মানবিক চিকিৎসাব্যবস্থা ও পরিশুদ্ধ সমাজ

ফকির ইলিয়াস
 | প্রকাশিত : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:০৯

বাংলাদেশে খতনা করতে গিয়ে সম্প্রতি তিনজন শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এনেস্থেসিয়া বিষয়ক জটিলতাকেই প্রধান কারণ বলে জানানো হচ্ছে এ পর্যন্ত। এটা খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেছেন, সরকার জনগণকে সুরক্ষা করবে। চিকিৎসকদেরও সুরক্ষা করবে। এই সময়ে যে প্রশ্নটি বারবার আসছে তা হলো- এনেস্থেসিয়ার নামে কোনো মহল অর্থবিল বানাবার ধান্ধা করছে কি না! বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার ও পেইন ফিজিসিয়ানস (বিএসএসিসিপিপি) জানিয়েছে, দেশে মাত্র ২৪০০ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট আছেন। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব সোসাইটিজ অব অ্যানেসথেসিওলজিস্টস নামে একটি বৈশ্বিক সংস্থার মতে, প্রতি এক লাখ মানুষের জন্য অন্তত ৫ জন অ্যানেসথেসিওলজিস্ট থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে এক লাখ মানুষের জন্য একজনেরও কম অ্যানেসথেসিওলজিস্ট রয়েছে। জানতে চাইলে বিএসএসিসিপিপির মহাসচিব অধ্যাপক কাওসার সর্দার গণমাধ্যমকে বলেন- বাংলাদেশে এই খাতকে সব সময়ই অবহেলা করা হয়েছে। সার্জন ও অন্যান্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তুলনায় অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা খুবই কম উপার্জন করেন। কিন্তু তারা যে কাজটি করেন, তা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। উন্নত দেশগুলোতে অ্যানেসথেসিওলজিস্টরা অনেক বেশি বেতন পান।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন- অনেক দেশে চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পেশাদার অ্যানেসথেসিওলজিস্ট গড়ে তোলার প্রথা রয়েছে। বাংলাদেশে সেটা নেই। সরকার চাইলে একটি কোটা তৈরি করতে পারে, যার মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে আনুপাতিক হারে শিক্ষার্থীদের অ্যানেসথেসিওলজিস্ট হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি সেক্টরই এক একটি মিনি স্বৈর কেন্দ্র। চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যাংকিং, ডাক, তার-টেলি, সড়ক, পরিবহণ- সবকটি গণ-প্রয়োজনীয় সেক্টরই নিয়ন্ত্রণ করছে এক একটি স্বৈর পেশীশক্তি। কোনো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে আগে তার পকেট গুণে দেখার চেষ্টা করা হয়। রোগীটি ধনী না গরীব। ধনী হলে তাকে চিকিৎসকদের পছন্দমতো (যেগুলোর নেপথ্য পার্টনার তারা নিজেরাই) ক্লিনিকে ভর্তির উপদেশ (!) দেওয়া হয়। আর রোগীটি গরীব হলে তার স্থান হয় হাসপাতালের বারান্দায়। একই অবস্থা শিক্ষা ক্ষেত্রেও। মন্ত্রী-আমলা-বড়ো কর্তাদের সন্তানদেরকে লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হয় বিদেশে। আর গরীব মধ্যবিত্তদের সন্তানদেরকে রাজনীতিকরা ব্যবহার করেন তাদের হাতিয়ার হিসেবে। শিক্ষকরা পরামর্শ দেন প্রাইভেট কোটিং সেন্টার, প্রাইভেট স্কুল কলেজে ছাত্রছাত্রীদেরকে ভর্তি হবার। বৈষম্য আর কতটা নগ্ন হতে পারে? বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরটিও এখন দখল হয়ে গেছে রাজনীতিকদের দ্বারা। বড়ো বড়ো সরকারি, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালক নিয়োগপ্রাপ্ত হন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে।

আমাদের সমাজে আমরা দেখি কিছু কিছু পেশা এবং তা থেকে পেশাজীবীর পদবীটিও একটি বিশেষ ভাবমুর্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। তা শুধু একটি নির্দিষ্ট পেশা বা কাজ হিসেবে নয়, ঐ কাজের সঙ্গে কিছু বিশিষ্ট গুণাবলির ধারক হিসেবেও। যেমন ‘শিক্ষক’ শব্দটির সঙ্গে সততা, সামাজিক নেতৃত্ব, একইভাবে ‘চিকিৎসক’ শব্দটির সঙ্গে সেবা, মহত্ত্ব- এসব গুণাবলি যুক্ত হয়েই ঐসব শব্দ ও পেশায় এক-একটি বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। বাঙালির সমাজব্যবস্থায় একসময় ‘শিক্ষক’ পেশাটি ছিল অত্যন্ত সম্মাননীয়। ‘চিকিৎসক’ পেশাটির কথা উঠলেই একজন সেবকের মুখ আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠতো খুব শ্রদ্ধার সঙ্গে। বর্তমানে সেই ধ্যান-ধারণার বিয়োগাত্মক পরিবর্তন হয়েছে। মানুষ এই চলমান সময়ে ‘শিক্ষক’ কিংবা ‘চিকিৎসক’ পেশাজীবীদেরকে আর আগের মতো শ্রদ্ধার চোখে দেখতে দ্বিধাবোধ করেন। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে, এই পেশা দুটিকে কিছু মানুষ খুবই ঘৃণ্য পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। শিক্ষকের যে জ্ঞান-গরিমা থাকার কথা ছিল, তা ধারণ না করে এক-একজন শিক্ষক পরিচিত হচ্ছেন এক-একজন বিদ্যাবিক্রেতা হিসেবে।

বিশ্ব মানবিকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলেই বলা হচ্ছে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে! মানুষের জীবন প্রতিদিনই বিশ্বায়ন চায়। চায় নান্দনিক পরিবর্তন। এটা সমাজ পরিবর্তনের জন্য দরকারিও বটে। আছে এর পাশাপাশি সমস্যাও। পাল্লা দিয়ে এর সাথে বেড়ে যায় অপরাধও। মানুষ কিংবা সমাজের বিশ্বায়ন হলো একটি প্রক্রিয়া। যার সাহায্যে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সংস্থা বা এজেন্সি বিশ্বজুড়ে নিজেদের মধ্যে নানা প্রকার সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্পর্ক স্থাপনের পেছনে থাকে নানা ধরনের কারকের সক্রিয় অংশগ্রহণ। কারকগুলো নিজেদের মধ্যে যখন সম্পর্ক গড়ে তোলে তখন তা নিজেদের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ রাখে না। বৈশ্বিক বিশ্বায়নের সঙ্গে সমগ্র বিশ্বের নানাবিধ বিষয় যেমন- অর্থনীতি, বাণিজ্য, যোগাযোগ, রপ্তানি, শিল্পায়ন ইত্যাদি নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। এটা আমরা জানি। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মূলত রাজনৈতিক ধারণার সঙ্গে জড়িত। বেশিরভাগ বিশ্লেষক বিশ্বায়ন ধারণাটিকে অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত মনে করে এর অনুপুঙ্খ আলোচনায় বসেন যা একেবারে অযৌক্তিক নয়। কারণ সাম্প্রতিককালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জনতা ও শিক্ষিত মহল বিশ্বায়নকে অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে দেখে থাকেন। বিশ্বায়নকে তাই উৎপাদন এবং মূলধনের আন্তঃরাষ্ট্রীকরণ বলে গণ্য করার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এই আন্তরাষ্ট্রীকরণকে বৈধ করে তোলার ব্যবস্থা করে। তারা বদলে দিতে চাইছে 'একলা চলো' নীতি। কানেকটিভিটি মানুষকে দেখাচ্ছে অন্য পৃথিবীর দরজা।

অন্য একটি সংজ্ঞায় বিশ্বায়নকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বিশ্বায়ন হলো বাজারচালিত একটি প্রক্রিয়া, যা বহিষ্কারকে স্বাগত জানায় অথবা বাধা দেয়। কিন্তু পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিশ্বায়ন বলতে বোঝায় ক্রমবর্ধমান খোলামেলা পরিবেশ, উন্নত ধরনের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা এবং সমন্বয়। বর্তমানে অনেকে বিশ্বায়ন বলতে অর্থনৈতিক লেনদেন এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান তৎপরতা বৃদ্ধি বুঝিয়ে থাকেন। অর্থাৎ জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার আওতায় অর্থনৈতিক লেনদেনও ব্যবসা-বাণিজ্য থাকলে তার আকর ও চরিত্র যে রূপ নেবে বিশ্বায়নের গণ্ডির মধ্যে এলে এগুলো সম্যক বৃদ্ধি পাবে।

এবার আসি বিশ্বায়নের এই সময়ে মানুষের ভাগ্য বিষয়ে। নিউইয়র্কের পাতাল রেল দিয়ে চলাচলের সময় ট্রেনের কামরায় একটি উদার আহ্বান প্রায়ই চোখে পড়ে। নিউইয়র্ক মহানগরীর নাগরিকদের প্রতি একটি অনুরোধ করছেন। তিনি বলছেন, যাদের গৃহপালিত কুকুর আছে, তারা যেন কুকুরগুলো সিটির সুনির্দিষ্ট দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে নেন। এ জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি-ও পরিশোধ করতে হয়। দিনে দিনে কুকুরের রেজিস্ট্রেশন বিষয়টির গুরুত্ব বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক ধনীরই পালিত কুকুরের উচ্চ অঙ্কের ইন্স্যুরেন্স করা থাকে। কয়েক বছর আগের ঘটনা। নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিলেন এক ধনকুরের। সঙ্গে ছিল তার প্রিয় কুকুর। কুকুরটি মানসিকভাবে ছিল অসুস্থ। ফলে কুকুরটি কামড়ে দিয়েছিল একজন পথচারীকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে গিয়েছিল ওই পথচারীর। তিনি শিগগিরই ফোন করেছিলেন পুলিশে। পুলিশ, অ্যাম্বুলেন্স, হাসপাতাল- সব কটি পর্ব সেরে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন ওই পথচারী। ক্ষতিপূরণের মামলা করেছিলেন ওই ধনকুবেরের বিরুদ্ধে। আদালতের রায়ে দেড় মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তিনি। না, দেড় মিলিয়ন ডলার ওই ধনকুবেরের নিজ পকেট থেকে পরিশোধ করেননি। পরিশোধ করেছিল কুকুরের ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। তারপরও ধনকুবের কুকুরটি নিয়ে ছিলেন মহাআনন্দিত। সংবাদটি ওই সময়ে নিউইয়র্কে সাড়া জাগিয়েছিল। মার্কিনীরা কুকুরপ্রিয় জাতি হিসেবে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে বিশ্বব্যাপী। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন নগরীতে কুকুর-বিড়ালের অভিজাত দোকানগুলো দেখলে চমকে উঠতে হয়। কুকুর-বিড়ালের খাবারের দোকান, পরিচর্যা কেন্দ্র, হাসপাতাল অত্যন্ত ব্যস্ততার সঙ্গে চলে যুক্তরাষ্ট্রে। অনেকের কাছে কুকুর-বিড়াল তাদের সন্তানতুল্য। অনেক মার্কিনী প্রকৃত পিতৃত্ব কিংবা মাতৃত্বের স্বাদ নিতে ভয় পান। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা দত্তক হিসেবে সন্তান গ্রহণ করে সে ইচ্ছা পূরণ করে থাকেন। আর যারা তাও পারেন না, তারা প্রিয় কুকুর-বিড়ালটিকে বুকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়ে দেন জীবনের বাকিটা সময়।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ পরিচালিত এই জরিপে আরো দেখা গেছে, ইউরোপিয়ানরা প্রতিবছর মদ্যপান বাবদ যে অর্থ ব্যয় করে এর দশ ভাগের এক ভাগ দিয়ে এই সমস্যা সমাধান সম্ভব অথবা ইউরোপিয়ানরা এক বছর আইসক্রিম খাওয়া থেকে বিরত থাকলে ওই অর্থ বিশুদ্ধ পানীয়জলের সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট হতে পারে। জাতিসংঘের ভাষ্য অনুযায়ী, বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবে প্রতিবছর বাইশ লাখ মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারায়। জাতিসংঘ আরো জানিয়েছে, এশিয়া মহাদেশের ১.৭৭ বিলিয়ন লোক বিশুদ্ধ পানীয়জলের সরবরাহ কোনোকালেই পায়নি। বিশ্বে এই মহাদেশের অবস্থা ভয়াবহ। এখানকার পঁয়ত্রিশ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দূষিত পানি ব্যবহার করে চলেছে। মানবাধিকার এবং গণহিতৈষীপূর্ণ যত বড়ো বড়ো বুলি আওড়ানোই হোক না কেন, বিশ্বের নিতান্ত গরিব মানুষগুলোর ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র কতটা উদার? একুশ শতকে এসেও এর সঠিক জবাব খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। যায়নি কারণ যুক্তরাষ্ট্র কিছু কিছু ব্যাপারে এখনো তাদের অবস্থান স্পষ্ট করছে না। একথা আমরা সবাই কমবেশি জানি খাদ্যে অতিরিক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ যুক্তরাষ্ট্র তাদের উদ্বৃত্ত খাদ্য বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেয় না। অর্থনৈতিক বাজার সমতার বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সব সময়ই বিবেচ্য হিসেবে ছিল এবং আছে। এর কোনো পরিবর্তন হয়নি। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জাহাজ বোঝাই করে সমুদ্রে গিয়ে ফেলে দেওয়া কিংবা ফলন্ত শস্যের মাঠের মালিক কৃষককে তার ফসলের মূল্য অগ্রিম পরিশোধ করে ফসল মাঠেই জ্বালিয়ে ফেলার মাঝে কি কৃতিত্ব থাকতে পারে? না কোনো কৃতিত্ব নেই। আছে বিশ্বে ধনী এবং দরিদ্রের বৈষম্যকে জিইয়ে রাখার অদম্য স্পৃহা। আছে অর্থনৈতিক বাজারদর চাঙা রাখার নামে একটি শ্রেণিকে নিষ্পেষণ করা। একজন মানুষের কতটুকু স্বাধীনতা থাকলে তাকে ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞায় ফেলা যাবে তা দিয়ে বিতর্ক চলছে বিশ্বের অনেক দেশে। অতিসম্প্রতি এক মা তার এক সপ্তাহের জীবন্ত সন্তানকে আবর্জনার ব্যাগে পুরে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের ঘটনা। পুলিশ নবজাতককে উদ্ধার করে ওই মাকে গ্রেফতার করেছে। মা পুলিশের কাছে বলেছে, ওই সন্তানটিকে পালনের সংগতি ও সামর্থ্য তার ছিল না। আইনানুযায়ী ওই মায়ের সাজা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় সংস্থা, অনাথ আশ্রম, হাসপাতালগুলো বলছে যুক্তরাষ্ট্রে ভূমিষ্ট হওয়া কোনো সন্তানকেই রাস্তায় ফেলে দিতে পারবে না তার মা-বাবা। প্রয়োজনে সরকারের হাতে তুলে দিতে পারে। সরকার ওই নবজাতকের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে। কারণ কারো ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে- সদ্য জন্ম নেওয়া একজন নাগরিকের ওপর এমন আচরণ কাম্য হতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অতিরিক্ত স্বাধীনতা একজন মানুষকে বেপরোয়া করে তুলতে পারে এবং তা সমাজের জন্যও হতে পারে শঙ্কার কারণ। সেজন্য পরিমিত এবং পরিশীলিত আচার-আচরণের জন্য এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষভাবে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা হয়েছে।

অপচয়কেও এক ধরনের স্বাধীনতা, প্রাচুর্যের বড়াই বলে গণ্য করা হয় আমেরিকায়। অনেকে না বুঝেই অপচয়ে অভ্যস্ত হয়ে উঠে। ভাবতে কষ্ট হয়, এসব মানুষ যদি তাদের এই অপচয়কৃত অর্থটি বিশ্বের দরিদ্র মানুষের জন্য দান করে দিত! অনেক বাংলাদেশি-আমেরিকানকে জানি, যারা হৃদয় দিয়ে এই বিষয়টিকে অনুধাবন করেন। বাংলাদেশি-আমেরিকানদের নিজ মাতৃভূমির জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছাও আছে। কিন্তু সে সুযোগ কোথায়? শুধু নিউইয়র্ক নগরীতেই প্রায় দেড় শতাধিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আঞ্চলিক সংগঠন রয়েছে বাঙালিদের। শীত মৌসুমে এসব সংগঠন স্বল্প ব্যবহৃত শীতের কাপড় সংগ্রহ করে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য পাঠাতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাঠাবে কীভাবে? বাংলাদেশ সরকার যদি নিজব্যয়ে বিনামূল্যে প্রাপ্ত এসব কাপড় বাংলাদেশে বহন করে নিয়ে গিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বণ্টনের ব্যবস্থা করতো তবে অনেক প্রবাসীই এমন মহতী কাজে এগিয়ে আসতেন।

বাংলাদেশি-আমেরিকান ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের জানি, তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে বিভিন্ন দরকারি যন্ত্রপাতি দিয়ে সাহায্য করছেন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে আরো সহযোগিতা করতে চান। কিন্তু তাদের অভিযোগ দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে আগ্রহ নেই। সৃজনশীলতার পক্ষে, মানুষ বিশ্বায়নকে নিতে চাইছে তার হাতের মুঠোয়। মোবাইল ফোন এখন একটি শক্তিশালী ডিভাইস। তা দিয়ে অনেক ভালো কাজের ক্যাম্পেন করা যায়। প্রজন্মকে এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। জীবন স্বপ্নের পরিচর্যা চায়। না হলে মানুষে-মানুষে সৃষ্টির সিঁড়ি তৈরি হয় না।

নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুপস্থিতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। আবার সুশাসনের অভাব হলে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সঠিক বিকাশ ঘটে না। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। এক্ষেত্রে সুশাসন নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভিভাবক হিসেব কাজ করে। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ। নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ ছাড়া সমাজকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত এবং শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতার জন্য উপরিউক্ত তিনটি বিষয়ই অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এর যেকোনো একটির অভাব হলেই সমাজে বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়। তাই, সমাজ ও কার্যকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির জন্য সুশাসন, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সমন্বয় খুবই দরকারি। বাংলাদেশে চিকিৎসাক্ষেত্রে যে অমানবিক সংকট চলছে- তা কাটিয়ে উঠতে হবে। আমরা করোনাকালে দেখেছি শাহেদ-সাবরিনা চক্র কীভাবে এই দেশকে কলংকিত করে তুলেছিল। না- আমরা এমন দানবদের পুনরুত্থান চাই না; চাইতে পারি না।

ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :