নৃভাষা-বিপন্নতা: যে কথা অনেকেই জানেন না

চারু হক
 | প্রকাশিত : ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৪:১৩

রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছাড়াও ৪০টির বেশি মাতৃভাষায় কথা বলে ভাষার দেশ বাংলাদেশের মানুষ। বছর দশেক আগের এক সমীক্ষায় এগুলোর ১৪টিকে বিপন্ন বলা হলেও বর্তমান সময়ে সেই সংখ্যাটি অনেক বড়ো। সরেজমিন বাস্তবতা নিরিখে বলা যায়- অধিকাংশ নৃগোষ্ঠী ভাষাই এখন বিপন্ন। এর কারণ হিসেবে বরাবর শিক্ষা, সংস্থান, অর্থনৈতিক উপযোগিতা, আন্তঃজাতি যোগাযোগ ও সম্পর্ক রক্ষায় প্রভাবশালী ভাষা ব্যবহারে বাধ্যবাধকতার কথা বলা হয়ে আসছে এবং এ অবস্থা উত্তরণের প্রচেষ্টা হিসেবে এরই মধ্যে ৫টি নৃগোষ্ঠী ভাষায় শিশুদের পাঠ্যপুস্তকও চালু করা হয়েছে। যদিও ২০১২-১৩ থেকে শুরু হওয়া সেই প্রচেষ্টা সংশ্লিষ্ট ভাষার শিক্ষকদের অভাবে কাঙ্ক্ষিত গতি লাভে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিক্রিয়ায়, সরকার না কি সম্প্রদায়- কার কতখানি দায় অভাবিত এ ঘটনায় তা নিয়ে বিতর্ক বহাল আছে। আছে বিতর্কের বাইরে আরও কিছু বাস্তবতা- যা ভাষা বিপন্নতায় বড়ো ভূমিকা রাখা সত্ত্বেও এখনও অনেকটা অনালোচিত রয়ে গেছে। আপাত অনালোচিত সেই প্রপঞ্চগুলোর সুদূরপ্রসারী ভূমিকার নাতিদীর্ঘ উপস্থাপনই এ লেখার উদ্দেশ্য।

বলার অপেক্ষা রাখে না- বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভাষা বাংলা। দাপটের সাথে দখলে থাকা বাংলার অসমান্তরালে টিকে থাকতে প্রয়াসরত অপরাপর ভাষাগুলো এখানে মৃদু গুঞ্জনের মতো। বহুমাত্রিক উপযোগিতার মাপকাঠিতে শক্তিসামর্থ্য হারাতে হারাতে অস্তিত্ববিনাশের অভিমুখে থাকা এ ভাষাগুলোর সুরক্ষায় সম্প্রতি সরকারি একটি উদ্যোগ শুরু হয়েছে। এ প্রচেষ্টার একজন টিম মেম্বার হিসেবে সরেজমিন যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই সেটাই এই লেখার উপজীব্য।

বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী ভাষাগুলোর যথাযথ নমুনা সংগ্রহ এবং ডিজিটালি সংরক্ষণের লক্ষ্যে আমরা এথনোগ্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করি। এতে করে নৃগোষ্ঠী ভাষিক বাস্তবতা বিষয়ে মিডিয়া ও একাডেমিয়া থেকে লব্ধ মুখস্ত জ্ঞানের অনেককিছুই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। এ প্রসঙ্গে এনকলা পাংখোয়া ও প্রার্থনা আসামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বান্দরবানের সদ্য স্নাতক যুবক এনকলার পুরো নাম এনকলা পাংখোয়া। বনরুই-এর খোলের মতো নামের সাথে যুক্ত জাতিপরিচয় থেকে স্পষ্ট তিনি পাংখোয়া নৃগোষ্ঠীভুক্ত। এই জনজাতির স্বতন্ত্র ভাষা ও সংস্কৃতি আছে। অথচ, জাতিসূত্রীয় পাংখোয়া ভাষার পরিবর্তে এনকলার সাথে পরিচয় ঘটে লুসাই ভাষার একজন প্রতিনিধি হিসেবে। কারণ, তার মায়ের ভাষা লুসাই এবং তাদের বসবাসের পরিসর লুসাই অধ্যুষিত। অন্যদিকে, রাঙামাটির মেয়ে প্রার্থনা আসামের মা একজন চাকমা সত্ত্বেও তাকে পাই পিতার ভাষা অহমীয়ার একজন প্রতিনিধি পরিচয়ে। বলাবাহুল্য, তাঁরা উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন জাতিপরিচয় বয়ে বেড়ানো বাবা-মায়ের ঔরসজাত। একজন নিয়েছেন মায়ের ভাষা, আরেকজন বাবার ভাষাকে। অবশ্য, এ ধরনের সম্পর্কসৃষ্ট সন্তানেরা যে তাদের বাবা (অথবা/এবং) মায়ের ভাষাকেই নেবেন সেরকম শর্ত সবসময় কাজ করে না। অনেক ক্ষেত্রেই এঁরা বাবা-মায়ের ভাষা পেরিয়ে তৃতীয় একটি ভাষাকে তাদের সাধারণ ভাষার জায়গা দিয়ে ফেলছেন। আবার, এই তৃতীয় ভাষা যে সবসময় রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রভাবশালী ভাষা (যেমন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘বাংলা’) হবে- এমন শর্তও শতভাগ সক্রিয় নয়। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বসবাসরত এলাকায় যে ভাষাটি প্রভাবশালী তাদের সেই ভাষাকেই গ্রহণ করতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে বান্দরবানের শহর সন্নিকটস্থ বম এলাকার কথা উল্লেখ করা যায়। জনসংখ্যা ও সামাজিক অবস্থান নিরিখে সেখানকার লুসাই, পাংখোয়া ইত্যাদি নৃগোষ্ঠীসমূহও সাধারণ ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে বম ভাষা ব্যবহার করছেন। বৃহত্তর অর্থে যেমনটা ঘটে চাকমা প্রভাবাধীন রাঙ্গামাটি, মারমা প্রভাবাধীন বান্দরবান ও ত্রিপুরা প্রভাবাধীন খাগড়াছড়িতে।

ভাষিক প্রতিপত্তির নির্বিশেষ এ বাস্তবতার কার্যকারণ ও ফল-প্রতিফল বিশ্বজুড়ে প্রায় একইরকম। বিপদাপন্ন ভাষার বহুমাত্রিক উপযোগিতা বাড়ানো ছাড়া এই প্রতিপত্তি বা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা যায় না এবং এ ধরনের চ্যালেঞ্জের লক্ষ্যে জাতিগত অবস্থান সুদৃঢ় করতে স্বাতন্ত্রিক আত্মপরিচয়ের সর্বাত্মক পরিচর্যা যে অপরিহার্য- এ বিষয়েও কোনো ভিন্নমত থাকে না। এ সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তঃজাতি বিয়েশাদির ক্ষেত্রে নর-নারী দুজনের মতৈক্যের কাছে পরিবার পরিজন, প্রজন্মান্তরে আচরিত ঐতিহ্যিক রীতিনীতি তথা জাতিগত সাযুজ্যের বোধ পরাজয় স্বীকারে বাধ্য হচ্ছে। দীর্ঘকাল এ ব্যাপারটা বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রম অভিধা পেলেও ক্রমে ঘটমান এ বাস্তবতা সাধারণ বাস্তবতায় রূপ নিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আবেগীয় অসহায়ত্বকে দায়ী করেন অনেকে। নর-নারীর হৃদয় প্রদেশের পারস্পরিক আকুতির কাছে ভাষা-জাতি-সংস্কৃতির দেওয়াল ধসে যাওয়াকে অকৃত্রিম বিবেচনা করছেন তারা। কেউ কেউ মনে করেন নর-নারীর মধ্যেকার শিক্ষা ও সামাজিক অবস্থানের সাদৃশ্য এখানে অনুঘটকের ভূমিকা রাখছে। আর, এইসব সত্যের প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড়ো শক্তি-সাদৃশ্যের জোগান দিচ্ছে তাদের মধ্যেকার ধর্মীয় মিল।

কমবেশি বাংলাদেশের অধিকাংশ নৃগোষ্ঠীর মধ্যেই খ্রিষ্টান মিশনারীর ধর্মান্তরণ প্রচেষ্টা সাফল্য পেয়েছে। সন্দেহ নেই মিশনারীর দরুন শিক্ষাদীক্ষা, জীবনমান ও সামাজিক অবস্থান এবং সামাজিক নিরাপত্তার অনেক সূচকেই সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। এমনকি বাংলাসহ অন্যান্য অনেক ভাষার গদ্যরূপ, লিখিত রূপ, ব্যাকরণ ও অভিধানসহ ভাষাকে কাঠামোবদ্ধ ও নথিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে খ্রিষ্টান মিশনারীসমূহ ব্রিটিশ আমল থেকে এখন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। উল্লেখ অবান্তর যে- ভাষা বিষয়ে মিশনারীসমূহের এইসব প্রচেষ্টার পেছনে তাদের ধর্ম প্রচারের এজেন্ডাই মুখ্য থেকেছে। তাদের প্রচেষ্টায় ধর্মান্তরিত জাতিসমূহের মধ্যে অজানিত বছর ধরে চলে আসা অলিখিত সনাতন বিশ্বাসের স্থানে সবচেয়ে শক্তিমান ও সুগ্রন্থিত ধর্মের প্রতিস্থাপন ঘটে চলেছে এবং ধর্ম প্রতিস্থাপনের এই পরিস্থিতি অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মান্তরিত নৃগোষ্ঠীর সম্মিলিত মনস্তত্ত্বে উন্নয়নানন্দের ছাপ স্পষ্ট করেছে। এ ঘটনা কেবল খৃষ্টধর্মে রূপান্তরিত সান্তাল, ওঁরাও বা মুন্ডাদের ক্ষেত্রে ঘটছে তা নয়; হিন্দু ধর্ম আত্মীকরণ করা মৈতৈ (মণিপুরি) কিংবা ত্রিপুরা, ইসলাম আত্মীকরণ করা পাঙ্গাল (মণিপুরি) প্রমুখদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। একাডেমিক ডিসকোর্সে ‘অসভ্য’, ‘বর্বর’ অভিধায় আটকে দেওয়া পূর্ব প্রজন্মের অগ্রন্থিত প্রকৃতিপূজাকেন্দ্রিক ধর্মাচরণ হিন্দু, ইসলাম, খৃষ্ট ধর্মের মতো প্রভাবশালী ধর্মের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হওয়ার ঘটনা অভাবিত অনেক বাস্তবতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে। ‘নতুন’ ধর্মের আচ্ছাদন তাদের মধ্যেকার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে পাশ কাটিয়ে নতুন ধর্ম-পরিচয়কে প্রধান করে তুলছে। আর মুখ্যত এই পরিচয়ের প্রভাবই নৃগোষ্ঠীদের আন্তঃজাতি বা বহির্বিবাহকে সামাজিক বৈধতা দান করছে।

ধর্মান্তরণের আগে এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট জাতিসমূহের সামাজিক নীতির কঠোর প্রয়োগ ঘটতো। বিয়ে বা পরিবার গঠনের নির্ধারিত কাঠামো লঙ্ঘন করলে উক্ত নারী-পুরুষ ও তাদের পরিবারকে সামাজিকভাবে কোণঠাসা করে রাখা, একঘরে করে রাখা, প্রায়শ্চিত্ত, জরিমানা ইত্যাদি করা হতো। ধর্মের একরূপতা এবং বিয়ের ক্ষেত্রে নতুন ধর্মের ধরাবাঁধা নিয়মের প্রয়োগ তাদের মধ্যেকার ঐতিহ্যিক রীতিনীতিকে এড়িয়ে যাবার ক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা রাখছে। এতে করে তাদের হাজার বছরের সামাজিক অনুশাসন অকার্যকর হয়ে পড়ছে। প্রজন্মান্তরে আচরিত আদি ধর্মের স্থলে নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠানাদি বিয়েশাদির মতো তাদের জন্ম ও মৃত্যুর আনুষ্ঠানিক আচরণকেও অধিকার করেছে। এ কারণে আদি ধর্মের আশ্রয়ে হাজার বছর ধরে পরিপুষ্টি লাভ করা সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

নৃগোষ্ঠী ভাষাসমূহের নমুনা সংগ্রহের লক্ষ্যে তৈরি করা ডাটাসেটের ‘সংস্কৃতি’ ও ‘লোকসাহিত্য’ অংশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের রূপান্তরিত/প্রতিস্থাপিত ধর্মসমূহের প্রভাব লক্ষ করা গেছে। গারো বা মান্দিদের প্রাচীন ধর্মের প্রধান উৎসব ছিল ওয়ানগালা, সান্তালদের প্রধান উৎসব ছিল সোহরাই, ত্রিপুরাদের ছিল বৈসু, মণিপুরিদের ছিল শজীবু চৈরাওবা। কিন্তু প্রাচীনের পরিবর্তে নতুন ধর্মের প্রতিষ্ঠা ঘটায় সেখানে খ্রিষ্টীয় বড়োদিন বা ক্রিসমাস, হিন্দু দুর্গা পূজা, ইসলামি ঈদকে (মণিপুরি পাঙ্গাল) পাওয়া যাচ্ছে। বেদনার ব্যাপ্তি শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধতা থাকছে না। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ নৃগোষ্ঠী ভাষা-নমুনা প্রদানকারীর কাছ থেকে তাদের ঐতিহ্যবাহী লোকসাহিত্যও (ছড়া, কবিতা, গান, গল্প ইত্যাদি) পাওয়া যাচ্ছে না। ষাটোর্ধ বা আগের প্রজন্মের কেউ কেউ কিছুটা বলতে পারলেও বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ তাদের ঐতিহ্যের মতো ইতিহাসের ব্যাপারেও অভাবিত অজ্ঞতা দেখিয়েছেন।

পরিবার ও সমাজের বাইরে একই ভাষার দুজন নিজ ভাষায় কথা বলার ক্ষেত্রে সংকোচ বোধ করার পেছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করে- হতে পারে সেই একই কারণ তাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে ভুলে যাবার ক্ষেত্রেও নীরব ভূমিকা রাখছে। যাকিছু তাদের স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য, যা তাদেরকে আলাদা নৃগোষ্ঠীর পরিচয় প্রদানের অনুষঙ্গ হিসেবে আমল করা হয়ে আসছে- সেগুলো বয়ে বেড়ানোর ব্যাপারে আগ্রহ না রাখা তাদের আত্মপরিচয়কে সংকটে ফেলে দিচ্ছে। নিজ ভাষার ব্যাপারে উদাসীনতা বজায় রাখায় তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোকসাহিত্যের কথা ভুলতে বসেছে। কারণ, অলিখিত বিধায় (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) তাদের মৌখিক ভাষাই এগুলোকে এতকাল ধরে রেখেছে। ভাষা ধরে না রাখলে তাই সেই ভাষায় রচিত ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য কিছুই ধরে রাখা যায় না। আর নৃগোষ্ঠী পরিচয় বহনকারীদের এইসব স্বাতন্ত্রিক বিষয়বস্তু হারিয়ে ফেলা মানে তাদের আত্মপরিচয় প্রশ্নের মুখে পড়ে যাওয়া।

চারু হক: লেখক ও রিসার্চ অ্যান্ড কন্টেন্ট এক্সপার্ট, ‘বাংলাদেশের নৃগোষ্ঠী ভাষার ডিজিটাইজেশন’ প্রকল্প, ইবিএলআইসিটি, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :