সরকার ও মাননীয় এমপি মহোদয়দের প্রতি বিনম্র নিবেদন

হামিদুর রহমান লিটন
 | প্রকাশিত : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ১১:৪১

সদ্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আগের একই সরকার হলেও সম্পূর্ণ নতুন প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ একটি সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে তারা আবার নতুন শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। দুএকটি আসনে ইলেকশন ছাড়া প্রায় সকল আসনেই এখন নতুন এমপি নির্বাচিত হয়েছে। জাতীয় সংসদের নির্ধারিত ৩০০ আসনের বাইরে সংরক্ষিত ৫০ নারী আসনের সিলেকশনের কাজ এখন প্রক্রিয়াধীন। খুব দ্রুতই ৩৫০ জন এমপির পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠবে আমাদের জাতীয় সংসদ। সন্দেহ নেই, আগামী পাঁচ বছর এই এমপিগণই আমাদের জাতীয় সংসদকে প্রাণবন্ত ও সজীব করে রাখবেন। এবার যারা এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাদের সবাইকে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতে চাই। কীভাবে এমপি হয়েছেন সে বিতর্কে আমি যাব না- সেটা আমার আলোচনার বিষয়ও না। কারণ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমার বিন্দুমাত্রও সক্রিয়তা নেই। আর সত্যি কথা বলতে গেলে, ব্যক্তিগতভাবে আমি এ দেশের বর্তমান রাজনীতিকে পছন্দও করি না। যদিও এটা সম্পূর্ণতই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। রাজনীতিকে পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপারটি আমার ক্ষেত্রে নানা কারণেই হতে পারে। আমি সেদিকে আমার আলোচনার মোড় ঘুরাতে চাই না।

আমি একজন অত্যন্ত নগণ্য মানুষ। জানি আজকের এই কলামে লেখা বিষয়গুলোর আলোচনা নিয়ে কারো কিছু যায় আসে না- সেটা কারো কিছু ‘যায়-আসে’র মতো ব্যাপারও নয় অবশ্য। তবু আমার মনের খেদ থেকে এবং কিছুটা মানবিক দায় থেকে এখানে কিছু কথা বলতে চাই। বলা যায়- ‘বলতে চাই’ও নয়- একরকম আরজি জানাতে চাই। হয়তো আমার এই আবেদন-নিবেদন মাননীয় এমপি মহোদয়দের কর্ণকুহর পর্যন্ত পৌঁছাবে না। সেটা না পৌঁছাক, তাতে আমার কিছু করার নেই- শুধু আফসোস ও দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া। যাহোক, এখন তো চিঠি লেখার প্রচলন প্রায় ওঠেই গেছে- তবু আমি আমার এই লেখায় একটি খোলাচিঠির কাঠামোগত আকারে, অনেকটা বিনীত আবেদন নিমিত্ত কিছু আরজি পেশ করছি।

সদ্য সমাপ্ত হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আপনারা এমপি হতে কত পরিশ্রম, কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করেছেন তা দেখে অনেকের মতো আমারও কষ্ট লেগেছে। সবকিছুর পরেও আপনারা এমপি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন- এটা কম কথা নয়, কম প্রাপ্তিও নয়। তাই আমি বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ জানাতে চাই- সুযোগ যেহেতু পেয়েছেন জনসেবা করার, এমনভাবে সেবা করুন যাতে ভবিষ্যতে আর ভোটের জন্য কারও কাছে হাত পাততে না হয়। কোনো টাকা-পয়সাও যেন খরচ করতে না হয়। মনে রাখার মতো উন্নয়ন করুন যাতে ভবিষ্যতে ভোটাররা আপনাকে ছাড়া অন্য জায়গায় ভোট দিতে হাত কাঁপে।

আমি দেখেছি আপনারা নির্বাচনের প্রায় এক মাস আগে থেকে ঘোরাঘুরি শুরু করেছেন। নিরলসভাবে মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়েছেন। বাদ যায়নি কৃষক, শ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, মুচি-মেথর কেউ-ই। কেউ কেউ সকাল ৮টায় বের হয়েছেন আর বাসায় ফিরেছেন মধ্যরাতে।

সবিনয়ে বলতে চাই, এই ঘোরাঘুরিটার ধারাবাহিকতা ইলেকশনের পরেও কিছুটা অন্তত রাখবেন। সপ্তাহে একদিন না পারলেও অন্তত মাসে একদিন আপনার আসনের বিভিন্ন প্রান্তে যান। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনেন। নিজ চোখে দেখেন রাস্তাঘাটের অবস্থা। যেখানে পুল-কালভার্ট লাগবে এর ব্যবস্থা নিন। নিজের টাকা খরচ করতে হবে না। সরকারি দপ্তরে চিঠি চালাচালি করে অর্থ বরাদ্দ আনুন।

কাজ আনার পর কন্ট্রাক্টর ঠিকমতো কাজ করছে কি না খোঁজ রাখুন। নির্বাহী প্রকৌশলী ঠিকমতো তদারকি করছে কি না দেখুন। সম্ভব হলে নিজে গিয়ে দেখুন কেউ চাঁদা দাবি করছে কি না। অথবা রডের বিপরীতে বাঁশ ব্যবহার করছে কি না। সর্বোপরি দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন। তার প্রতিদান একসময় নিশ্চয়ই মিলবে। চাঁদাবাজ আপনার দলের লোক হলেও কোনোভাবেই তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। মনে রাখবেন চাঁদাবাজ বা অসৎ লোকের কথায় আপনাকে কেউ ভোট দেয়নি। জোর করে ভালোবাসা আদায় করা যায় না।

চলার পথে দেখি যত্রতত্রই চাঁদাবাজি হচ্ছে। যেমন একটা অটোরিকশা এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যেতে ১০-২০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। আর এই চাঁদাবাজিটা করে ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে। ক্ষেত্রবিশেষে এমপি সাহেবের নামই বিক্রি করা হয়- কারণ এতেই বেশি সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। বলা হয়, এসব টাকা এমপি সাহেবকে ভাগ দিতে হয়। যাদের চোখ কান খোলা, চলার পথে জ্ঞান রাখে এমন কিছু লোক হয়তো এসব বিশ্বাস করবে না। কারণ যে লোক শত কোটি টাকা খরচ করে এমপি হয়েছেন- তিনি ফকিরের এই ১০-২০ টাকা নিতে বসে থাকেন না। কিন্তু অধিকাংশ সাধারণ মানুষ ধরে নেয় বা যা রটে তা কিছুটা হলেও ঘটে। এতে আপনাদের প্রতি মানুষের বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। একটা উদাহরণ দিলে পরিষ্কার বুঝা যাবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের সানারপাড় থেকে গুলিস্তানের বাস ভাড়া ৩০ টাকা। একই রোডের সানারপাড় থেকে বকশীবাজার পর্যন্ত বাস ভাড়া ২০ টাকা। অথচ রাস্তা প্রায় দেড় কিলোমিটার আরো বেশি।

এক বাস ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বকশীবাজারের ভাড়া কম হওয়ার রহস্য কী। সে বলল বকশীবাজার যাওয়া গাড়িগুলোকে গুলিস্তানের চাঁদাবাজির শিকার হতে হয় না। এই জন্য ভাড়া ১০ টাকা কম। এটা শুধু এক জায়গার উদাহরণ মাত্র। এসব ঘটনা সারা দেশেই ঘটছে। সারা দেশেই এমপি মহোদয়রা আছেন। প্রশাসনের লোক আছেন। তারপরও এসব অনৈতিক কাজ চলছে হরহামেশাই সকলের চোখের সামনে। মনে রাখবেন- প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে এগুলো বন্ধ করা আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব। আপনারা মন থেকে চাইলে এটা আপনাদের পক্ষে অসম্ভব কিছু না।

এমপি মহোদয়রা মাসে অন্তত একবার উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করবেন থানার মানুষ কী রকম চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকমতো অফিস করছে কি না। নাকি হাসপাতালকে চেম্বার বানিয়ে রোগীদের থেকে টাকা-পয়সা নিচ্ছে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে কর্মকর্তারা কী কী সমস্যার সম্মুখীন হন। তাদের হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সামগ্রী আছে কি না। হাসপাতালের যন্ত্রপাতিগুলো সব ঠিক আছে কি না। অথবা সমস্যাগুলো সমাধানে আপনার কী কী সাহায্য প্রয়োজন।

অন্তত একবার এসিল্যান্ড সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন মানুষ কেমন সেবা পাচ্ছে। দুএকজন জমি মিউটেশনকারীকে গোপনে জিজ্ঞেস করুন জমি মিউটেশন করতে কোনো টাকা লেগেছে কি না। অথবা এই কাজ করতে কোনো হয়রানির শিকার হয়েছে কি না। প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করে যদি দেখেন মানুষ হয়রানির শিকার হয়েছে, তাহলে অনুসন্ধান করে দেখুন কার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। প্রকৃত দোষীকে খুঁজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করুন।

থানার ওসি সাহেবকে কড়া ভাষায় বলুন আপনি এই থানায় কোনো মাদক ব্যবসা দেখতে চান না- কোনো মাদকাসক্ত ব্যক্তি দেখতে চান না। দেখবেন এক সপ্তাহে আপনার আসনে কোনো মাদক ব্যবসা থাকবে না এবং মাদকাসক্ত লোকের সংখ্যাও কমতে কমতে শূন্য ডিজিটে নেমে আসবে। অর্থাৎ থানার সকল মাদক স্পটের খবর ওসি সাহেবরা জানেন। কিন্ত ক্ষেত্রবিশেষে দেখা যায় তারা যদি মাদক পণ্য বিক্রির অপরাধীকে গ্রেপ্তারও করেন তখন ওপর মহল থেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে ফোন আসে। তখন ওসি সাহেব অসহায় হয়ে পড়েন। অপরাধীকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। এই ওপর ঐ উঁচু মহলের নাম আর পুলিশ কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেন না, কারণ নিজেরও তো ভয় আছে কখন ট্রান্সফার করে দেয়।

আপনার সংসদীয় আসনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর খোঁজখবর নিন। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় মাঝেমধ্যে যান। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলুন। তাদের অভাব-অভিযোগ শুনুন। অবকাঠামোগত কোনো উন্নয়ন প্রয়োজন হলে যথাসাধ্য সহায়তা করুন। এলাকার বখাটে ছেলেদের শোধরাতে কনসালটেন্সির ব্যবস্থা করুন। তাদের সুপথে আনুন।

এমপি মহোদয়দের বলছি, আপনারা টাকার পেছনে ছোটাছুটি করবেন না। কারণ টাকাই মানুষের জীবনে সবকিছু নয়। টাকা দিয়ে মানুষের ভালোবাসা কেনা যায় না। আর যদি কেনাই যেত তাহলে টাকার কুমির কিছু প্রার্থী ফেল করতো না।

ইলেকশনের আগে যেরকম টাকার ঝনঝনানি দেখছি তাতে মনে হয়েছে আপনারা অনেকেই শতকোটি বা হাজার কোটি টাকার মালিক। বাকি জীবনে আর টাকা ইনকাম না করলেও আপনাদের খাওয়া পরায় কোনো অসুবিধা হবে না।

দেখেন একটা মানুষের বেঁচে থাকতে ২-৩ কোটি টাকার বেশি লাগে না। সেই জায়গায় আপনারা হাজার কোটি টাকার মালিক। একটা মানুষের লন্ডনে গিয়ে অসংখ্য বাড়ি কেনার কোনো দরকার নেই। দেশের হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার কোনো দরকার নেই। আসলে প্রকৃত অর্থে আমাদের দেশের মতো সুজলা-সুফলা ও সুখী-সমৃদ্ধ দেশ পৃথিবীতে খুব কমই আছে। কারণ বিশে^ এমন দেশও আছে যেখানে বছরের অধিকাংশ সময়ই বরফ আচ্ছাদিত থাকে। অসহনীয় ঠান্ডায় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে কাজ করতে হয় তাদের। আবার অনেক দেশ আছে উত্তপ্ত মরুভূমি। তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সুপেয় পানি সহজলভ্য নয় সেখানে। লোকসংখ্যাও কম। শ্রমিক সংকট। সেখানে ফসল ফলানো বা আরামদায়কভাবে বেঁচে থাকা খুবই কষ্টকর। অথচ আমাদের দেশে এর কোনোটাই নেই। যেমন তীব্র শীতও পড়ে না আবার প্রচণ্ড গরমও পড়ে না। তাই বলি দেশটাকে ওভাবে গড়ে নিন যাতে আপনাদের বিদেশ যাওয়া না লাগে। বিদেশিরা এদেশে আসাটাকে স্বপ্ন মনে করে। ভেবে দেখুন সবকিছু পড়ে থাকবে আপনি এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নেবেন। তাই মরার আগে এমন কিছু করে যান যেন আপনি মরে গেলেও মানুষের মনের মধ্যে অমর হয়ে থাকেন।

ইলেকশনের আগে প্রতিটি মিটিংয়ে বলেছেন- আল্লাহ আমাকে অনেককিছু দিয়েছেন আর দরকার নেই। আমি এখন আপনাদের সেবা করতে চাই; একটিবার সুযোগ দেন। মানুষ তাদের কথা রেখেছে, আপনাকে সুযোগ দিয়েছে। এবার আপনিও আপনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। সর্বোপরি দেশকে ভালোবাসেন, দেশের মানুষকে ভালোবাসেন। মানুষকে ভালোবাসতে জানলে আর কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। এভাবে যদি সরকারের সকল মন্ত্রী ও সকল এমপি সাহেব আন্তরিকভাবে কাজ করেন তাহলে দেশটাকে নরক থেকে স্বর্গে পরিণত করা অসম্ভব কোনো কাজ নয়। মনে রাখবেন- ব্যাপক দুর্নীতি ও বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের মাধ্যমে আপনাদের পূর্বসূরিদের মধ্যে অনেকেই এ সুজলা-সুফলা ও সুখী-সমৃদ্ধ সুন্দর এ দেশটাকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে। প্রমাণ করুন আপনারা কেউ তাদের মতো নন। আপনারা এ দেশটাকে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলুন।

হামিদুর রহমান লিটন: লেখক ও সংবাদকর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :