ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-৩

আল্লাহর রাস্তায় খরচের অপূর্ব দৃষ্টান্ত ও সদকা-সুদের পার্থক্য

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৪, ১৭:২৭ | প্রকাশিত : ১৩ মার্চ ২০২৪, ২৩:২৭

প্রিয় পাঠক, আজ আমরা কোরআনুল কারিমের ৩য় পারার নির্বাচিত আয়াতসমূহ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাবো ইনশাআল্লাহ। চলুন আমরা শুরু করি...

আগের পর্ব: আল্লাহর আনুগত্যই ইবাদতের মর্মবাণী

সূরা বাকারায় শরিয়তের বিভিন্ন বিধান বর্ণনার সঙ্গে সঙ্গে নবুওয়াত ও রিসালাতের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। এখানে তৃতীয় পারায় বিভিন্ন নবীকে যেসব বৈশিষ্ট্য প্রদান করা হয়েছিল, তার আলোচনা করা হবে। যেমন:

কোনো নবীকে নেতৃত্ব প্রদান করা হয়েছিল

আল্লাহ তাআলা যত নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন প্রত্যেকের মর্যাদা মানুষের মধ্যে সর্বাপ্রেক্ষা বেশি। তথাপিও নবী রাসূলদের মধ্যে কারো কারো বিশেষ মর্যাদা ও গুণ ছিলো। যেমন কোনো নবীকে মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহর সঙ্গে কথোপকথনের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল। আবার কোনো নবীকে সুস্পষ্ট মুজিজার মাধ্যমে সমর্থন করা হয়েছে।

নবীগণ মহা মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও সকলে একই পর্যায়ের ছিলেন না। বরং একজনের তুলনায় অন্যজন ছিলেন শ্রেষ্ঠ।

যেমনিভাবে নবীগণের একজনের উপর অন্যজনের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, তেমনি তাদের উম্মতদেরও একের উপর অন্যের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। যেহেতু বহু বৈশিষ্ট্য ও গুণের কারণে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল নবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ। তাই তার উম্মতও অন্যান্য উম্মতের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।

আয়াতুল কুরসি বা শ্রেষ্ঠ আয়াত

নবীদের শ্রেষ্ঠত্ব এবং তাদের মর্যাদার বিস্তর বর্ণনার পর সর্বশ্রেষ্ঠ আয়াত উল্লেখ হয়েছে। আর তা হচ্ছে আয়াতুল কুরসি, যাতে পঞ্চাশটি শব্দ এবং দশটি বাক্য রয়েছে, যাতে সুস্পষ্ট ও পরোক্ষভাবে সতেরোবার আল্লাহর আলোচনা এসেছে।

নমরুদের বিতর্ক

তৃতীয় পারায় ইবরাহিম আলাইহিস সালামের সাথে অহংকারী ও অবাধ্য বাদশাহ কেনান-পুত্র নমরুদের বিতর্কের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে।

মৃতকে জীবিতকরণের ঘটনা

এ ছাড়াও ইবরাহিম আলাইহিস সালাম যে আল্লাহ তায়ালার নিকট মৃতকে জীবিত করার আবেদন করেছিলেন, সে কথাও বর্ণিত হয়েছে।

এ ছাড়াও হজরত উজাইর আলাইহিস সালামের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, এক ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ দেখে যার খেয়াল হল যে, জানি না আল্লাহ তায়ালা এই জনপদবাসীকে পুনরায় কীভাবে জীবিত করবেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা তাকে একশ বছর মৃত্যু দিয়ে পুনরায় জীবিত করেন।

সূরা বাকারা অধ্যয়নের মাধ্যমে জানা যায় যে, এ সুরার মোট পাঁচ জায়গায় মৃতকে পুনর্জীবনের আলোচনা এসেছে।

এক. ভাতিজার হাতে নিহত ব্যক্তির ঘটনায়, যার শরীরে গাভীর গোশত লাগানোর পর সে জীবিত হয়েছিল।

দুই. বনি ইসরাইলের সেই লোকদের ঘটনায়, যারা হঠকারিতামূলকভাবে আল্লাহ তায়ালাকে দেখার আবেদন করেছিল।

তিন. সেই সম্প্রদায়ের ঘটনায়, যারা প্লেগ থেকে বাঁচার জন্য বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিল।

চার. হযরত উজাইর আলাইহিস সালামের ঘটনায়।

পাঁচ. এবং হযরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের ঘটনায়।

উল্লিখিত বিষয়গুলো ছাড়াও সূরা বাকারায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের আলোচনা এসেছে। নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:

আল্লাহর রাস্তায় খরচের অপূর্ব দৃষ্টান্ত

১. ইসলাম মনুষ্যত্ব, মানবতা, ভ্রাতৃত্ব, মহব্বত, অনুগ্রহ, অনুকম্পা এবং আল্লাহর রাস্তায় খরচের ধর্ম। মানব-কল্যাণের এমন কোনো দিক নেই, কোরআন যার প্রতি দাওয়াত দেয়নি, কিংবা এমন কোনো কাজ নেই, ইসলাম যার প্রতি উৎসাহিত করেনি।

সূরা বাকারায় বিভিন্নভাবে আল্লাহর রাস্তায় খরচ করার ফজিলত ও আদব বর্ণনা করা হয়েছে।

একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর রাস্তায় খরচকারীদের ওই কৃষকের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যে মাটিতে একটি দানা রোপণ করে আর তা থেকে সাতটি শীষ উদগত হয়। প্রতিটি শীষ থেকে একশ শস্যদানা জন্মায়। আর আল্লাহ চাইলে কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে দেন। কৃষক জমিনে মাত্র একটি শস্য দিয়ে তা থেকে হাজার হাজার শস্য লাভ করে। তেমনিভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে তার রাস্তায় এক টাকা খরচ করার মাধ্যমে মানুষ হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ সাওয়াব হাসিল করে থাকে। (২৬১)

পক্ষান্তরে যে-ব্যক্তি লোক-দেখানোর জন্য সদকা করে, তাকে পাথুরে ভূমিতে ফসল উৎপাদনকারীর সাথে তুলনা করা হয়েছে, যার সাথে মাটির সম্পর্ক অতি সামান্য। যদি প্রবল বৃষ্টিপাত হয় তা হলে মাটি ও বীজ ভেসে যায়। যার কারণে তার সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। (২৬৪)

সদকার শর্ত ও আদব বর্ণনা করার পর বলা হয়েছে, উত্তম কথা এবং ক্ষমা এমন সদকা থেকে উত্তম, যার পর খোটা দেওয়া হয়। (২৬৩)

দ্বিতীয় বিধান দেওয়া হয়েছে যে, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা স্বীয় উপার্জন থেকে এবং যা আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে উৎপন্ন করেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করো এবং নিকৃষ্ট জিনিস ব্যয় করতে মনস্থ কোরো না, যা (অন্য কেউ তোমাদেরকে দিলে ঘৃণার কারণে) তোমরা চোখ বন্ধ না করে তা গ্রহণ করবে না। জেনে রেখো, আল্লাহ অভাবমুক্ত, প্রশংসিত।’ (২৬৭)

তৃতীয় বিধান দেওয়া হয়েছে, ‘যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান-খয়রাত করো, তবে তা কতই-না উত্তম! আর যদি গোপনে দান করো এবং অভাবগ্রস্তদের দিয়ে দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম!’ (২৭১)

সুদ ও তার ভয়াবহতা

২. সুরা বাকারায় যেসব মাসআলা বর্ণিত হয়েছে, তার মধ্যে বর্তমান জমানার ব্যাপক প্রচলিত সুদের বিষয়টিও এসেছে। আয়াতে সুদখোরকে জিন ও শয়তানের প্রভাবে বিকারগ্রস্ত পাগলের সাথে তুলনা করা হয়েছে। দুনিয়াতে সুদখোর যেমন পাগলের মতো আচরণ করে কেয়ামতের দিন তারা কবর থেকে পাগল অবস্থায়ই উঠবে। কোরআনে সুদের ব্যাপারে কঠোর ধমক এসেছে। আরও অনেক বড় গুনাহের ক্ষেত্রেও কোরআন এরূপ কোনো ধমক উচ্চারণ করেনি।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। যদি তোমরা প্রকৃত মুমিন হয়ে থাকো তা হলে সুদের যে অংশই (কারো কাছে) অবশিষ্ট রয়ে গেছে তা ছেড়ে দাও। যদি তোমরা এটা না করো তা হলে তোমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ এবং তার রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা দেওয়া হল।’ (২৭৮-২৭৯)

সদকা ও সুদের পার্থক্য

এখানে লক্ষণীয় বিষয় হল সদকার আদব ও ফজিলত বর্ণনা করার পর সুদের ক্ষতি, অপকার ও তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সদকা ও সুদ দুটি পরস্পরবিরোধী ব্যবস্থা। সদকায় ইহসান, পবিত্রতা, অন্যকে সাহায্য করার প্রেরণা থাকে। পক্ষান্তরে সুদে কার্পণ্য, দুর্গন্ধ ও স্বার্থপরতা পাওয়া যায়। সদকার ক্ষেত্রে প্রদেয় সম্পদ ফেরত নেওয়ার কোনো নিয়ত থাকে না। আর সুদে মূলধনের উপর অতিরিক্ত অর্থ পাওয়ার শর্তারোপ করা হয়। সদকার মাধ্যমে পরস্পর ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। সুদের কারণে ঘৃণা-বিদ্বেষ বেড়ে যায়। সদকার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে ভালোবাসার ঘোষণা এবং ক্ষমার ওয়াদা রয়েছে। পক্ষান্তরে সুদখোরের উপর অভিসম্পাৎ এবং তার বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

এ ছাড়াও সুদের ব্যক্তিগত, চারিত্রিক ও সামাজিক ক্ষতি এতটাই সুস্পষ্ট যে, ইদানীং সুদের মহাজনরাও তা স্বীকার করতে শুরু করেছে।

বন্ধক ও ঋণের বিধান

৩. সুদ হারাম হওয়ার বিষয়টি বর্ণনা করার পর ধর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, পরস্পর লেনদেন ও বন্ধকের বিধান আলোচনা করা হয়েছে। এ বিধান যে আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে, তা কোরআনুল কারিমের সবচেয়ে বড় আয়াত। আর্থিক লেনদেনকে কোরআনের গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি এর থেকে বোঝা যায়। তেমনিভাবে এটাও বোঝা যায় যে, ইসলাম দুনিয়া-আখেরাত, ইবাদত ও

ব্যবসা-বাণিজ্য, দেহ ও আত্মা সব বিষয়েই নিজস্ব রূপরেখা পেশ করেছে। সবকিছু সাথে নিয়েই পথ চলে থাকে।

এই আয়াতে যে বিধান দেওয়া হয়েছে, নিম্নে তা উল্লেখ করা হল:

ক. সমস্ত বকেয়া লেনদেন লিখিত হওয়া উচিত।

খ. বকেয়া চুক্তির মেয়াদ নির্দিষ্ট হওয়া আবশ্যক। এ মেয়াদে কোনো অস্পষ্টতা থাকতে পারবে না।

গ. সফরের কারণে যদি লিখিত চুক্তিপত্র তৈরি করা সম্ভব না হয় তা হলে বন্ধক রেখেও ঋণ নেওয়া যাবে।

ঘ. নগদ ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তিপত্রের কোনো প্রয়োজন নেই। সুরা বাকারায় যেহেতু নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, সদকা, জিহাদ, সুদ, তালাক, ইদ্দত প্রভৃতি বিধান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে এ কারণে সুরার শেষে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে যে, ‘আল্লাহ মানুষের উপর তার সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপিয়ে দেন না।’ (২৮৫)

একটি চমৎকার দোয়া

এছাড়া একটি চমৎকার দোয়ার মাধ্যমে সূরা বাকারাহ শেষ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে মুসলমানদের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তারা যেন আল্লাহর নিকট আবেদন করে যে, ‘হে আল্লাহ, যদি আপনার বিধান পালনে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ভুলত্রুটি হয়ে যায় তা হলে আপনি তা ক্ষমা করে দিন।’

মুসলমানরা যতদিন আল্লাহ তায়ালার বিধান সাধ্যমতো পালন করবে, নিজেদের ভুলত্রুটির উপর ক্ষমাপ্রার্থনা করবে এবং তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করবে এবং দোয়া করবে, ইনশাআল্লাহ ততদিন তারা ইহুদিদের মারাত্মক পরিণতি থেকে বেঁচে যাবে।

এখান থেকে নতুন সূরা শুরু...

‘সূরা আলে ইমরান’

সূরাটি মাদানি। আয়াত সংখ্যা: ২০০। রুকু সংখ্যা: ২০।

নামকরণ

তৃতীয় পারার অষ্টম রুকু পর্যন্ত সূরা বাকারার আলোচনা হয়েছে। এখন নবম রুকু থেকে সূরা আলে ইমরান শুরু হচ্ছে। সূরাটি সর্বসম্মতিক্রমে মাদানি। যেহেতু ও সূরায় ইমরান আলাইহিস সালামের বংশধরের আলোচনা এসেছে, তাই একে আলে ইমরান বলা হয়। সূরার ফজিলত সম্পর্কে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, আমি রাসুল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা দুই উজ্জ্বল সুরা তথা বাকারা ও আলে ইমরান পাঠ করো।’

যোগসূত্র

এই দুই সূরার বিষয়বস্তুর মধ্যে কী আশ্চর্য মিল! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ সূরা দুটোকে দুটি আলো (সূর্য ও চন্দ্র) বলেছেন, যার দ্বারা উভয় সূরার সাযুজ্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়।

এছাড়াও এই দুই সূরায় আহলে কিতাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তবে সূরা বাকারার অধিকাংশ আলোচনা ইহুদিদের সম্পর্কে ছিল আর সুরা আলে ইমরানে মৌলিকভাবে খ্রিষ্টানদের সম্বোধন করা হয়েছে।

উভয় সুরা আলিফ-লাম-মিম-হরফে মুকাত্তায়াত দ্বারা শুরু হয়েছে। উভয় সুরার প্রথম দিকে কোরআনের সত্য হওয়ার বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

প্রেক্ষাপট, মুহকাম ও মুতাশাবিহ

নাজরানের খ্রিষ্টানদের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিল। এ সূরার প্রায় আশিটি আয়াত এই পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে। প্রতিনিধি দলে ষাটজন খ্রিষ্টান ছিল, যারা ঈসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়, নাউজুবিল্লাহ। তারা ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহর পুত্র সাব্যস্ত করার অপপ্রয়াস চালায়।

এক্ষেত্রে তাদের ভুল দলিলের উত্তর দিয়ে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কালামে দু-ধরনের আয়াত রয়েছে। কিছু আয়াতের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। এই আয়াতগুলোকে মুহকাম বলা হয় আর কোরআনের অধিকাংশ আয়াত এ ধরনেরই। কিছু আয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য একমাত্র আল্লাহ তায়ালা জানেন কিংবা তাতে কোনো কারণে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। এ ধরনের আয়াতকে মুতাশাবিহ বলা হয়। সত্যানুসন্ধানী ব্যক্তিরা সব সময় মুহকাম আয়াতের অনুসরণ করে। পক্ষান্তরে যাদের অন্তরে ও মেধায় ত্রুটি ও বক্রতা রয়েছে, তারা মুতাশাবিহ আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা করে তার উদ্দেশ্য বোঝাবার অপচেষ্টা চালায়।

কালিমাতুল্লাহ, রুহুল্লাহ প্রভৃতি শব্দ মুতাশাবিহ পর্যায়ের। এসব আয়াতের উপর শিরকি আকিদা-বিশ্বাসের ভিত নির্মাণ করা আর পানিতে ভবন নির্মাণ করা একসমান কথা।

তাওহিদ ও ইসলাম

তাওহিদ ও ঈমানের দলিল-প্রমাণ সুস্পষ্ট। একমাত্র অন্ধ মানুষেরাই তা অস্বীকার করতে পারে। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা, তার পবিত্র ফেরেশতা এবং আলেমগণও তাওহিদের সাক্ষ্য দেন। (১৮)

যেমনিভাবে আল্লাহ তায়ালা তাওহিদের সাক্ষ্য দেন তেমনি তিনি এ কথার সাক্ষ্য দেন যে, তার নিকট একমাত্র পছন্দনীয় ধর্ম হচ্ছে ইসলাম। ইহুদি-খ্রিষ্টানরা শুধু হঠকারিতাবশতই এ ধর্মের সত্যতার ব্যাপারে ঝগড়া-বিবাদ করে থাকে।

আহলে কিতাবদের নিন্দা

সামনের আয়াতগুলোতে ধারাবাহিকভাবে আহলে কিতাবদের নিন্দা করা হয়েছে। তাদের দোষত্রুটি বর্ণনা করা হয়েছে। তারা নবীদের হত্যা করেছে, রক্তপাত ঘটিয়েছে, নেককার বান্দাদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে। (২১)

কাফের মুমিনের বন্ধু হতে পারে না

মুসলমানদের বোঝানো হয়েছে যে, তারা যেন মুমিনদের পরিবর্তে কাফেরদের বন্ধু না বানায়। (২৮) কেননা ইসলাম ও কুফরের মাঝে কখনো বন্ধুত্ব হতে পারে না। কাফের কখনো মুসলমানের জন্য একনিষ্ঠ হতে পারে না।

তিনটি শিক্ষণীয় ঘটনা

এ সূরায় তিনটি শিক্ষণীয় ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাই অস্বাভাবিক ও আশ্চর্যজনক, যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব বুঝে আসে।

প্রথম ঘটনা হযরত মরিয়াম আলাইহাস সালামের সন্তানপ্রসব সংক্রান্ত। খ্রিষ্টানরা মারাত্মক বিভ্রান্তির শিকার হয়ে মারিয়াম আলাইহাস সালামকে আল্লাহ তায়ালার স্ত্রী এবং তার সন্তানকে আল্লাহ তায়ালার ছেলে বলে আখ্যায়িত করে থাকে, নাউজুবিল্লাহ।

হযরত মরিয়াম আলাইহাস সালামের পিতা হজরত ইমরান আলাইহিস সালাম আল্লাহ তায়ালার নেককার বান্দা ছিলেন। তার মাতা (ইমরান আলাইহিস সালামের স্ত্রী) হান্না বিনতে ফাকুজ অত্যন্ত বিদ্বান ও নেককার নারী ছিলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত তার কোনো সন্তান হচ্ছিল না। একদিন তিনি একটি পাখি দেখলেন যে, সে তার বাচ্চাকে খাবার খাওয়াচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে তার মনে নাড়া দেয়। সন্তান লাভের আশা জেগে ওঠে। আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করেন যে, যদি আল্লাহ তাকে কোনো সন্তান দেন তা হলে তাকে বাইতুল মাকদিসের খেদমতে ওয়াকফ করে দেবেন।

আল্লাহ তায়ালা তার দোয়া কবুল করেন। তার এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। কিন্তু বাইতুল মাকদিসের খেদমতে শুধু পুত্রসন্তান গ্রহণ করা হতো; কন্যাসন্তানকে এই কাজে নেওয়া হতো না। ওইদিকে আবার এই নবজাত শিশুর পিতা ইন্তেকাল করেন। আর আল্লাহ তায়ালা পূর্বের রীতির বিপরীতে ইমরানের স্ত্রীর মানত কবুল করে নেন। তৎকালীন যুগের উত্তম ব্যক্তি হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামকে এ মেয়ের ভরণ-পোষণ ও দেখাশোনার জন্য নির্বাচন করেন।

হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম একদিন তাকে অসময়ে ফল (মৌসুমি ফল নয়) খেতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, মরিয়াম- তোমার কাছে এই রিজিক কোথেকে এলো? তিনি উত্তর দেন যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে। নিশ্চয় তিনি যাকে চান তাকে অগুনতি রিজিক দান করেন। (৩৭)

দ্বিতীয় ঘটনা

নিষ্পাপ মেয়ের ঈমানি জবাব শুনে হযরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের অন্তর সন্তানের জন্য ব্যকুল হয়ে ওঠে। অথচ তার বয়স একশরও বেশি ছিল। স্ত্রীও ছিলেন বৃদ্ধ। বাহ্যিক উপকরণ না থাকা সত্ত্বেও অত্যন্ত বিনয়াবনত হয়ে তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন যে, হে আমার প্রতিপালক, আপনি আপনার একান্ত অনুগ্রহে আমাকে নেককার সন্তান দান করুন। নিশ্চয়ই আপনি দোয়া কবুলকারী। (৩৮)

আল্লাহ তায়ালা ভগ্ন হৃদয়ের দোয়া কবুল করেন। আল্লাহ তাকে চার গুণবিশিষ্ট এক সন্তানের সুসংবাদ দান করেন।

১. তিনি কালিমাতুল্লাহ তথা ঈসা আলাইহিস সালামকে সত্যায়ন করবেন এবং তার ওপর ঈমান আনবেন।

২. তাকওয়া, দুনিয়াবিমুখতা ও ইবাদতের ক্ষেত্রে তিনি সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন হবেন।

৩. তিনি অত্যন্ত নিষ্কলুষ হবেন। শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি বিয়ের প্রতি কোনোরূপ আগ্রহ বোধ করবেন না।

৪. তিনি নবী ও নেককারদের অন্তর্ভুক্ত হবেন। অতঃপর ইয়াহইয়া আলাইহিস সালাম জন্মগ্রহণ করেন।

তৃতীয় ঘটনা

হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম হচ্ছে তৃতীয় শিক্ষণীয় বিষয়। যদি হযরত মরিয়াম আলাইহাস সালাম ও ইয়াহইয়া আলাইহিস সালামের জন্মগ্রহণের ঘটনায় বিস্ময়কর ও আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন থেকে থাকে, কেননা তাদের উভয়ের পিতাই ছিলেন বৃদ্ধ, তা হলে হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের বিষয়টি আরও অধিক বিস্ময়কর। কেননা পিতা ছাড়া অলৌকিকভাবে তার জন্ম হয়েছিল। ফেরেশতারা যখন মরিয়াম আলাইহাস সালামকে সন্তান জন্মের সংবাদ দেয় তখন তিনি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন, কীভাবে আমার সন্তান হবে; অথচ কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি!

আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে উত্তর দেওয়া হয়েছে এভাবেই, আল্লাহ যা চান তা সৃষ্টি করেন। যখন তিনি কোনো কাজের ফয়সালা করেন তখন তিনি বলেন, হয়ে যাও আর তা হয়ে যায়। (৪৭)

ঈসা আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা বহু মুজিজা দান করেছিলেন। কিন্তু এসব মুজিজা দেখা সত্ত্বেও ইহুদিদের ঈমান আনার সৌভাগ্য হয়নি; বরং তারা তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা তাকে তাদের হাত থেকে রক্ষার ফয়সালা করেছিলেন। সকলেই জানে যে, আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা বাস্তবায়িত হয়েছিল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তারা চক্রান্ত করেছিল। আল্লাহ কৌশল অবলম্বন করেছিলেন আর আল্লাহ হচ্ছেন সর্বোত্তম কৌশল প্রণয়নকারী।’ (৫৪)

খ্রিষ্টানরা দাবি করে যে, তারা ঈসা আলাইহিস সালামকে শূলীতে চড়িয়ে কবরে দাফন করে দিয়েছে, নাউজুবিল্লাহ। এরপর তিনি কবর থেকে উঠে আসমানে চলে গেছেন এবং আরশে আসন গ্রহণ করেছেন।

ভারতবর্ষের মিথ্যা নবুওয়াতের দাবিদার এক গোষ্ঠী দাবি করেছে যে, তিনি আহত হয়েছিলেন মাত্র। তাকে মৃত মনে করে কবরে দাফন করে দেওয়া হয়েছে। তার শিষ্য ও অনুসারীরা সেবা-শুশ্রূষা করে তাকে সুস্থ করে তোলে। এরপর তিনি হিজরত করে কাশ্মীর চলে যান। সেখানে তার মৃত্যু হয়। এসবের বিপরীতে কোরআন এবং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের সর্বসম্মত বিশ্বাস হচ্ছে— তাকে জীবিত অবস্থায় আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কেয়ামতের আগে তিনি আসমান থেকে অবতরণ করবেন। এরপর অবশিষ্ট জীবন পূর্ণ করবেন এবং তারপর তার স্বাভাবিক ইন্তেকাল হবে।

ইরশাদ হচ্ছে, আর স্মরণ করো, যখন আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈসা, আমি তোমাকে নিরাপদে ফিরিয়ে নেব এবং তোমাকে নিজের কাছে (আসমানে) তুলে নেব। কাফেরদের থেকে তোমাকে পবিত্র করে দেব। আর যারা তোমার অনুগত রয়েছে, তাদেরকে কেয়ামতের দিন পর্যন্ত তোমার অস্বীকারকারীদের ওপর জয়ী করে রাখবো। (৫৫)

নাজরানের খ্রিষ্টানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আলোচনার জন্য মদিনায় এসেছিল। যখন সকল দলিল-প্রমাণ শোনা সত্ত্বেও তারা সত্য স্বীকার করে নেয়নি, আল্লাহ তায়ালার হুকুমে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে মুবাহালার দাওয়াত দেন। অর্থাৎ তোমরা নিজেদের পরিবার-পরিজন নিয়ে এসো, আমি আমার পরিবার-পরিজন নিয়ে আসি। এরপর আমরা সকলে মিলে বিনয়াবনত হয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যে, আমাদের মধ্যে যে মিথ্যাবাদী তার ওপর আল্লাহর লানত বর্ষিত হোক। (৬১)

খ্রিষ্টানদের ষাট সদস্যের এ প্রতিনিধিদলে চোদ্দজন সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ছিল। কিন্তু তাদের কেউ-ই মুবাহালার জন্য প্রস্তুত হয়নি; বরং তারা রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজিয়া দিতে সম্মতি প্রদান করে।

এক কালিমার প্রতি আহ্বান

এই ঘটনা বর্ণনা করার পর সূরা আলে ইমরানে ইহুদি-খ্রিষ্টান নির্বিশেষ সকল আহলে কিতাবকে এমন এক বিষয়ের প্রতি আহ্বান করা হয়, যা মানার জন্য যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল ও চার আসমানি কিতাব এবং সহিফাসমূহে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সে বিষয়টি হচ্ছে, কালিমায়ে তাওহিদ-লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তথা আমরা আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদত করবো না। (৬৪)

ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বদ-অভ্যাস, ধর্মবিমুখতা, মিথ্যাচার, অপবাদ আরোপ ইত্যাদি উল্লেখ করার পর সূরা আলে ইমরান বলছে- আল্লাহ তায়ালা সকল নবী-রাসূল থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, যদি তাদের জীবদ্দশায় কোনো রাসূল (শেষনবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আগমন করেন তা হলে তোমরা সকলে অবশ্যই তার ওপর ঈমান আনবে এবং তাকে সাহায্য করবে। (আর যদি তোমাদের জীবদ্দশায় তিনি না আসেন তা হলে তোমাদের উম্মতদের জন্য তার অনুসরণ এবং তার ওপর ঈমান আনতে হবে।) (৮১)

নবীদের থেকে অঙ্গীকারগ্রহণ তাদের উম্মতদের থেকেই অঙ্গীকারগ্রহণের নামান্তর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এসকল নবীর উম্মতেরা অঙ্গীকার পূরণ করেনি। তারা নবীকে সত্যায়ন এবং তার সাহায্য করার পরিবর্তে তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে এবং তার বিরোধিতা করেছে।

এ আয়াতের মাধ্যমে বোঝা যায় যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন সাইয়িদুল আমবিয়া তথা নবীগণের সরদার। তৃতীয় পারার শেষে এ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে যে, ঈমান ও কুফর বিপরীতমুখী বিষয়, যা কখনো একত্র হতে পারে না। এ কারণে যারা ঈমান আনার পর মুরতাদ হয়ে যায়, হেদায়েতের উপর গোমরাহিকে প্রাধান্য দেয় এবং এর উপরই যাদের মৃত্যু হয়, তাদের কঠোরভাবে নিন্দা করা হয়েছে।

চলবে, ইনশাআল্লাহ...

লেখক: খতিব বাইতুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/১৩মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :