হোয়াইট স্পট ভাইরাসের জিনোম বিন্যাস উন্মোচন

আকিজ মাহমুদ, চবি
 | প্রকাশিত : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:৫২

দেশের রপ্তানি আয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস চিংড়ি খাত। এই চিংড়ির অন্যতম শত্রু বলা হয়ে থাকে হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসকে। এই ভাইরাসের আক্রমণের ৩-৭ দিনের মধ্যেই ওই স্থানের সব চিংড়ি মারা যায়। এই ভাইরাসের নেই কোনো সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক। ভাইরাসটির জিনোমের কোনো তথ্যও দেশের কারও জানা নেই।

সম্প্রতি দেখা গেছে, এই ভাইরাসের ব্যাপক আকারে প্রকোপের জন্য দায়ী নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট এবং তা প্রথমবারের মতো হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের জিনোম বিন্যাস উন্মোচনের মাধ্যমে নির্ণয় করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। কক্সবাজার এবং সাতক্ষীরা জেলার হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করে তারা আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশে বর্তমানে অবস্থান করছে সম্পূর্ণ নতুন ভ্যারিয়ন্টের একটি ভাইরাস যা ভারত, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন এবং এর জিনোমিক গঠন অনেক বেশি স্বতন্ত্র।

হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস মূলত চিংড়ি মাছের সাদা বৃত্তাকার দাগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। এটি একটি প্রাণঘাতী এবং ছোঁয়াচে একটি ভাইরাস। এই ভাইরাসের আক্রমণে চিংড়ি দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে মারা যায়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে পুরো চিংড়ি ঘের বা প্রজেক্ট এক সপ্তাহে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাস ক্রাস্টাশিয়ান পর্বের প্রাণীগুলোকে আক্রমণ করে।

যেমন: চিংড়ি, লবস্টার, কাঁকড়া ইত্যাদি এই পর্বের প্রাণি বাদে অন্য কোনো পর্বের প্রাণি আক্রমণ করে না। এর কারণ এই পর্বের প্রাণির কোষে আনুষঙ্গিক প্রোটিন হিসাবে রেব সেভেন নামক রিসেপ্টর থাকে। এই ভাইরাস ভাইরাস অন্য কোনো মাছকে আক্রমণ করে না।

এই ভাইরাস মূলত চিংড়ি মাছের কোষের যে আনুষঙ্গিক প্রোটিন হিসেবে রেব সেভেন নামক রিসেপ্টর থাকে তার সহায়তায় কোষের ভেতর প্রবেশ করে। কোষে ঢোকার পর এই ভাইরাস চিংড়ি মাছের কোষের সকল গুরুত্বপূর্ণ বিপাক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং মাছকে দুর্বল করে ফেলে। ভাইরাসের প্রতিষেধক কিংবা টিকা তৈরির ক্ষেত্রে ভাইরাসের জিনোমের ধরন এবং চিংড়ি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাগদা চিংড়ি চাষ হয় কক্সবাজার ও সাতক্ষীরাতে এবং ইতিপূর্বে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের হার ছিল এই দুই জেলাতেই যা মহামারি আকারেও রূপ নেয়। তাই এ গবেষণার জন্য কক্সবাজার ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্ভুক্ত সবগুলো উপজেলাগুলো থেকে নমুনা নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে এই ভাইরাস প্রথমবারের মতো পরিলক্ষিত হয় কক্সবাজারের হ্যাচারিতে। ১৯৯৮ সালে খুলনা অঞ্চলের ৯০ ভাগ চিংড়ি হ্যাচারিতে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায় প্রথমবারের মতো এবং ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি ও মাইকোলজিতে প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী প্রতি বছর দেশের ২০ ভাগ উৎপাদিত চিংড়ি নষ্ট হয়ে যায় এই ভাইরাসের কারণে।

এই ভাইরাসের কারণে ১৯৯৮ সালে রপ্তানিকৃত চিংড়ির পরিমাণ ২৬ হাজার টন থেকে কমে ১৮ হাজার টনে হ্রাস পায়। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশে বিরাজমান হোয়াইট স্পট সিনড্রোম ভাইরাসের প্রকরণ কেমন, এর জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ও ভিন্নতা শনাক্তকরণ এবং এই ভাইরাসের কোনো বিষাক্ত প্রোটিন বা জিন মাছের সংক্রমণ ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রাখে তার রহস্য উদঘাটন করা। এই গবেষণার ফল থেকে মাছচাষিরা জানতে পারবে এই ভাইরাসের উৎস কী, কীভাবে ছড়ায়। এই তথ্যগুলো পরবর্তীতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিকল্পনায় ও প্রতিষেধক তৈরিতে মূল ভূমিকা রাখতে পারে।

বাংলাদেশে ১২৮০টি নতুন মিউটেশন তথা জিনের ভিন্নতা পাওয়া গেছে। কক্সবাজার এবং সাতক্ষীরা অঞ্চলের ভাইরাসের জিনোমেও দেখা গেছে ব্যাপক পার্থক্য। ধারণা করা হচ্ছে জিনের এই ভিন্নতার কারণ দেশের আবহাওয়া, পানির বৈশিষ্ট্য, লবণাক্ততা ও ভৌগলিক অবস্থান। কক্সবাজারে এই ভাইরাসের প্রকোপ বেশি সাতক্ষীরার তুলনায়। শীতকালের তুলনায় বর্ষাকালে এর প্রকোপ বেশি। ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণায় দেখা গেছে জুন-জুলাই মাসে দেশীয় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বেশি এবং ৩৫ ভাগ হ্যাচারি বা প্রজনন ক্ষেত্রে পাওয়া যায়।

এই ভাইরাস এর জিনোমের আকৃতি বৃত্তাকার হওয়ার কারণে তার জিনোম সিকোয়েন্সকে বেশ দুরূহ ভাবা হতো এবং আন্তর্জাতিকভাবে মাত্র ২০টি দেশে প্রাপ্ত ভাইরাসের পরিপূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স আছে। বাংলাদেশের প্রথম জিনোম সিকোয়েন্স করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. এস এম রফিকুল ইসলাম ও অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং ইনস্টিটিউট অব মেরিন্স সায়েন্সের অধ্যাপক ড. এস এম শরিফুজ্জামান এবং ড. শাহনেওয়াজ চৌধুরী। প্রধান গবেষক ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের ড. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জুনায়েদ সিদ্দিকী ও আইসিডিডিআরবি’র বিজ্ঞানী এনায়েত হোসেন। এই গবেষণায় ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষণ এবং তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণে ছিল রুবেল আহমেদ, কল্যাণ চাকমা, আশিকুর আলিম আকাশ এবং মোবারক হোসেন পারভেজ।

এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো টিকা কিংবা প্রতিষেধক না থাকার তার নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব ছিল। জিনোম সিকুয়েন্সের মাধ্যমে এম আরএনএ ভিত্তিক টিকা বা এরকম কোনো প্রতিষেধক চিন্তা করা যেতে পারে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ইনফরমেশন (এনসিবিআই) এবং আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি কর্তৃক গৃহীত হয়ে এই জিনোম সিকোয়েন্সের তথ্য।

(ঢাকাটাইমস/১৫ফেব্রুয়ারি/এআর/প্রতিনিধি/জেডএম)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

সোনার ধানের মায়ায় হাওরে নারী শ্রমে কৃষকের স্বস্তি

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কঠোর বার্তা দেবে আ. লীগ 

গরমে অতিষ্ঠ জনজীবন: চাহিদা বেড়েছে তরমুজের, ক্রেতা কম ডাবের

গাছ কাটার অপরাধে মামলা নেই 

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :