লুটেরাদের শ্রেণি চরিত্র ও মুক্তিযুদ্ধের মানস

ফকির ইলিয়াস
  প্রকাশিত : ১২ জুন ২০২৪, ১১:০৪
অ- অ+

বাংলাদেশে একের পর এক যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তা মানুষের মনে অনেক প্রশ্নের উদ্রেক করছে। দেশের দুজন প্রধান বাহিনী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগ এখন আলোচনার বিষয় দেশে-বিদেশে! একজন এমপিকে খুন করা হয়েছে প্রতিবেশী একটি দেশে! এই এমপি কেন একা সেই দেশে গিয়েছিলেন- তা নিয়ে চলছে অনেক জল্পনা! বিষয়গুলোর নেপথ্যে কি দুর্নীতি, লুটপাট জড়িত? এর কোনো সুরাহা এ পর্যন্ত নেই!

বর্তমান সময়ে একটি বিষয় খুব জরুরিভাবে আমাদের লক্ষ রাখা দরকার। তা হলো, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার প্রবণতা। বাংলাদেশে প্রতিটি বইমেলায় কিছু সংখ্যক লেখককে ভাড়া খাটানো হয়। এদেরকে এসাইনম্যান্ট দেওয়া হয়, কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আঘাত করা। যেমন ধরা যাক একটি সংলাপের কথা। একটি গল্পের মূল চরিত্র বলছে- 'আমাদের জব্বার চাচা গণ্ডগোলের সময় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান না হইলে, এই এলাকায় আরও খুন খারাবি হইতো- তাই না সখিনা 'বু!'

কী বুঝা গেল এই সংলাপ থেকে? বুঝা গেল, কৌশলে একজন রাজাকারকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিংবা তার অপরাধকে গৌণ করে দেখার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এর কারণ কী? কারণ হলো ইতিহাস বিকৃতি। আমাদের প্রজন্মের মননে ঘুণ ধরানো। তাদের বিভ্রান্ত করা। আমরা দেখছি, দেশে কিংবা বিদেশে আমাদের সম্মানিত বুদ্ধিজীবীদের অপমান করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদের টার্গেট ড. আনিসুজ্জামান, সেলিনা হোসেন, যতীন সরকার, ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, হাসান আজিজুল হকের মতো বুদ্ধিজীবীরা। এর কারণ কী? কেন ওরা শওকত ওসমানকে এখনও আক্রমণ করে কথা বলে?

বলে এজন্য- কারণ এই বুদ্ধিজীবীরা আমাদের প্রজন্মকে শানিত করার জন্য যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছেন-রাখছেন। ওরা তঁদেরই হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইছে। রাজনৈতিকভাবে তো বটেই- সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবেও ওরা আমাদের ভেতরে ঢুকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। তারা প্রভাব খাটিয়ে কাছে ভিড়ে গেছে রাজনৈতিক উচ্চমহলের কাছাকাছিও।

খুবই হতাশার কথা হচ্ছে, এক শ্রেণির তথাকথিত সাংবাদিক এবং পেশাজীবী সংগঠনের নামে রাজনৈতিক সুবিধাবাদী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এ তথাকথিত সাংবাদিক ও সংগঠনগুলোর কোনো নীতি আদর্শ বলতে কিছু নেই। সরকার দলের কর্মী ও অনুসারী পরিচয় দিয়ে নানা ধরনের সুবিধা আদায়ের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে কিছু ব্যক্তি। আসলে তারা কোনো প্রকৃত সাংবাদিক নয় কিংবা সরকারি দলের কোনো নেতা বা কর্মীও নয়। তাদের মূল লক্ষ্য হলো চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করা। পদক কিংবা সংবর্ধনা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে উঠতি কিছু স্বঘোষিত নেতা ও ব্যবসায়ী হতে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে পদক বাণিজ্যে লিপ্ত রয়েছে এরকম অনেক সংগঠন। এরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী, এমপিকে নিয়ে আসেন। আবার এরা মন্ত্রী, এমপিদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি করে চলে। সরকার দলের কোনো মন্ত্রী, এমপি এসব চাঁদাবাজদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তাদের ধান্ধাবাজির অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বা বিশেষ অতিথির আসন অলংকৃত করলে ভুঁইফোঁড় সংগঠনগুলো এক ধরনের বৈধতা লাভ করে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। এর আগে বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের নামের সাথে যুক্ত হয়ে অনেকেই এমনটি করেছে।

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন রয়েছে নয়টি। এর বাইরে অন্য কোনো সংগঠনের দলীয় পরিচয় ব্যবহার করার কারো এখতিয়ার নেই। অথচ অনেক ভুঁইফোঁড় সংগঠন দলের সহযোগী ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে দাবি করে।

আসলে এসব কী হচ্ছে? এর কোনো জবাব নেই। কেউ জানে না এরা আসলে কেমন সংস্কৃতিসেবী। আরও ভয়াবহ কথা হচ্ছে- মাদক, ইয়াবা, অস্ত্র ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসীকে টাকার বিনিময়ে এওয়্যার্ড প্রদান করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

এসব পদক যাদের দেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে ওই সংগঠনের নেতারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন। স্বর্ণপদক দিতে ৫০ হাজার, রৌপ্যপদক দিতে ৩০ হাজার আর সম্মাননা ক্রেস্ট দেওয়া হলে তার জন্য ১০/১৫ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়। অথচ কে না জানে- কথিত স্বর্ণপদকে এক রতি, রৌপ্য পদকে ৪ আনা রুপা দেওয়া হয়। আর ক্রেস্ট তৈরিতে লাগে ৫০০-৮০০ টাকা।

এমন খবর বিভিন্ন মিডিয়ায় বারবার ছাপা হয়েছে। খরচ বাদে পুরোটাই যায় আয়োজকদের পকেটে। ভুঁইফোঁড় পদক কমিটির একাধিক সদস্য বলেছেন, অনেক ব্যক্তি আছে যাদের অপকর্ম আড়াল করতে এই পদক নিচ্ছে এবং দিচ্ছে। কারণ তাদের সমাজে সুখ্যাতি কম। তারা সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী ও বিশিষ্টজনদের হাত থেকে পদক নিয়ে ‘গর্বিত’ হন। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরে অতিথি নির্বাচন করে আমন্ত্রণ জানানো হয়। ভেন্যু হিসেবে বাংলাদেশে শিশু কল্যাণ পরিষদ মিলনায়তন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লাইব্রেরি হলরুম, মনি সিংহ ট্রাস্ট মিলনায়তন, জাতীয় প্রেসক্লাব অথবা ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির হলরুম, জাতীয় জাদুঘরের হলরুম ভাড়া করা হয়। ছাপানো হয় আমন্ত্রণপত্র। পদক বিতরণের আগের দিন সব গণমাধ্যমে চিঠি পাঠিয়ে রিপোর্টার ও ক্যামেরাম্যান এসাইনমেন্ট চাওয়া হয়।

দুর্বৃত্তায়নের অর্থনীতি বাঙালির মূল্যবোধকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মূল্যবোধ স্খলিত লোকজনের সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তির দাপট মূল্যবোধের কফিনে শেষ পেরেকটি মারছে। মূল্যবোধ ধ্বংসের ব্যবস্থাদি ধারণ-লালনের নেতিবাচক প্রভাবে সামাজিক অবক্ষয় ভয়াবহ রূপে আবির্ভূত হয়েছে এই ফেসবুক সভ্যতার কালে। সামাজিক অবক্ষয় যেভাবে বাড়ছে তা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সমাজ আরও ভেঙে পড়বে।

আজ যারা বিভিন্ন অভোযোগে অভিযুক্ত, এরাও এ ধরনের অপকর্মকে ঠাঁই দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। সামাজিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা পেতে পরিবার- সমাজ-রাষ্ট্রকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। মূল্যবোধের অবক্ষয়ের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেওয়াতেই আজকের এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। মানুষ সব সময়ই খ্যাতি চায়। কিন্তু এর প্রক্রিয়া কী? দাপট দেখাবার নামে সামাজিক অবক্ষয়ের বিস্তার ঘটছে ব্যাপকভাবে। আধুনিকতা ও প্রগতিশীলতার দোহাই দিয়ে বহু ক্ষেত্রে মূল্যবোধের অবক্ষয় উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে চাওয়া-পাওয়ার বাসনার অদম্যতা সমাজকে অস্থির করে তুলেছে। মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক জীব মানুষের সমাজে শান্তিপূর্ণ বসবাস চায়। কিন্তু তা যেন রহিত হয়ে পড়ছে দিনে দিনে খ্যাতির তালাশে। আমরা ভুলিনি, সামাজিক প্রয়োজনেই সামাজিক অবক্ষয়ের আগ্রাসন থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হয়।কিন্তু খ্যাতির খোঁজে অবক্ষয় যেভাবে বাড়ছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই।

একই অবস্থা বিদেশেও। অর্থের কাছে মেধা হেরে যাচ্ছে। অর্থ দিয়ে পদক কেনা হচ্ছে বিদেশেও। বয়স তার বিশের কোটায়। নিজেই লিখে ফেলছে নিজের আত্মজীবনী। আমাদের বড়ো বড়ো লেখক খুব সহজেই কোনো অখ্যাত কাউকে 'প্রিয় লেখক অমুক' বলে অটোগ্রাফ দিয়ে দিচ্ছেন। এভাবে সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে পরগাছা বাড়ছে। অথচ মেধাবীরা আজীবন লেখালিখি করেও সামান্যতম সামাজিক স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।

বিত্তের কাছে পরাজিত সভ্যতা নিয়ে কোনো জাতি এগোতে পারে না। বাংলাদেশ আজ তেমনি একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিশ্বজুড়েই এক স্থবিরতা চলছে। এমন ক্রান্তিকালে মানুষে-মানুষে, শ্রেণিতে-শ্রেণিতে মানুষের মানবিকবোধ জাগ্রত করতে হবে। বিবেকবান মানুষকে সেই লড়াই সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু অতীতের ঐতিহ্য নয়, ভবিষ্যত সাহিত্য-শিল্পের পথ দেখাতে বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসতে হবে।

সাংস্কৃতিক গণজাগরণ ছাড়া আমাদের সামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়। সংস্কৃতির ব্যাখায় ড. আহমদ শরীফ আরো লিখেছিলেন- ‘বাঞ্ছিত সংস্কৃতি হচ্ছে সমাজে স্বাধিকারে সমস্যার্থে সহিষ্ণুতায় সহযোগিতায় সহাবস্থানের আগ্রহ নিয়ে আবিষ্কারে, উদ্ভাবনে, নির্মাণে কিংবা গ্রহণে-বর্জনে নব নব চিন্তা-চেতনার অনুশীলনে মানবসম্পদ বৃদ্ধির এবং যন্ত্রের ও বস্তুর উৎকর্ষযোগে ব্যাবহারিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য-স্বাচ্ছল্য সুরুচি-সৌন্দর্য বৃদ্ধির প্রয়াস চালানো এবং ভাব-চিন্তা-কর্ম-আচরণে হিংসা-ঘৃণা-ঈর্ষা-অসূয়া-জুলুম প্রভৃতির প্রভাবমুক্ত থাকা। এ অর্থে সক্রিয় সৌজন্যই সংস্কৃতি। যুক্তিনিষ্ঠ ন্যায়বানই সুজন এবং সুজনমাত্রই তাই সংস্কৃতিবান’। আমাদের আজকের বাংলাদেশে তা কতটা প্রতিপালিত হচ্ছে? আমাদের রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, পেশাজীবীরা তা কতটা মানছেন! বাংলাদেশে সংস্কৃতির সংগ্রাম শেষ হওয়ার নয়। কালো শক্তিকে দমাতে গণমানুষকে মাঠে থাকতে হবে। সংস্কৃতির নতুন এ স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য দেশের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধর্ম ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে মানুষ কিনছে। এটি দেশের সংস্কৃতির জন্য বড়ো বিপদের কথা। সংস্কৃতিকর্মীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষদের কাছে যেতে হবে। এই ভাষা আন্দোলনের মাসে সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়ন ঠেকানোর জন্য প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমশ কমে এসেছে। এটা খুবই ভালো দিক। এখন প্রয়োজন শিকড় এবং ঐতিহ্য-কৃষ্টির সন্ধানে ’৫২ কিংবা ’৭১-এর চেতনায় এগিয়ে যাওয়া। ইতিহাস বিকৃতির কাজ রোধ করাটি এর অন্যতম অংশ। বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ ছাড়া বাঙালি জাতির প্রাত্যহিক অবকাঠামোগুলোর সৃজনশীল বিন্যাস সম্ভব নয় কোনোমতেই। একই সাথে, সরকারের উচিত লুটপাটকারীদের টুঁটি চেপে ধরা। কারণ দানব যখন বড়ো হয়ে ওঠে, তখন সে যে কাউকেই গ্রাস করতে উদ্যত হয়। লুটেরাদের শ্রেণিচরিত্র তো একই বিশ্বজুড়ে।

ফকির ইলিয়াস: কলাম লেখক, কবি ও সাংবাদিক

google news ঢাকা টাইমস অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুন

মন্তব্য করুন

শীর্ষ খবর সর্বশেষ জনপ্রিয়
সব খবর
এপ্রিলের ২৯ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২৬০ কোটি ৭৬ লাখ ডলার
নির্ধারিত সময়ের দুই মাস আগেই সব দেনা পরিশোধ করল পেট্রোবাংলা
ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব: অর্থ উপদেষ্টা
উপদেষ্টাদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময়, বিভিন্ন প্রস্তাব বাস্তবায়নের আশ্বাস
বিশেষ প্রতিবেদন তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা