এখন তিন হাসপাতালে রোগী দেখছেন সেই ডা. সংযুক্তা সাহা

হাসান মেহেদী, ঢাকা টাইমস
| আপডেট : ০৫ মে ২০২৪, ১২:৫১ | প্রকাশিত : ০৫ মে ২০২৪, ১০:৪৫

রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা এখন ঢাকার ৩টি হাসপাতালে রোগী দেখছেন। দিচ্ছেন চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ।

গত বছর জুন মাসে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুতে আলোচনায় আসেন ডাক্তার সংযুক্তা। ১৩ বছর তিনি বিএমডিসির নিবন্ধন ছাড়াই রোগী দেখতেন এবং চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছিলেন।

বর্তমানে সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ইমপালস হসপিটাল ও উত্তরা হাই কেয়ার হসপিটালে ডা. সংযুক্তা সাহার রয়েছে রোগী দেখার চেম্বার। নিয়মিত সেখানে চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন তিনি। এর আগে ডা. সংযুক্তা সাহা গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, তিনি ইমপালস হসপিটালে প্র্যাকটিস করছেন। তবে এখন পর্যন্ত তিনি প্র্যাকটিস করছেন নাকি প্র্যাকটিস শেষ করেছেন এই বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। একাধিকবার তার ব্যবহৃত মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি কয়েকদিন ধরে তিনি উল্লেখিত তিনটি মেডিকেলেও রোগী দেখছেন না।

এ বিষয়ে ডাক্তার সংযুক্তা সাহার সহকারী (গাড়ি চালক) মো. জমির মুঠোফোনে ঢাকা টাইমসকে বলেন, “বর্তমানে ডা. সংযুক্তা সাহা দেশের বাইরে আছেন। তিনি একটি কাজে দুবাইতে গেছেন। রবিবার দেশে ফিরবেন। সেন্ট্রাল হাসপাতালের বিষয়ে আমি জড়িত নই। ম্যাডাম যখন যা বলেন আমি তাই করি। আমিতো তার চাকরি করি মাত্র।” সেন্ট্রাল হাসপাতালে রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে নাম আসে জমিরের। রোগীর মৃত্যুর আগে এই হাসপাতালে আসার বিষয়ে যোগাযোগ হয়েছিল জমিরের সঙ্গে।

শুক্রবার দুপুরে ডাক্তার সংযুক্তা সাহার মুঠোফোনে একাধিকবার কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি, তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডাক্তার পরিচয়ে তার মোবাইল ফোনের কল রিসিভ করে এক নারী বলেন, ডাক্তার সংযুক্তা সাহা ব্যস্ত আছেন।

শুক্রবার দুপুরে তেজগাঁও এলাকার ইমপালস হসপিটালের কাস্টমার কেয়ার ইনচার্জ মো. উজ্জ্বল ঢাকা টাইমসকে বলেন, “ডা. সংযুক্তা সাহা প্রতি সপ্তাহের শনিবার, রবিবার ও মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার ইমপালস হসপিটালে তার চেম্বারে রোগী দেখেন। তার রোগী দেখার সময় দুপুর ২টা থেকে বিকাল ৫টা এবং সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা। রোগীকে চিকিৎসা সেবা ও পরামর্শ দিতে কত টাকা নেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ম্যাডাম রোগী দেখতে ১৫০০ টাকা ফি নেন। এখানে এসে ডাক্তার দেখানোর পর এই ফি দিতে হয়। বর্তমানে ডা. সংযুক্তা সাহা দুবাইতে আছেন, তিনি রবিবার দেশে এসেই চেম্বারে বসবেন।”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডা. সংযুক্তা সাহা গুলশান-২ এর সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছেন। সেখানে তিনি প্রতি সপ্তাহের শনি থেকে বৃহস্পতিবার রোগী দেখেন।

শুক্রবার দুপুরে ওই হাসপাতালের হটলাইনে ফোন দিয়ে ডা. সংযুক্তা সাহার বিষয়ে জানতে চাইলে কামরুজ্জামান ও উজ্জ্বল নামের দুই ব্যক্তি ঢাকা টাইমসে জানান, শনিবার পর্যন্ত ডা. সংযুক্তা সাহা ছুটিতে আছেন। রবিবার তার অফিস করার কথা রয়েছে। রোগী দেখতে কত টাকা নেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, রোগী দেখা ফি হিসেবে ৭০০ টাকা নেন সংযুক্তা সাহা। শুক্রবার তিনি রোগী দেখেন না। এছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত নিয়মিত রোগী দেখেন।

উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে উত্তরা হাই কেয়ার হসপিটালে সপ্তাহে দুইদিন রোগী দেখেন ডা. সংযুক্তা সাহা। হাসপাতালটির সিআরও আনজুমান জানান, ডা. সংযুক্তা সাহা সপ্তাহের সোমবার ও বুধবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে রোগী দেখেন। রোগী দেখার জন্য তিনি ১৫০০ টাকা ফি নেন।

এদিকে হাসপাতালটির ম্যানেজার ওমর ফারুক ঢাকা টাইমসকে বলেন, “প্রায় দুই মাস ধরে সংযুক্তা সাহা উত্তরা হাই কেয়ার হসপিটালে তার চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন। তার বিএমডিসির নিবন্ধনসহ রোগী দেখার সব কাগজপত্রই আছে।”

সেন্ট্রাল হাসপাতালে মাহবুবা রহমান আঁখি ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ওই হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার বিশেষজ্ঞ সেবা দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।

ডা. সংযুক্তা সাহাকে সর্বশেষ রবিবার একাধিকবার ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৯ জুন কুমিল্লার তিতাস উপজেলা থেকে ঢাকায় এসে অন্তঃসত্ত্বা মাহবুবা রহমান আঁখি সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হন। আঁখির পরিবারের ভাষ্য, তাকে ভর্তি করা হয় চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার অধীনে। তবে আঁখির চিকিৎসা করেন অন্য চিকিৎসকরা। তখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ডা. সংযুক্তা সাহার অনুপস্থিতি গোপন রেখেছিল। তারা আঁখির স্বাভাবিক প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়ে পরে অস্ত্রোপচার করেন। ওই সময় নবজাতকের মৃত্যু হয়। সংকটাপন্ন হয়ে পড়েন আঁখিও। নবজাতকের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর আঁখিও অপর এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরে নবজাতকের বাবা ইয়াকুব আলী এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় মামলা করলে দুই চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান সেন্ট্রাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ডা. সংযুক্তা সাহা।

এদিকে ভুল চিকিৎসায় নবজাতকের মৃত্যু ও মায়ের মৃত্যুঝুঁকির ঘটনায় সেন্ট্রাল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি পায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পরবর্তী নির্দেশের আগ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র) এবং সব ধরনের অস্ত্রোপচার কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে সেই হাসপাতালে এখনো চলছে বিভিন্ন রোগের অস্ত্রোপচার কার্যক্রম।

এসব বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কেউ ফোন রিসিভ করেননি।

মামলার বাদী ইয়াকুব আলী (সুমন) ঢাকা টাইমসকে বলেন, “আমার নবজাতক সন্তান ও স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কেউই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমি মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।”

তিনি বলেন, “আমার স্ত্রী মাহবুবা রহমান আঁখিকে নিয়মিত ডা. সংযুক্তা সাহাকে দিয়ে চিকিৎসা করাতাম। কয়েকবার ডা. সংযুক্তা সাহাকে দেখিয়েছি। তার অধীনে চিকিৎসাধীন ছিলেন আমার স্ত্রী। এজন্য তাকে ৭০০ টাকা করে ফি দিতাম। আঁখিকে ভর্তি করা হয়েছিল চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার অধীনেই। যখন আমরা কুমিল্লা থেকে আঁখিকে নিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসি তখনও আমরা জানতাম ডা. সংযুক্তা সাহাই আমার স্ত্রীর ডেলিভারি করাবেন। আমার স্ত্রীকে যখন ওটিতে (ওপারেশন থিয়েটার) নেওয়া হয়, তখনও তারা (হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট) বলেছিলেন ওটিতে ডা. সংযুক্তা সাহা আছেন। পরে যখন আমার নবজাতক শিশু মারা গেল, তখন শুনি তিনি ওটিতে ছিলেন না। তার সহকারীরা অস্ত্রোপচার করেছেন।” ধানমন্ডি থানার মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক পুলিশ সদস্য ঢাকা টাইমসকে বলেন, “মামলা তদন্ত কাজ প্রায় শেষ। ময়না তদন্তের প্রতিবেদনও এসেছে। খুব শিগগিরই মামলাটির চার্জশিট আদালতে প্রদান করা হবে।”

এদিকে ২০২৩ সালের ৬ জুলাই মানহানিকর মন্তব্যের অভিযোগ তুলে ৫০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে হাসপাতালের সেক্রেটারি দিদারুল আলম ঢাকার প্রথম যুগ্ম-জেলা জজ আদালতে ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলাটির শুনানি শেষে বিচারক মো. মাসুদুল হক ডা. সংযুক্তা সাহাকে ওই বছর ২৫ জুলাইয়ের মধ্যে মামলার বিষয়ে লিখিত বক্তব্য জমা দিতে বলেন।

এ বিষয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের পরিচালক (মেডিকেল সার্ভিসেস) ডা. এনায়েত হোসেনের সাথে ঢাকা টাইমস যোগাযোগ করলে তিনি ভুল চিকিৎসায় নবজাতক ও প্রসূতি মৃত্যুর বিষয় কিছু বলতে চান না বলে জানান।

(ঢাকাটাইমস/০৫মে/এইচএম/এফএ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :