উপজেলা নির্বাচনে জামানত বৃদ্ধি: রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিপত্য আরও বাড়বে
আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর জামানতের অংক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। উপজেলা চেয়ারম্যানদের ১০ হাজার টাকার জামানত ১০ গুণ বাড়িয়ে বাড়িয়ে ১ লাখ এবং ভাইস চেয়ারম্যানদের ৫ হাজারের জামানত ১৫ গুণ বাড়িয়ে ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে কমিশন। এখন আইন মন্ত্রণালয়ের সায় পেলে আগামী ৪ মে থেকে শুরু হতে যাওয়া ভোটের আগেই এ আইন কার্যকর হবে। নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য, জামানত বৃদ্ধির মাধ্যমে ভূঁইফোর প্রার্থী কমানো সম্ভব হবে। তবে নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তকে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে যাওয়া প্রার্থীরা। আর নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতে সরকারের কোষাগারে বাড়তি কিছু অর্থ যুক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো ইতিবাচকতা নেই।
পিরোজপুর সদর উপজেলা চেয়াম্যান মুজিবুর রহমান ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘পার্লামেন্ট সদস্যদের থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানদের জামানত বেশি করা হলে উপজেলা চেয়ারম্যানদের পদমর্যাদাও বেশি করে দেওয়া উচিত। যেহেতু সর্বোচ্চ জামানত দিতে হবে, তার মানে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং দায়িত্ববান পোস্ট। এজন্য পার্লামেন্ট অধিবেশন করে চেয়ারম্যানদের পোস্ট পজিশনের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি করা উচিত।’
বাগেরহাট সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সরকার বলেন, ‘এমনটা করা হলে ভালোই করা হয়েছে। এটা খারাপ দৃষ্টিতে দেখছি না আমি। দেশে অনেক ফেক প্রার্থী (যাদের প্রার্থী হওয়ার মতো কোয়ালিটি নেই) নির্বাচন করছেন। জামানত বাড়ানো হলে এ ধরনের প্রার্থী অনেক কমে যাবে।
নেত্রকোনা সদর উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান তুহিন আক্তার বলেন, ‘জামানত বাড়ানো হলে আমার তো কিছু করার নেই। সবাই এটা মানলে আমারও মানতে হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে পারে, তবে একবারে এমপি প্রার্থীর চেয়ে জামানত বাড়ানো হলো। আসলেই এটা অনেক বেশি হয়ে গেছে।’
‘তারপরও আমি মনে করছি এই টাকা দিতে কেউ অপারগতা প্রকাশ করবে না। প্রার্থীও কম হবে না। যাদের ইলেকশন করার তারা আরও বেশি হলেও করবে। এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এটা একটা নেশা, এটা একটা চ্যালেঞ্জ। একটা নির্বাচন করতে গেলে ২০-৫০ লাখ টাকা খরচ হয়। সেখানে জামানত ৭৫ হাজার টাকা কোনো বিষয়ই না।’
গত উপজেলা নির্বাচনে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলায় স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন কবিরহাট পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান আলাবক্স তাহের টিটু। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের জামানত বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন তিনি। ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য এই সিদ্ধান্ত আমি পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখি না। কারণ, অনেক গ্রহণযোগ্য প্রার্থী আছে যারা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। জামানত এক লাখ টাকা হলে বিষয়টা তাদের জন্য রীতিমতো বিব্রতকর। আবার যারা জেনুইন (প্রকৃত) প্রার্থী তারা আসলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত মেনেই নির্বাচন করবে। কিন্তু গণমুখী নির্বাচন করতে চাইলে সেই হিসেবে এটা একটা আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। সবাই তো আর ভাইটাল প্রার্থী না, অনেকে অনেক কারণে নির্বাচনে প্রার্থী হয়। কিন্তু নির্বাচন কমিশন চিন্তা করছে তারা যেন প্রার্থী না হয় সেজন্য এমনটা করছে।
নোয়াখালী সদর উপজেলার বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান নুর আলম সিদ্দিকী রাজু বলেন, ‘এমনটা করলে সুবিধা-অসুবিধা দুটোই হবে। কারণ, অনেক অযোগ্য লোক আছে, জিতবে না জেনেও নির্বাচনে দাঁড়ায়। জামানত বাড়ানো হলে তারা নির্বাচনে আসবে না। অন্যদিকে, আমরা কোনো শিল্পপতি বা টাকাওয়ালা না। আমাদের মতো দেশের ভাইস চেয়ারম্যানের এত বড় অঙ্কের জামানত রাখাটা একটি চাপ হয়ে যায়। এজন্য এটাকে ভালোভাবেও দেখছি না, আবার স্বাগতও জানাচ্ছি না।
নির্বাচন কমিশনের জামানত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এখনও অবগত না রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ। এই প্রতিবেদকের কাছে জামানত বাড়ানোর খবর শুনে ধাক্কা খান তিনি। বলেন, ‘এটা আমার মতো প্রার্থীর কাছে অনেক বড় চাপ হয়ে যায়। এমনটা হলে অনেক যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে আসবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি এখনও জানি না আমি। তবে নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ থাকবে সব প্রার্থীদের কথা বিবেচনা করে জামানত নির্ধারণ করার।
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত ১০ হাজার থেকে বৃদ্ধি করে ১ লাখ টাকা করা ঠিক হয়নি বলে মনে করেন শিক্ষক, গবেষক ও শাসন বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এতে সরকারের কোষাগারে বাড়তি কিছু অর্থ যুক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো ইতিবাচকতা নেই। ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা করতে পারতো।’
উপজেলা নির্বাচনের ব্যয় ১০ গুণ বাড়ানো ঠিক হয়নি জানিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কি শুধু বিত্তশালীদের নির্বাচন করার সুযোগ করে দিতে চায়? বিপুল পরিমাণে জামানত বাড়ালে অস্বচ্ছল অনেক জনপ্রিয় প্রার্থীরা ভোটে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।’
ইসির এমন সিদ্ধান্তে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য বা আধিপত্য আরও বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
(ঢাকাটাইমস/২৪ফেব্রুয়ারি/এলএম/এআর)