‘মুক্তিযুদ্ধ একাত্তর’-এর গণহত্যার জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেতেই হবে

এ কে এম শহীদুল হক
 | প্রকাশিত : ২১ মার্চ ২০২৪, ১০:১৯

প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও জনপদে ‘জেনোসাইড’ বা গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘দি পলিটিক্যাল টাস্কফোর্স’ পরিচালিত গবেষণায় ১৯৫৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশ্বে ৪৩টি গণহত্যা সংঘটিত এবং এতে অন্তত ৫ কোটি লোক নিহত হয়েছে। ইউএনএইচসিআর-শরণার্থী বিষয়ক জাতিসংঘ হাইকমিশনের মতে- ২০০৮ সাল পর্যন্ত গণহত্যায় আরও ৫ কোটি লোক গৃহহারা হয়েছে।

গণহত্যায় অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা ও পশুত্বের কাছে মানবতা কীভাবে পদদলিত হয়- সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে- গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিন শত শত ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ হত্যার ঘটনা। বিশ্বের স্বঘোষিত বিবেকদের নীরবতা দেখে প্রশ্ন জাগে- এটা কি গণহত্যা নয়?

১৯৪৮ সালের ৯ই ডিসেম্বর জাতিসংঘে ‘দ্য কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’ সিপিপিসিজি গৃহীত এবং ১৯৫১ সালের জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়। ওই কনভেনশনের ২ নম্বর আর্টিক্যাল মোতাবেক গণহত্যার সংজ্ঞা এমন- কোনো জাতি বা জাতিগত গোষ্ঠী বা ধর্মীয় কোনো গোষ্ঠীকে নির্মূল করার অভিপ্রায়ে নিম্নবর্ণিত পাঁচটি কাজের যেকোনো একটি করলে তা গণহত্যা বা জেনোসাইডের অপরাধ হবে-

১. জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের ব্যাপক হারে হত্যা করলে; ২. জাতিগোষ্ঠীর সদস্যদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতিসাধন করলে; ৩. কোনো জাতিগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ কিংবা আংশিকভাবে ক্ষতিসাধন করার মানসে সুকৌশলে কোনো কর্ম পরিচালনা করলে; ৪. সদস্যদের প্রজনন ক্ষমতা বিনষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করলে; ৫. শিশুদেরকে পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন কিংবা নিজ জাতিগোষ্ঠী থেকে অন্যত্র সরিয়ে রাখলে।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য আন্দোলন করছিল, তখন ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুখ্যাত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা নিভিয়ে দেওয়া। তারা আওয়ামী লীগের নেতা-কমী-সমর্থক ও আওয়ামী ভাবধারার প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীকে চিরদিনের জন্য বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু করতে চেয়েছিল। ২৫শে মার্চ রাতেই পাকিস্তান বাহিনী প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করে। আর ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত ৯ মাসে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা এবং দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর তাদের বন্দিশিবিরে আটক ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী, ভুক্তভোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনের জবানবন্দি, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, গবেষণা ও অন্যান্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি হত্যা ও নির্যাতনের চিত্র উদ্ঘাটিত হতে থাকে। ওইসব ডকুমেন্টও গণহত্যার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী যেভাবে বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল, নারীদের ধর্ষণ করেছিল এবং জ্বালাও-পোড়াও, অমানুষিক নির্যাতন করে বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আতঙ্ক, মানসিক ভীতি ও ক্ষতিসাধন করেছিল- তা জাতিসংঘ কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবে গণহত্যা।

আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন, জাতিসংঘ এবং ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি, বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরোচিত নির্যাতনের অনেক তথ্য-প্রমাণ ও দলিলপত্র সংগ্রহ করেছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন পাকিস্তানি বাহিনীর এ হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে। জেনোসাইড ওয়াচ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘দ্য ইন্টারন্যাশনাল কোয়ালিশন অব সাইটস অব কনসায়েন্স’ এবং ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলারস’ ইতোমধ্যে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারা জাতিসংঘকে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনকে অবিলম্বে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভিকটিমদের প্রতি সম্মান জানাতে আহ্বান জানিয়েছে।

তারা দোষীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির মধ্যে আনারও আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ‘লেমকিন ইনস্টিটিউট ফর জেনোসাইড প্রিভেনশন’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তিতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনকে গণহত্যা বা জেনোসাইড হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এতৎসত্ত্বেও জাতিসংঘ এখনও পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে স্বীকৃতি আদায়ের কার্যকর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টারও ঘাটতি রয়েছে। বিদেশে এ সংক্রান্ত প্রচার তেমন হয়েছে বলেও মনে হয় না। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী সরকারগুলো এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অধিকন্তু জিয়া ও এরশাদ সরকার পাকিস্তানকে গণহত্যার দায় থেকে রেহাই দিতে সহায়তা করেছে।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আন্তরিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০১৭ সালে ২৫শে মার্চকে জেনোসাইড ডে বা গণহত্যা দিবসও ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন ফোরামে গণহত্যার স্বীকৃতির যৌক্তিকতা তুলে ধরে বক্তব্য দিচ্ছেন এবং গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বিশ্ববাসীকে সমর্থন জানানোর আহ্বান জানাচ্ছেন।

সিভিল সোটাইটির নেতৃবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, গবেষক, মানবাধিকার কর্মী, ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন এবং প্রবাসী বাঙালিরা অ্যাডভোকেসি সভা, সেমিনার, আলোচনা সভা ইত্যাদি উদ্যোগের মাধ্যমে গণহত্যার পক্ষে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, গণহত্যা নির্যাতন আরকাইভ ও জেনোসাইড মিউজিয়াম, ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম ও প্রজম্ম ’৭১ (মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সংগঠন) ইত্যাদি সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে গণহত্যার স্বীকৃতির পক্ষে জনমত তৈরির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের বাংলাদেশীয় দোসরদের হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতেই হবে। এ গণহত্যার স্বীকৃতি শুধু দাবি নয়; এটা বাঙালিদের যৌক্তিক অধিকার; আর বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব।

গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে বিশ্ববাসী স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষের আত্মত্যাগ সম্পর্কে জানতে পারবে। দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আত্মোৎসর্গকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পাবে এবং দেশ ও জনগণের প্রতি দায়িত্ব বেড়ে যাবে। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলে যারা গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচার করা সম্ভব হলে ভবিষ্যতে গণহত্যার ঘটনা হ্রাস পাবে।

তবে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সহজ নয়। এ জন্য বাংলাদেশ সরকার ও সর্বমহলের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদেরও এ ব্যাপারে সক্রিয় ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। গণহত্যা দিবস ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রদূতরা সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি-বেসরকারি পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা ও মতবিনিময় করে যেতে হবে। বিশেষ করে যারা মানবাধিকার ও গণহত্যা নিয়ে কাজ করেন তাদের কাছে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরতে হবে।

মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের গণহত্যা জাতিসংঘের স্বীকৃতি পেলেই তা যথার্থ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি বলে বিবেচিত হবে। এ জন্য যেতে হবে আরও অনেকটা পথ।

এ কে এম শহীদুল হক: সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ; সহসভাপতি, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :