ধারাবাহিক তাফসির, পর্ব-২

আল্লাহর আনুগত্যই ইবাদতের মর্মবাণী

মুফতি আরিফ মাহমুদ হাবিবী
| আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২৪, ২০:২৩ | প্রকাশিত : ১৩ মার্চ ২০২৪, ১৯:৫৬

প্রিয় পাঠক, আজ আমরা পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় পারার নির্বাচিত অংশ থেকে কোরআনকে জানার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।

প্রথম পর্ব: এসো রমজানে কোরআনকে জানি

দ্বিতীয় পারার সূচনা হয়েছে কেবলা পরিবর্তনের আলোচনা দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় যাওয়ার পর প্রায় ষোলো মাস বাইতুল মাকদিসের অভিমুখী হয়ে নামাজ পড়েছেন। কিন্তু তার মনের ইচ্ছা ছিল কাবাকে যেন মুসলমানদের কেবলা বানানো হয়, যা মিল্লাতে ইবরাহিমের এক সুস্পষ্ট নিদর্শন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতেই কেবলা পরিবর্তনের হুকুম অবতীর্ণ হয়।

এরপর মুশরিক ও মুনাফিকরা বিভিন্ন ভিত্তিহীন আপত্তি ওঠাতে থাকে। ইহুদিরা এক্ষেত্রে বরাবর ছিল একধাপ এগিয়ে। তারা খুব আশ্চর্য হয়ে বলত, ‘তারা (মুসলিমরা) যে দিকে মুখ করে ইবাদত করত তাদেরকে সেই কেবলা থেকে কোন জিনিস ফিরিয়ে দিলো!’ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল তাদের হঠকারিতামূলক আপত্তি।

আল্লাহ তায়ালা তার নবীকে বলেন, ‘আপনি তাদের বলে দিন পূর্ব-পশ্চিম সকল দিকই আল্লাহর। আল্লাহর ইচ্ছা, তিনি যেদিককে চান তাকেই কেবলা বানাতে পারেন।’ স অর্থাৎ সকল দিকই আল্লাহর অধীন। আলাদাভাবে কোনো দিকের শ্রেষ্ঠত্ব নেই অন্য দিকের ওপর। তেমনিভাবে কোনো দিক আলাদাভাবে কেবলা হওয়ার যোগ্যতাও রাখে না; বরং আল্লাহর হুকুমেই কোনো দিক কেবলা হতে পারে। তাই কেবলা পরিবর্তনের ব্যাপারে তাদের এসব আপত্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।

তেমনিভাবে কোনো দিকে মুখ ফেরানোও গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়; বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আল্লাহর হুকুম মান্য করা, তিনি যেদিকে বলেন সেদিকে মুখ ফেরানো।

এসব আয়াত অধ্যয়নের মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব রক্ষার বিষয়টি বুঝে আসে। তিনি অধীর আগ্রহ এবং অপেক্ষায় বারবার আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করা সত্ত্বেও কখনো কেবলা পরিবর্তনের আবেদন করেননি। কেননা হতে পারে কেবলা পরিবর্তন না করাই আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা। সম্ভবত এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা কেবলা পরিবর্তনের বিধান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুমিনদের সেই মহান নেয়ামতের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, যা তারা পেয়েছে উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে প্রেরিত মূহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। কেবলা পরিবর্তন একটি বড় স্বতন্ত্র ইহসান। আর হেদায়েতের জন্য মহান রাসূল প্রেরণও নজিরবিহীন ইহসান। (১৫১)

প্রকৃত পুণ্যের মানদণ্ড

কেবল্য পরিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনার ইতি টানতে গিয়ে এক চূড়ান্ত নীতি বলে দেওয়া হয়েছে। যার সাবমই হলো— সাওয়াবের মানদণ্ড পূর্ব-পশ্চিম নয়, বরং তার মানদণ্ড হচ্ছে আকিদা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক ও লেনদেন, সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি মনোনিবেশ করা। আল্লাহ তায়ালাকে সন্তোষ্ট করার জন্য শুধু চেহারাই নয়, বরং অন্তর ও গোটা জিন্দেগির পথের রোখ পরিবর্তন করা আবশ্যক। আল্লাহ বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে মুখ ফেরানো পুণ্যের কাজ নয়; বরং প্রকৃত পূণ্যের কাজ হচ্ছে ঈমান আনয়ন করা। (১৭৭)

এই আয়াতের প্রতি আলেমগণ অনেক বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন। এর থেকে তারা প্রায় ষোলোটি মূলনীতি বের করেছেন। আয়াত থেকে এটিও প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম ধর্ম খানকায় পালিত নিছক কিছু রীতিনীতির নাম নয়। বরং জীবনের প্রতিটি অঙ্গনের সঙ্গে এর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। ঘর, বাজার, মসজিদ, মাদরাসা, রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেনসহ সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিধান রয়েছে। জীবনের প্রতি ক্ষেত্রেই ইসলাম বিভিন্ন বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। মুসলমানদের জন্য প্রতি কদমে তার অনুসরণ করা আবশ্যক। এই আয়াতকে সাওয়াব সংক্রান্ত আয়াত বলা হয়।

সাওয়াবের বিস্তারিত মূলনীতি

ইতিপূর্বে সংক্ষিপ্তভাবে সাওয়াবের মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে, সামনে সে- সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এতে ইসলামের পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক খুটিনাটি বিধান উঠে এসেছে। পাশাপাশি জিহাদ ও কিতালের বিধানও এতে আলোচিত হয়েছে। সামনে আমরা সংক্ষেপে এসব বিধান উল্লেখ তুলে ধরছি (এর মধ্যে দুটি বিধান آية البر এর পূর্বের আয়াতের) :

১. জাহেলি যুগে সাফা-মারওয়া পাহাড়ে দুটি মূর্তি ছিলো, মুশরিকরা যার পূজা করত। এ কারণে ইসলাম কবুল করার পর সাহাবিরা সাফা-মারওয়ার তাওয়াফ থেকে বিরত থাকতেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে যে, সাফা-মারওয়ার তাওয়াফ করতে কোনো সমস্যা নেই। (১৫৮)

২. মুশরিকরা নিজেদের পক্ষ থেকে কিছু জিনিস হালাল, অপর কিছু জিনিস হারাম মনে করত। তাদের এ কাজটি খণ্ডন করে বলা হয়েছে, যা তোমরা হারাম সাব্যস্ত করো, তা হারাম নয়; বরং আল্লাহ তায়ালা তো হারাম করেছেন মৃত জীবজন্ত, প্রবাহিত রক্ত, শূকরের গোশত এবং যেসব প্রাণী আল্লাহ ছাড়া অন্যকারও নামে উৎসর্গ করা হয়েছে।

তবে যদি কেউ ক্ষুধার তাড়নায় বাধ্য হয়ে উল্লিখিত কোনো বস্তু খেয়ে ফেলে, আর তার উদ্দেশ্য স্বাদ আস্বাদন না হয় এবং সে (প্রয়োজনের অতিরিক্ত) সীমালংঘন না করে; (বরং সে পরিতৃপ্ত না হয়ে ক্ষুধা মিটে যাওয়া পরিমাণ খায়) তা হলে সে গুনাহগার হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল এবং দয়ালু। (১৭৩)

৩. ইসলামি শরিয়তের ভিত্তি হচ্ছে ইনসাফ। এই কারণে মুসলমানদের কিসাসের বিধান দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ নিহত ব্যক্তির ওয়ারিশগণ বদলা হিসাবে হত্যাকারী থেকে কিসাস গ্রহণের দাবি তুলতে পারবে; নিহত ও হত্যাকারীর মাঝে সমাজ, বংশ, অর্থ ও শরীরের দিক থেকে যত পার্থক্যই থাকুক না কেন।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোরআনি দণ্ডবিধি কার্যকর হলে অপরাধের শাস্তি বাস্তবায়িত হওয়ার ব্যাপারে মানুষ নিশ্চিত হবে। ফলে প্রচণ্ড রাগান্বিত হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে হত্যাকাণ্ডে জড়ানো থেকে বিরত রাখবে। আর হত্যাকারী তার অপরাধ হতে বিরত হলে নিরপরাধ ব্যক্তি তার বংশ পরস্পর রক্তপাত, হত্যাকাণ্ডে জড়ানো থেকে বেঁচে যাবে। ইসলাম হত্যার শাস্তি কিসাসে ইনসাফ ও রহমত একত্র করেছে। নিহত ব্যক্তির অভিভাবক ও উত্তরসূরিরা যদি কিসাসের দাবি করে তা হলে এটা হবে ইনসাফ। আর যদি তারা মাফ করে দেয় কিংবা দিয়ত (মুক্তিপণ) গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যায় তা হলে এটা হবে অনুগ্রহ ও রহমত। (১৭৮-১৭৯)

৪. যদি কেউ অর্থ-সম্পদ রেখে যায়, তা হলে যখন তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসবে, তখন তার জন্য সম্পদের ব্যাপারে অসিয়ত করে যাওয়া আবশ্যক। (১৮০)

৫. প্রত্যেক বিবেকবান ও প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের উপর রোজা রাখা ফরজ। যদি কোনো ব্যক্তি সকল আদবের প্রতি লক্ষ রেখে রোজা রাখে তা হলে রোজা তার মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি করার পাশাপাশি মানবীয় বৈশিষ্ট্যসমূহও জাগ্রত করে তুলবে। রমজান মাসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এই মাসে মহান কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে।

৬. রমজান মাসে রাতে স্ত্রী-সহবাস জায়েজ আছে; তবে ইতেকাফ অবস্থায় জায়েজ নেই। (১৮৬-১৮৭)

৭. চুরি-ছিনতাই, সুদ-জুয়া, অবৈধ পন্থায় ক্রয়-বিক্রয় এবং বাতিল ও অবৈধ পদ্ধতিতে ধনসম্পদ উপার্জন করা নাজায়েজ। (১৮৮)

৮. চান্দ্র মাসের হিসাব রাখা ফরজে কেফায়া এবং ইসলামের শিয়ার। এর ওপর বহু ইবাদাত নির্ভরশীল। (১৮৯)

৯. জিহাদ করা মুসলমানদের উপর ফরজ। জিহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করা। যেহেতু পৃথিবীর শুরুকাল থেকেই হক-বাতিল, কল্যাণ- অকল্যাণের মধ্যে লড়াই চলে আসছে এবং তা চলতে থাকবে; তাই জিহাদও সর্বকাল ছিল এবং থাকবে। মুসলমানদের জন্য আবশ্যক হল তারা সর্বদা জিহাদের জন্য প্রস্তুত থাকবে। শত্রুর সামনে কখনো দুর্বলতা প্রকাশ করবে না। (১৯০-১৯৫)

১০. ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রোকন হচ্ছে হজ। আল্লাহ তায়ালা চান গোটা পৃথিবী থেকে মুসলমানরা বছরে একবার ইসলামি সমতা ও ঐক্যের প্রকাশ্য প্রদর্শনীর মাধ্যমে বালাদুল হারামে একত্র হবে। সেখানে তার বর্ণিত পদ্ধতিতে হজের বিধান পালন করবে। নির্দিষ্ট কয়েক মাসেই হজের ইহরাম বাঁধা যায়।

তবে উমরা পালন করা যায় বছরের যেকোনো সময়। হজের দিনগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয় করা জায়েজ আছে।

জাহেলি যুগে হজকে কেন্দ্র করে মুশরিকরা বিভিন্ন কুসংস্কার ও বিদআতে লিপ্ত হতো। যার মধ্যে একটি হলো, কুরাইশরা মুজদালিফায় অবস্থান করত। আরাফার ময়দানে যাওয়াকে নিজেদের জন্য হীন জ্ঞান করত। তাদের বলা হয়; তারা যেন নিজেদের বিশেষ কিছু মনে না করে বরং অন্যান্য মানুষের মতো তারাও আরাফার ময়দানে অবস্থান করে। এছাড়াও মুশরিকরা মিনায় একত্র হয়ে নিজেদের পিতৃপুরুষের বিভিন্ন কীর্তিগাথা বর্ণনা করত। তাদের বলা হয় যে, তারা যেন পিতৃপুরুষের পরিবর্তে আল্লাহ তায়ালার জিকির করে। (১৯৬-২২০)

১১. আল্লাহর রাস্তায় খরচের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, কী খরচ করা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এটা নয়; বরং গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কোথায় খরচ করা হলো এবং কোন নিয়তে খরচ করা হলো। তাই আল্লাহর দেওয়া জান-মাল সঠিক পথে ও ইখলাসের সাথে খরচ করা আবশ্যক। (২১৫)

১২. যে-ব্যক্তি মুরতাদ হয়ে যায় তার সমস্ত আমল বাতিল হয়ে যায়। সে জাহান্নামি বলে সাব্যস্ত হয়। দুনিয়ায় তার শাস্তি হচ্ছে বোঝানোর পরও যদি সে ফিরে না আসে তা হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। (২১৭)

১৩. মদ-জুয়ার মধ্যে বাহ্যিক কল্যাণ থাকলেও দেহ, মেধা, অর্থ-সম্পদ এবং চরিত্র ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এতে বহুবিধ ক্ষতি রয়েছে, উপকারের চেয়ে যার পরিমাণ অনেক বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদকে উন্মুল খাবায়িস অর্থাৎ সকল অনিষ্ট ও গুনাহের মূল বলে উল্লেখ করেছেন। (২১৯)

১৪. সামাজিক সমস্যা উল্লেখ করার পর কিছু পারিবারিক মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে। কেননা পরিবারই হচ্ছে সমাজের মূল। শুরুতে বৈবাহিক সম্পর্কের মাসআলা বর্ণনা করা হচ্ছে।

প্রথমে বিধান দেওয়া হয়েছে যে, কোনো মুশরিক পুরুষ ও নারীকে কখনোই বিয়ে করা যাবে না।(২২১)

তবে আহলে কিতাব নারীদের বিয়ে করা যাবে। তবে উত্তম হচ্ছে আহলে কিতাব নারীদের বিয়ে করার পরিবর্তে মুসলিম নারীদের বিয়ে করা।

কোরআনের এ বিধান থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে বৈবাহিক সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে ধর্ম ও চরিত্র; শুধু বংশ, ধনাঢ্যতা, সৌন্দর্য নয়। কেননা এগুলো সাময়িক। এগুলো প্রকৃত শান্তি ও সুখের মাধ্যম নয়। তবে পারিবারিক জীবনের সফরে যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের জন্য এ সফরের ঘাটিগুলো সহজ করে দেন। এই কারণে আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেককার স্ত্রীকে মূল্যবান ধনভাণ্ডার বলে ব্যক্ত করেছেন।

১৫. হায়েজ অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করা জায়েজ নেই। কেননা হায়েজের রক্ত সম্পূর্ণ নাপাক। তাতে মারাত্মক জীবাণু রয়েছে। এ সময় সহবাসের ফলে স্বামী- স্ত্রী উভয়ই অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। তবে স্পর্শ করা, চুম্বন করা, একসাথে ওঠাবসা করা ও পানাহার করা বৈধ। অথচ ইহুদিরা এটাকে অবৈধ মনে করত। পক্ষান্তরে খ্রিষ্টানরা সহবাস করাকেও খারাপ কিছু মনে করত না। বাড়াবাড়ি ও শিথিলতার পরিবর্তে অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো ইসলাম এক্ষেত্রেও মধ্যমপন্থা অবলম্বন করেছে। (২২২-২২৩)

১৬. যদি কোনো ব্যক্তি শপথ করে যে, সে চার মাস স্ত্রীর সাথে সহবাস করবে না তা হলে চার মাস অতিবাহিত হওয়ার পর স্ত্রী আপনা-আপনি একটি বায়েন তালাকপ্রাপ্ত হয়ে যাবে। এ সময়ের মধ্যে যদি স্বামী তাকে ফিরিয়ে নেয়, তা হলে বিবাহ বহাল থাকবে। তবে তার জন্য কসমের কাফফারা দেওয়া আবশ্যক হবে। (২২৬-২২৭)

১৭. সুরা বাকারায় যতটা বিস্তারিতভাবে তালাক, ইদ্দত পালন এবং দুধপান (রাজাআত) এর মাসআলা বর্ণনা করা হয়েছে, অন্য কোনো সূরায় তা বর্ণনা করা হয়নি। তাই এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ তায়ালার নিকছু তালাক ঘৃণ্য বিষয় হওয়া সত্ত্বেও বিশেষ অবস্থায় একান্ত অপারগতার ক্ষেত্রে তার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কেননা কখনো স্বামী-স্ত্রী দুজনের মাঝে কেউ এমন হয়, যে নিজের বদচরিত্র, মন্দ ও উদ্ধত আচরণের মাধ্যমে ঘরকে জাহান্নামে (অশান্তিতে) পরিণত করে। সেখানে শান্তির কোনো নাম-গন্ধ থাকে না। এমন ক্ষেত্রে তালাক ছাড়া কোনো রাস্তা থাকে না।

ইসলাম তালাকের অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি তাতে বিভিন্ন সংশোধনীও এনেছে। জাহেলি যুগে এর কোনো নির্দিষ্ট সংখ্যা ছিল না। শত শত তালাক দেওয়া সত্ত্বেও স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনা যেত; কিন্তু ইসলাম তিনের অধিক তালাকের অনুমতি প্রদান করেনি। দুই তালাক পর্যন্ত ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু তৃতীয় তালাকের পর ফিরিয়ে আনার কোনো সুযোগ থাকে না। (২২৯)

১৮. তালাক দেওয়ার পর স্বামী স্ত্রীকে মোহর হিসেবে যা দিয়েছে, তা ফিরিয়ে নিতে পারবে না; তবে খোলার ক্ষেত্রে এর অনুমতি রয়েছে। খোলা অর্থ— তার পূর্ণ মোহর বা মোহরের কোনো অংশ এই শর্তে স্বামীকে দেওয়া বা (মোহর পরিশোধ না করে থাকলে) মাফ করে দেওয়া যে, স্বামী তাকে তালাক দিয়ে দেবে। উল্লেখ্য, খোলার ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের সন্তুষ্টি আবশ্যক। (২২৯)

১৯. তিন তালাকপ্রাপ্ত কোনো নারী যদি বিচ্ছেদের পর ইদ্দত পালন শেষে পুনরায় অন্য কোনো পুরুষকে বিয়ে করে (প্রথম স্বামীর সাথে কোনো ধরনের চুক্তি না করে) তার সাথে ঘর-সংসার করতে থাকে, এরপর হঠাৎ অযাচিত কোনো কারণে তাদের মনের মিল না হওয়ায় তালাক হয়ে যায়, অথবা এই স্বামী মারা যায়, তা হলে মহিলা ইদ্দত পালনের পর চাইলে পুনরায় প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। একে হালালা বলা হয়। (২৩০)

আজকাল হালালার নামে যে নাটক করা হয়, এতে হালালাকারী ও যার জন্য হালালা করা হয়, তারা উভয়ে হাদিসে উল্লিখিত লানতের উপযুক্ত হবে। হাদিসে এই জাতীয় চুক্তির স্বামীকে ধার করা পাঠা আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

২০. নারীকে ভোগান্তিতে ফেলার জন্য তালাকের পর তাকে ফিরিয়ে আনা জায়েজ নেই। (২৩১)

২১. ইসলাম ইনসাফ ও ইহসানের ধর্ম, যা শিশু, বৃদ্ধ, পুরুষ কিংবা নারী কারো ওপর জুলুমের অনুমতি দেয় না। তাই ইসলাম দুধপানকারী শিশুরও অধিকার প্রদান করেছে। আজ ঢাকঢোল পিটিয়ে বলা হচ্ছে যে, মায়ের দুধের কোনো বিকল্প নেই। আর ইসলাম অনেক আগেই মায়েদের জন্য শিশুদের দুধ পান করানোর বিধান দিয়েছে; অথচ গোটা বিশ্বই তখন মূর্খতার অন্ধকারে ডুবে ছিল। মায়ের দুধের উপকারিতার কথা যখন কারো জানা ছিল না।

এমনকি যদি কোনো কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে যায় তবু দুধের শিশুর লালনপালন এবং তাকে দুধ পান করানোর অধিকার মায়েরই। নিষ্পাপ শিশুকে তালাক ও বিচ্ছিন্নতার শাস্তি দেওয়া জায়েজ হবে না। (২৩৩)

২২. তালাকপ্রাপ্ত হলে কিংবা স্বামী মারা গেলে উভয় ক্ষেত্রেই স্ত্রীর জন্য ইদ্দত পালন করা আবশ্যক। তালাকের ইদ্দত হচ্ছে তিন হায়েজ। আর স্বামী মৃত্যুর ইদ্দত চার মাস দশ দিন। (২২৮-২৩৪)

২৩. ইদ্দত পালনকালে কোনো মহিলাকে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া জায়েজ নেই। তবে অন্তরে ইচ্ছা পোষণ এবং ইঙ্গিত করার অবকাশ রয়েছে। (২৩৫)

২৪. গোষ্ঠী ও সমাজ সংশোধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এর জন্য হক এবং হকের সহযোগী ব্যক্তিবর্গের বিদ্যমান থাকা আবশ্যক। জিহাদের উদ্দেশ্যই হচ্ছে হক এবং হকের পতাকা উড্ডীন রাখা; এ কারণে কোরআনুল কারিমে জিহাদের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মৃত্যুভয়ে যারা জিহাদ থেকে পলায়ন করে, তাদের কঠোর ভাষায় তিরস্কার করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে পূর্ববর্তী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ঘটনাও বিবৃত হয়েছে।

দুটি ঘটনা

এখানে দ্বিতীয় পারার শেষদিকে দুটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম ঘটনা হচ্ছে ওই সম্প্রদায়ের, যারা প্লেগ মহামারি থেকে বাঁচার জন্য ঘরবাড়ি ছেড়ে পলায়ন করেছিল। কিন্তু এতে তারা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে পারেনি। এ ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে, মানুষের কোনো চেষ্টা-প্রচেষ্টাই তাকে তাকদিরের ফয়সালা থেকে বাঁচাতে পারে না।

দ্বিতীয় ঘটনা বনি ইসরাইল ও হজরত তালুতের, যার নেতৃত্বে জিহাদের গুণাবলিতে পরিপূর্ণ ছোট্ট দল অনেক বড় বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। এই ঘটনা শুধু বনি ইসরাইলের কিছু বিশেষ ব্যক্তিই জানত। সাধারণ মানুষ তা জানত না। উম্মি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখে ইতিহাসের এই বিস্মৃত দাস্তানের বর্ণনা দেওয়াই বলে দেয় যে, তার সম্পর্ক সে মহান সত্তার সঙ্গে, যার দৃষ্টি থেকে ইতিহাসের সামান্য থেকে সামান্যতর বিষয়ও এড়িয়ে যেতে পারে না।

এর দ্বারা এটাও বোঝা যায় যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রকৃত সত্যনবী। এ কারণে এ ঘটনার শেষে বলা হয়েছে, ‘এটা হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার নিদর্শন। আমি আপনাকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে শোনাচ্ছি এবং নিঃসন্দেহে আপনি আমার রাসুলদের একজন।’ (এটাই দ্বিতীয় পারার শেষ আয়াত)।

লেখক: খতিব বাইতুল আমান জামে মসজিদ, মিরপুর-০১।

(ঢাকাটাইমস/১৩মার্চ/এসআইএস)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :