিতে কিংবা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে মোটেও দ্বিধা করেন না। পণ্যটি যদি হয় নিত্যপ্রয়োজনীয় তাহলে তো কথাই নেই। ছোটো বড়ো ব্যবসায়ী পর্যন্ত মুহুর্তের মধ্যেই মোবাইলে দাম পাস করে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলাদেশে সেটির দাম এক হয়ে যায়।

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে এমন খবর মিডিয়ায় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিতে কারো কোনো অজুহাতের শেষ থাকে না। সে কারণেই বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশের বাজারে ডান হাত, বাম হাত, কালো হাত, অজুহাত-এর কোনোটারই অভাব হয় না। আবার কোনো কিছুর দাম কমে গেলে বাজারে দাম কমার কোনো লক্ষণ কেউ দেখে না। এইসব প্রবণতা এখন আমাদের গোটা বাজার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলেছে। বাজারে হেন কোনো জিনিস নেই যার কোনো দাম স্থির থাকবে এমনটি নিশ্চিত করে বলা যাবে। কয়েক মাস আগে ডিমের দাম বাড়ানো নিয়ে যা ঘটেছে তা সবাইকে হতবাক করেছে। অথচ বাংলাদেশে ডিম উৎপাদনে কোনো অভাব নেই, বাজারেও ঘাটতি নেই। কিন্তু ডিমের বাজার যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারা মোবাইল ম্যাসেজেই সারা দেশে ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করেছেন। মুরগির দাম নিয়েও তাই ঘটেছে। আলু এবার মানুষকে বেশ বেকায়দায় ফেলেছে। কোল্ড স্টোরেজে আলু মজুদ রেখে বাজারে এর দাম নিয়ন্ত্রণ করেছে। এরকম সব পণ্যসামগ্রী নিয়েই নানা রকম সিন্ডিকেট বাজারে প্রভাব বিস্তার করেছে বলে গণমাধ্যমে নিয়মিত শোনা যাচ্ছে। শুক্রবারে দেশের সবকটি গণমাধ্যমে অন্যতম প্রধান খবর থাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর বাজার মূল্য। কোনো টিভি চ্যানেলে পণ্যের যদি কোনো একটি দামের কথা উল্লেখ করা হয়, সেটি গ্রামের বাজারেও তখনই নির্ধারিত হয়ে যায়। সেখানেও একই প্রবণতা।

দাম বাড়লে সবাই বাড়ায়, কিন্তু দাম কমলে কেউ কমায় না। পৃথিবীর আর কোনো দেশের গণমাধ্যমে এভাবে বাজারমূল্যের খবর দেয় কি না জানি না। তবে আমাদের এখানে যে খবর প্রচারিত হয় সেই মূল্যটি কোনো একটি বাজারের ব্যবসায়ীদের দেওয়া, সরকারি কোনো সংস্থার নয়। সরকারি কোনো সংস্থাই কাচা বাজারের কোনো মূল্য নির্ধারণ করে না, সেটি করা সম্ভবও নয়। তবে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রীর দাম নির্ধারণ করা সম্ভব হলেও বাজারে সেটির দেখা মেলে না। সুতরাং বাজার সিন্ডিকেট এখন এতটাই বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে গেছে যে, এর নিয়ন্ত্রণ বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বা খাদ্যমন্ত্রী চাইলেই করতে পারবেন সেটি বোধহয় দুরাশার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কর্পোরেট হাউজ ব্যবসার জগতে হেন কিছু বাকি রাখেনি যেখানে তাদের প্রভাব বাহ্যিকভাবে দেখা না গেলেও ভেতরে ভীষণভাবে কার্যকর বলে গণমাধ্যমে মাঝেমধ্যে শোনা যায়। বর্তমান সরকারের জন্য বাজারব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কোনো বিকল্প নেই।

নির্বাচনি ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ গঠনেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন মুখের স্থান করে দিয়েছেন। সে কারণে অনেকে আশা করছে যে, বর্তমান মন্ত্রিসভা জটিল এই সমস্যাটির সমাধানের উদ্যোগ নেবে, সফলও হবে। মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও সচেষ্ট আছেন। কয়েকবার দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে কথা বলেছেন। এখন দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রীদের অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে বাংলাদেশের বাজারে যেসব অনিয়ম, মজুদতদারি, একচেটিয়া কারবারি এবং বাজারকে অস্থিতিশীল করার মতো নেপথ্য শক্তি-অপশক্তি ক্রিয়াশীল রয়েছে সেগুলো আগে চিহ্নিত করা। সেটি শুধুমাত্র কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক করলে হবে না, তা অতীত ও বর্তমান অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়ে গেছে। প্রতিটি পণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ নিয়ে কোথায়, কে, কীভাবে কারসাজি করছে, গুদামজাত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে সেসবের ওপর গবেষণা হওয়া দরকার। নানা সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা যেমন রয়েছে, একইভাবে দেশে বহুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান, ইন্সটিটিউট ও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেগুলোর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দ্বারা মাঠ জরিপ করার ব্যবস্থা করা হলে অনেক তথ্যই হয়তো উন্মোচিত হবে যেগুলোতে হাত না দেওয়া পর্যন্ত ঐসব পণ্যের সরবরাহ এবং চাহিদার প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হবে না। সেজন্য এডহক ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থার দাওয়াই দিয়ে কোনো বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার কল্পনা করে লাভ নেই। অর্থনীতির সব সূত্রই বাংলাদেশে কতটা কাজে লাগে তা মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানের মাধ্যমেই কেবল বোঝা যেতে পারে। দেশে মুক্ত বাজার অর্থনীতি থাকলেও এর আইন, নিয়মকানুন সর্বত্র কার্যকর নয় যে, সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না।

দুর্নীতি এখানে সর্বগ্রাসী একটি ব্যাপার। সরকারি সংস্থা সবসময়ই লোকবলের অভাব থাকার কথা বলে থাকে। হয়তো তাদের লোকবলের সংকটের বিষয়টি সঠিকও হতে পারে। কিন্তু যারা আছে তারা কতটা দুর্নীতির ছিদ্রগুলো চিহ্নিত করতে পারেন, তাদের আন্তরিকতা, স্বচ্ছতা ও সততা কতখানি রয়েছে সেটিও একটি মৌলিক বিষয়। তাছাড়া কেউ আন্তরিকভাবে কাজ করলেও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বাজার তদারকির কার্যক্রম দুর্বল করেও দিতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতা তেমনটিই বলে। সুতরাং বাজার সিন্ডিকেট ভাঙার বিষয়টি এখন মোটেও সহজ পর্যায়ে নেই। জটিল সব অনিয়ম এবং অপশক্তির কর্মকাণ্ড এখানে এমনভাবে যুক্ত হয়ে পড়েছে যা বাহির থেকে বোঝা বেশ কষ্টকর। দেশে ধানের উৎপাদন প্রতিবছরই আশাতীত ভালো হচ্ছে বলে দাবি করা হচ্ছে। আউশ, আমন, বোরো মিলিয়ে তিনবার বছরে ধান উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু কৃষকদের বড়ো অংশই বাজারে যে মূল্যে ধান বিক্রি করে তাতে তাদের উৎপাদন খরচ মেটানোও সম্ভব হয় না। অথচ কৃষকদের হাত থেকে আড়তদার, মজুতদার এবং আরো অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী ধান কিনে বেশি লাভের আশায় জমা করে রাখে। বাজারে কর্পোরেট হাউজের কোনো কোনো সংস্থা এইসব ধান কম মূল্যে ক্রয় করে মজুত রাখার মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। চাতাল মালিকদেরও অনেকেই মজুতদারির পাশাপাশি চালের সরবরাহ ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ করারও কথা শোনা যায়। মাঠ পর্যবেক্ষণ করলেই এইসব অভিযোগের সত্যাসত্য জানা যেতে পারে। এরপরই কেবল বাজারে ধান ও চালের সরবরাহ এবং মূল্য নির্ধারণ রাখা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে এত বছরেও আমরা ধান এবং চালের উৎপাদক, ব্যবসায়ী, ফড়িয়া, মজুতদার এবং বাজারে চাল ব্যবসায়ীদের ব্যবসায় কার কত অংশ লাভ থাকা প্রয়োজন, বাজার সরবরাহ রাখা-না রাখায় কার কী ভূমিকা সেই তথ্যই আমরা উদ্ঘাটন করতে পারছি না। ফলে চালের বাজার দর কখনো কখনো অস্বাভাবিক গতিতে বাড়িয়ে দিয়ে উপরের ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে। সাধারণ ভোক্তাগণ উচ্চমূল্যে চাল কিনতে বাধ্য হচ্ছে। তাছাড়া মিলারগণ মোটা চাল কেটে চিকন চাল বানানোর যে অভিযোগ রয়েছে সেটি কেন ধরা যাচ্ছে না ? এভাবে মোটা চাল কেটে সরু চাল বানানোর বিষয়টি বড়ো ধরনের অপরাধ। এটি বিজ্ঞানসম্মত নয়, খাদ্যের পুষ্টিমান কমানোর কারসাজিও বটে। অন্যদিকে কাটা সরু চালের বাজারমূল্য অনেক বেশি যা প্রতারণার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টরা করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় যা খুশি তা করার যে ধারা চালু করে এসেছে সেটি ভাঙার উপায় কী?

আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের এ পাড়ে যে পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, ও-পাড়ে সেই পণ্যের দাম বাড়ার কোনো নজির নেই, দামও যথেষ্ট কম। এর কারণ হচ্ছে ভারতে গোটা বাজার ব্যবস্থা কয়েক যুগ ধরে বিশেষ একটি কমিশন দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে। প্রতিটি ব্যবসায়ী কমিশনের আইন, নিয়মকানুন মেনে ব্যবসা করতে বাধ্য। কোনো পণ্যের দাম ব্যবসায়ী ইচ্ছে করলে বৃদ্ধিও করতে পারবে না, মজুতদারিও করা সম্ভব নয়। যেকোনো পণ্যের দাম কমিশন যেভাবে নির্ধারণ করবে তাতে খুচরা পর্যায় পর্যন্ত সকলেরই লাভের অংশ নির্ধারিত থাকে। কারোই লস করার যেমন কারণ নেই, অতিরিক্ত লাভ করারও তেমন সুযোগ নেই। ফলে সে দেশের বাজার নিয়ে সরকারের কোনো দায়-দায়িত্ব কিংবা স্বস্তি-অস্বস্তির ব্যাপার নেই। গোটা বাজার ব্যবস্থাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে কমিশন দ্বারা। আমাদের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী ভারতের বাজারমূল্যের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নিশ্চয়ই অবহিত আছেন। প্রতিবেশী ভারত যুগ যুগ ধরে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হলে আমরা কেন চেষ্টা করবো না? সেই চেষ্টাটা হতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক আইন, নিয়মকানুন প্রয়োগের মাধ্যমে। আমাদের বাজার ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খল করার জন্য তেমনি প্রতিষ্ঠান ও আইন দ্বারা পরিচালিত হওয়ার ব্যবসা পদ্ধতি কার্যকর করা অপরিহার্য।

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী: ইতিহাসবিদ, কলাম লেখক ও সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :