স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা

স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের অভিযোগ অনেক। অভিযোগ এ জন্য- যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম- তা কি পূর্ণ হয়েছে? অনেককিছুই হয়নি। কেন হয়নি- সেই প্রশ্ন করা দরকার। কারণ এতকিছু হতে পারলে, সাম্যবাদ ও মানবতাবাদ এই দেশে শক্তি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারতো।
মহামহিম লেনিন প্রাভদা নং ১০২-এ লিখেছিলেন- ‘বর্তমানে সমাজে বহু প্রকার দারিদ্র্য ও নিপীড়নকে আড়াল করে রেখেছে- যা প্রাথমিকভাবে চোখে পড়ে না। কর্ম সময়ে, কর্মস্থল ও পরিবার উভয়কে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে গিয়ে দরিদ্র ও শহুরে বিচ্ছিন্ন পরিবারগুলো- শিল্পী, শ্রমিক, কর্মকর্তা এবং ছোটো ছোটো অফিস কর্মচারীরা তাদের জীবনে অবিশ্বাস্য রকম অসুবিধায় বসবাস করছে। মিলিয়ন মিলিয়ন নারী এরূপ পারিবারিক জীবনে গৃহদাসী হিসেবে দিনাতিপাত করে আসছে। পরিবারের সামর্থানুসারে তাদের খাদ্য, কাপড় ও অন্যান্য বিষয়ে অর্থ খরচ করেই সম্পাদন করা হয়, শুধু তারা নিজেদের পারিশ্রমিকটিই পান না। পুঁজিপতিরা তাদের প্রয়োজনে নারীদের নিয়োগ দান করে খুবই অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। তারাও নিয়োজিত হয় ভাত-কাপড় ও নিজেদের কিছু অতিরিক্ত আয়ের জন্য।’
শুধু প্রাচ্যে কেন, পাশ্চাত্যে এই চিত্র এখনো চোখে পড়ার মতো। আর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর কথা না হয় বাদই দিলাম। গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে জেন্ডার ইস্যুগুলোই প্রকৃত সমাধান করতে পারবে না এবং তা সত্যিকার কৌশলও নয়। নারী মুক্তির জন্য সর্বাগ্রে বুঝতে হবে নারী নিপীড়নের গভীরতর সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলো যা জেন্ডারভিত্তিক শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জেন্ডার ইস্যু ও শ্রেণির প্রশ্নের আন্তঃসম্পর্কের মীমাংসাই আমাদের নারী স্বাধীনতার সংগ্রামে সফলতা এনে দিতে পারে। বিষয়গুলো আমি এ জন্য বলছি, আমাদের সামাজিক স্বাধীনতার যে বলয়- তার অন্যতম খুঁটি হচ্ছেন নারী সমাজ। সে নারীদের ভূমিকা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল অত্যন্ত উজ্জ্বল।
আমি একটি প্রশ্ন সবসময়ই নিজেকে করি। তা হলো- একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছেন? বিশেষ করে মার্চ-ডিসেম্বর এলেই আমরা তা অনেকভাবে খুঁজে দেখি। মনে পড়ছে বেশ কয়েক বছর আগের কথা। দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণির বিকাশের দিকে নজর দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রবীণ রাজনীতিক ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ক্রমবর্ধমান হারে লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণি ভেঙে গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া শ্রেণির উদ্ভব হচ্ছে। অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদের মতে, রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ব্যক্তি পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় পুঁজি গঠন সম্ভব। তিনি বাংলাদেশে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ এবং জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বাধাগ্রস্ত না করারও অনুরোধ করেছিলেন। তার এ বক্তব্যটি পড়ে আমার বারবার মনে হয়েছে, কিংবদন্তিতুল্য এ রাজনীতিক ধনিক শ্রেণির একটি নতুন শ্রেণিবিন্যাস করতে চেয়েছিলেন। তিনি সেই শ্রেণিকে সাধারণ মানুষের সঙ্গে পরিচয় করে দিতে চেয়েছিলেন।
একাত্তর পূর্ববর্তী সময়ে এ ভূখণ্ডে কারা ছিল ধনিক শ্রেণি? এবং তাদের মূল কর্মকাণ্ডের স্বরূপ কেমন ছিল? এ বিষয়টি রাষ্ট্রের মানুষের মোটেই অজানা নয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিক শ্রেণির মধ্যে একটি সখ্য সব সময়ই ছিল। ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যে, লেনদেনে, দান-খয়রাতে, এমনকি রাষ্ট্রীয় লবিং পর্যায়েও। যারা নিতান্তই শ্রমজীবী মানুষ ছিলেন, তারা এ ধনিক শ্রেণির নিষ্পেষণের শিকার ছিলেন সবদিক থেকেই। ফ্যাক্টরি, ইন্ডাস্ট্রি, কলকারখানা পরিচালনায় এদের মৌলিক মিল সেটাই প্রমাণ করে।
আমরা জানি, বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রামে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তারা ছিলেন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব। এর কারণ কী? কারণ পশ্চিমা শোষণের শিকার আগের বুর্জোয়া শ্রেণি কখনোই হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তানের আদমজীরা পূর্ব পাকিস্তানে জুট মিল করেছে এ অঞ্চলের ধনীদের সায় নিয়েই। ফলে বৈষম্য ছিল ধনী ও দরিদ্রের। মহান মুক্তিসংগ্রাম সাধিত হয়েছিল সেই লুটেরা শ্রেণিকে তাড়ানোর জন্যই। আর এর নেতৃত্ব এসেছিল তৃণমূল থেকে। শেখ মুজিব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলীরা ছিলেন সেই শোষিত মানুষের কণ্ঠস্বর। এ অঞ্চলের মানুষের প্রত্যয়ের প্রতিভূ। মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিতও হয়েছিল সেই আলোকে।
আর এ সশস্ত্র যুদ্ধটি করেছিল কারা? হাফপ্যান্ট কিংবা লুঙ্গি পরে, গায়ে ছেঁড়া গেঞ্জি নিয়ে যারা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল- তাদের প্রকৃত পরিচয় কী? তারাই মুক্তিসেনা। তারাই গেরিলা। তারা আদেশ পালনে এতটাই ব্রতী ছিলেন যে, সে সময়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমি ছাড়া আর কিছুই তাদের আরাধ্য ছিল না।
বাঙালির বিজয় এসেছিল সেই চেতনায়। সেই আলোর দীপ্তি ছড়িয়ে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গোটা দেশেই ভেঙে পড়ে অর্থনৈতিক অবকাঠামো। এ সময়ে একটি সুবিধাবাদী চক্র ফায়দা তোলার চেষ্টায় লিপ্ত হয় ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে। বাহাত্তর থেকে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্ট- সময় মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ সময়ে বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রীয় ভিত কাঁপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। যারা একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল, সেই শক্তিটি কলকাঠি নাড়তে থাকে সর্বশক্তি দিয়ে। ঘটে যায় ১৫ই আগস্টের নির্মম হত্যাযজ্ঞ।
লুটেরা ধনিক শ্রেণি- যারা কিছুটা ঘাঁপটি মেরে বসেছিল, তাদের জন্য আসে যথেষ্ট সুযোগ। এরা এক ধরনের পেশিশক্তি, ধর্মান্ধতা, মানুষের মৌলিক ক্ষমতা হরণ ইত্যাদির আশ্রয় নিয়ে রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে নিজস্ব বাহু প্রতিষ্ঠায় লিপ্ত হয়। এমনকি গণতন্ত্রের নামে চলে এক ধরনের লুটেরা মনোবৃত্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতা।
সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে এ সময়ে গড়ে উঠেছে মূলত একটি ভোগবাদী ধনিক শ্রেণি। এরা সব লজ্জার মাথা খেয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের অর্থ আত্মসাৎই শুধু নয়, জনগণের মৌলিক অধিকার অংশেও তাদের দাঁত বসাচ্ছে এবং বসিয়েছে।
আজকের বাংলাদেশে জাতীয় ধনিক শ্রেণি কিংবা দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণি আমরা কাদের বলব? এর সংজ্ঞা কী? গত ২৫ বছরে বাংলাদেশে আবাসন, ব্যাংক, ক্লিনিক, ফোন কোম্পানি, বিমা, মিডিয়া, রপ্তানিজাত সামগ্রী, গার্মেন্টস প্রভৃতি সেক্টরে অনেক নতুন মহাজনের মুখ আমরা লক্ষ করি। এরা কারা? এদের পরিচয় কী? লক্ষ করলে দেখা যাবে, তারা কোনো না কোনোভাবে প্রধান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, সম্পৃক্ত। তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোও সেসব দলের তাঁবেদারি করে যাচ্ছে।
জনগণকে খুব অবাক হয়ে দেখতে হয়, রাষ্ট্রীয় সুবিধা নেওয়ার জন্য এ দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণি একই সুরে কথা বলে। এ প্রসঙ্গে আমি কিছু প্রশ্ন রাখতে চাই। যারা কোটি কোটি টাকা মুনাফার পরও রাষ্ট্রীয় কর ঠিকমতো দেয় না, আমরা কি তাদের দেশপ্রেমিক জাতীয় ধনিক শ্রেণি বলব? অধিক মুনাফা অর্জনের পরও যেসব প্রতিষ্ঠানের মালিক শ্রমিকদের ঠিকমতো বেতন-ভাতা দেয় না বরং শ্রমিকের রক্তে নিজ হাত রঞ্জিত করে- আমরা তাদের দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণি বলবো?
গোটা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর কোষাগারে বড়ো জোগান আসে ট্যাক্সের টাকা থেকে। বাংলাদেশে অনেক বড়ো বড়ো নামকরা ডাক্তার আছেন, যারা মাসে কোটি টাকা আয় করেন। তারা ট্যাক্স দেন না। এভাবে অনেক প্রাইভেট সেক্টরই রয়ে গেছে ট্যাক্স আওতার বাইরে। এটা জাতির জন্য লজ্জাজনক। লুম্পেন ধনতন্ত্রের প্রবক্তা হয়ে যারা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে ফায়দা নিতে চায়, প্রকৃত রাজনীতিকদের উচিত ছিল তাদের বয়কট করা। তারা এদের বয়কট তো করেনইনি বরং এদের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে নিজ নিজ দলের সংসদ সদস্য বানিয়েছেন। মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন। পুঁজিবাদী কোনো সভ্য দেশে এমন লেনদেনের নজির নেই। অথচ বাংলাদেশে তা প্রতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একটি উজ্জ্বল স্বপ্ন নিয়ে যে হতদরিদ্র মানুষটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, সে কেমন আছে কিংবা তার অবস্থার কী পরিবর্তন হয়েছে? আসলে তার অবস্থার কোনো পরিবর্তনই হয়নি। বরং সেসব মানুষ এখন হতদরিদ্র হিসেবে দিনাতিপাত করছে। কোথাও কাজ করেও তারা ন্যায্য শ্রমের মূল্যটুকু পাচ্ছে না।
অথচ এ ধনিক শ্রেণি সামান্য মনোযোগী হলে দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা, মেধাবী ছাত্র, বিধবা নারী কিংবা অনাথ কিশোর-কিশোরীর জন্য অনেককিছুই করতে পারতো। যারা রাষ্ট্রীয় টাকায় আমদানি করা গাড়ি নিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, যারা ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য জোটবদ্ধ হয়, তাদের কাছ থেকে গরিবের কল্যাণে কী আশা করা যেতে পারে?
মুক্তির যে সংগ্রাম বাংলাদেশে চলছে, এ সংগ্রাম নিরন্তর। আর এ সময়ে দেশের প্রতিটি মানুষই মুক্তিযোদ্ধা। অবাক করা সত্য হচ্ছে- এ সাধারণ মানুষ কয়েক লাখ দেশপ্রেমিক ধনিক শ্রেণির হাতে জিম্মি। তারাই নির্ধারণ করে তেল, পেঁয়াজ, নুনের দাম। তারা শুধুই নেয়, নিতে জানে। দেওয়ার বেলায় তাদের দুহাত কাঁপে। অথবা দেয় রাজনীতিকে পুঁজি করে।
এখানে আরও কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়। দেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। এ ট্রাস্টটি দেশের এ ধনিক শ্রেণির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেতে পারতো। কিন্তু তা না করে এ ট্রাস্টকেও ব্যবহার করা হয়েছে রাজনৈতিক ঢাল হিসেবে। এখনও করা হচ্ছে।
ভোগবাদীরা সব সময়ই চতুর। তারা জানে কখন কোন শিকার ধরে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে হয়। বাংলাদেশের এ ধনিক শ্রেণি তেমনটিই করেছে। তাদের মাঝে সততা ও নিষ্ঠার অভাব দুর্বল করে তুলেছে রাষ্ট্রের অর্থনীতির ভিত।
বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি যেসব শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে, তাদের একটি অন্যতম স্বপ্ন ছিল সম্পদের সুষম বণ্টন। আর সে জন্যই গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ ছিল স্বাধীনতার চার মূলস্তম্ভ। সেই অঙ্গীকার জাতি এখন অস্বীকার করছে। একটি অংশ নানা ধুয়া তুলে চার মূলনীতির উদারতাকে ম্লান করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। আর জাতি হিসেবে বাঙালি পরাজিত হতে শুরু করেছে সেই থেকেই।
বুর্জোয়া কিংবা পেটি বুর্জোয়া পোষ্য ধনিক শ্রেণি নির্মাণ করে কোনো দল কিংবা সরকারই একটি জাতির উন্নতি সাধন করতে পারে না। যারা বিত্তবান, যারা ধনশালী- তাদের রাষ্ট্রীয় আইন, অবকাঠামো মেনে চলতে হবে। সততা দিয়ে রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হতে হবে। গণমানুষের সার্বিক দীনতা দূর করতে না পারলে ধনিক শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা ব্যাপক কোনো পরিবর্তন আনবে না, আনতে পারে না। এটা সত্য যে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন- তাদের অনেক সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে বর্তমান সরকার। অভিযোগ আছে, সেটারও অপব্যবহার করা হয়েছে, হচ্ছে। সবখানেই এমন অপকর্ম কেন? প্রজন্ম সেই একাত্তরের স্বপ্নই দেখতে চায়। যা মহান মুক্তিযোদ্ধারা একাত্তরে দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নকে বাঁচাতে হবে- এর কোনো বিকল্প নাই।
ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন